ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৭ ফাল্গুন ১৪৩১

হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার, বিনামূল্যের পাঠ্যবই বিতরণ, জেলা প্রশাসক পদায়ন কাজে স্থবিরতা

শম্বুক গতিতে চলছে সিভিল প্রশাসন

তপন বিশ্বাস

প্রকাশিত: ২৩:১৬, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

শম্বুক গতিতে চলছে সিভিল প্রশাসন

শম্বুকগতিতে চলছে সিভিল প্রশাসন

শম্বুকগতিতে চলছে সিভিল প্রশাসন। ডিসি’র পদায়ন, রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার, বিনামূল্যের পাঠ্যবই বিতরণ, মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কেনাকাটা, পদোন্নতিবঞ্চিত অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বঞ্চনা নিরসনের মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আটকে আছে আমলাতান্ত্রিক গ্যাঁড়াকলে। সরকারের উপদেষ্টারাই বলছেন, সরকারের যে গতিতে কাজ করার কথা, সেভাবে করতে পারছে না আমলাদের অসহযোগিতার কারণে।
এদিকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় ঘোষণার পর আরও কৌশলী আমলারা। অনেকে এই সরকারের আমলে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে চাইছেন না। কারণ নির্বাচিত সরকার এলে বিপদে পড়ার ভয়ে আছেন তারা। এ ছাড়া যেসব সচিবের চাকরির মেয়াদ শেষের পথে, তারাও নিচ্ছেন না ঝুঁকি।

আর যারা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে আছেন, তারা কনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সমন্বয় করতে পারছেন না। এতে ছোট কাজেও হচ্ছে ভুল। বিশ্লেষকরা মনে করেন, কিছু কর্মকর্তা সকল আমলেই থাকেন বহাল তবিয়তে। এখনো তারা রয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ অনেক দায়িত্বশীল পদে। প্রশাসনের অনেক যোগ্য লোক আওয়ামী লীগ আমলে ছিলেন বঞ্চিত, এখনো তাদের ভাগ্য ফেরেনি। দায়িত্বশীল পদে থাকা কর্মকর্তারা কৌশলে প্রশাসনকে গতিহীন করে রেখেছেন। উপদেষ্টা ও আমলাদের মধ্যে সমন্বয় না থাকার বিষয়টিও পরিষ্কার। 
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক উপদেষ্টা জনকণ্ঠকে বলেন, সরকার গত সাড়ে পাঁচ মাসে আমলাতান্ত্রিক নানা জটিলতায় প্রায় ৭০ শতাংশ কাজ করতে পারেনি। এ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত কয়েকটি সাপ্তাহিক বৈঠকে ক্ষোভ প্রকাশ করেন উপদেষ্টারা।

কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নথি দীর্ঘদিন নিষ্পত্তি না হওয়ায় দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তার ওপর ক্ষোভও ঝাড়েন কেউ কেউ। সম্প্রতি ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজের সংলাপ অনুষ্ঠানে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম বলেন, আমলাদের কাছ থেকে কাক্সিক্ষত সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না।
মাঠ প্রশাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি জেলা প্রশাসক (ডিসি)। অন্তর্র্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই ডিসি পদায়নে লেজেগোবরে পরিস্থিতি দেখা যায়। নজিরবিহীন হট্টগোল, বিক্ষোভ, অস্থিরতার মুখে চার মাস পর ফের ডিসি পদায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। গত ১১ জানুয়ারি থেকে ডিসি ফিটলিস্টের (তালিকা) জন্য শুরু হয় সাক্ষাৎকার। একদিন পরপর এই সাক্ষাৎকার নেওয়ার কথা ছিল।

তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় একদিন সাক্ষাৎকার নিয়েই তা বন্ধ করে দেয়। ডিসি পদায়নের কাজ থেমে যাওয়ায় মাঠ প্রশাসনে এক ধরনের স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। কারণ বর্তমান ডিসিরা ভাবছেন, নতুন তালিকা হলে তাদের প্রত্যাহার করা হবে।
যশোরের ডিসি আজাহারুল ইসলাম বলেন, সাধারণত একজন ডিসিকে তিন বছরের জন্য একটি জেলায় পদায়ন করা হয়। এজন্য কাজের শুরুতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে তিন বছরের কাজের পরিকল্পনা পাঠাতে হয়। তবে কম সময়ের মধ্যে বদলি করা হলে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কিছুটা সমস্যা হয়।
বিগত আমলে রাজনৈতিক সব হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের জন্য গত ২২ সেপ্টেম্বর জেলা ও মন্ত্রণালয় পর্যায়ে দুইটি কমিটি গঠন করে সরকার। গত সাড়ে ১৫ বছরে বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী দমনে কয়েক লাখ মামলা হয়েছিল। গত চার মাসে ৬৪ জেলা থেকে মাত্র চারটি মামলার তথ্য পেয়েছে আইন মন্ত্রণালয়।

মামলা প্রত্যাহারের বিষয়ে জেলা কমিটির সভাপতি ছিলেন ডিসিরা। এ কাজেও তারা ধীরে চলছেন। এ ব্যাপারে নোয়াখালীর ডিসি খন্দকার ইসতেয়াক আহমেদ বলেন, মামলার তথ্য এখনো মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়নি। কারণ নোয়াখালীতে মামলা অনেক বেশি। তাই এসব মামলা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের জন্য দুইটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। জেলা পর্যায়ের কমিটি কাজ করেনি। ফলে লাখ লাখ মামলার মধ্যে মাত্র চারটি মামলা প্রত্যাহারের তালিকায় এসেছে। 
রাজনৈতিক পালাবদলের পাশাপাশি সংশ্লিষ্টদের নানা অনিয়ম ও গাফিলতির কারণে এবার বছরের শুরুতে বিনামূল্যের পাঠ্যবই পায়নি বেশিরভাগ শিক্ষার্থী। ফলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) ওয়েবসাইট থেকে বইয়ের পিডিএফ কপি ডাউনলোডের পর সেগুলো ফটোকপি করেই চলছে পাঠ কার্যক্রম। শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, শিক্ষার্থীরা সব পাঠ্যবই ফেব্রুয়ারির মধ্যেই হাতে পাবে।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পদোন্নতিবঞ্চিত অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বঞ্চনা নিরসনে গঠিত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের প্রস্তাব গত ২৪ ডিসেম্বর অনুমোদন দেয় সরকার। এটি এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। আওয়ামী লীগ আমলে যেসব কর্মকর্তা সচিব হতে পারেননি, কিন্তু চাকরি করেছেন তাদের বঞ্চিত তালিকায় রাখা হয়নি। এসব কর্মকর্তা বাড়তি সুবিধা নেওয়ার জন্য নানাভাবে তদবির করছেন। এজন্য বঞ্চিত কর্মকর্তাদের প্রজ্ঞাপন জারি করতে পারছে না সরকার।

সচিবালয়ে প্রবেশে নীতিমালা সংশোধনও আটকে আছে। গত ২৭ ডিসেম্বর সচিবালয়ে প্রবেশের অস্থায়ী সব পাস বাতিল করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এজন্য গণমাধ্যম ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিরা সচিবালয়ে প্রবেশে সমস্যায় পড়েন। এর মধ্যেই সচিবালয় প্রবেশ নীতিমালা সংশোধনের উদ্যোগ নেয় সরকার। তবে জরুরি এই সংশোধনীর কাজও আটকে আছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায়।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন ও অর্থ) আতাউর রহমান বলেন, নীতিমালা সংশোধনের কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। অনুমোদন হলে মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া হবে।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের জরুরি প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, আসবাব কেনাকাটাতেও হচ্ছে দেরি। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ভাঙচুর হয়েছিল এই কার্যালয়ে। অথচ এখনো বেশিরভাগ কম্পিউটার কেনা হয়নি। ফলে ব্যাহত হচ্ছে কাজ।
এ ছাড়া গণভবনে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর’ প্রতিষ্ঠার জন্য ২৪ ডিসেম্বর উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়। তবে এই জাদুঘর তৈরির ঘোষণা আসে সেপ্টেম্বরে। বর্তমান সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক এ কাজ সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়নের কথা থাকলেও তা এখনো শুরুই হয়নি। গুরুত্বপূর্ণ অনেক আইন সংশোধনের উদ্যোগও নানা কারণে আটকে আছে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, গত সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার মন্ত্রিপরিষদ সচিবের চেয়ে মুখ্য সচিবকে বেশি ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ দিয়েছে। ফলে গুরুত্বপূর্ণ বেশিরভাগ কাজ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বাস্তবায়ন হতো। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ও সচিবরা অবসরে গিয়ে সংসদ সদস্যসহ অনেক সুবিধাও পেয়েছেন।

৫ আগস্টের পরও মন্ত্রিপরিষদ সচিব প্রশাসনের এক নম্বর পদ হলেও এ দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের কোনো সমস্যা হয়নি। তবে নানা কারণে সাবেক কোনো কোনো মুখ্য সচিবকে কারাগারেও যেতে হয়েছে। অন্তর্র্বর্তী সরকার তার কার্যালয়ে মুখ্য সচিব নিয়োগ করেছেন দায়িত্ব নেওয়ার প্রায় চার মাস পর। আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের নিয়ম ভেঙে এখনো গতিশীল করতে পারেননি মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আব্দুর রশীদ।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সাচিবিক কাজ করার জন্য চারটি মহাপরিচালক (ডিজি) ও ১৫টি পরিচালকের পদ রয়েছে। এর অধিকাংশ পদই ফাঁকা। ডিজির চার পদের মধ্যে কর্মরত আছেন দুইজন। পরিচালকের ১৫ পদে কর্মরত আছেন ৮ কর্মকর্তা। জনবল সংকটের কারণে অন্তর্র্বর্তী সরকার গঠনের পর মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে নিয়মিত তদারকি করা হচ্ছে না।

প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া বলেন, শূন্যপদ পূরণ হয়ে যাবে। তবে সব সরকার এক নিয়মে চলে না। তারপরও নিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান। কেউ যাচ্ছেন, কেউ আসছেন। যারা আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী, ঠিকমতো কাজ করছেন না তারা কেউ থাকতে পারবেন না। এরই মধ্যে মূল ব্যক্তিদের সরানো হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সবাই চলে যাবে।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কঠিন সময় পার করছে। এ মন্ত্রণালয়ে নিয়মিত কোনো উপদেষ্টা নেই। বর্তমানে সংস্কৃতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম, মৎস্য ও প্রাণী, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, সেতু বিভাগ, জাতীয় সংসদ সচিবালয় এবং পরিকল্পনা কমিশনসহ ৯টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে সচিব নেই। আটকে আছে ডিসি ফিটলিস্টের কার্যক্রম। প্রশাসনের শীর্ষ অনেক পদ শূন্য। কিছু পদে নিয়োগ দেওয়ার পরও বাতিল করা হয়েছে। 
সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার বলেন, সরকার দক্ষ ও সাহসী লোক নিয়ে প্রশাসন সাজাতে পারেনি। প্রশাসনে অনেকে আছেন, যারা আগেও বঞ্চিত ছিলেন, এখনো কপালপোড়া। এসব কারণে সরকার ভালো সহযোগিতা পাচ্ছে না, সমন্বয় হচ্ছে না। এজন্য দুইপক্ষই দায়ী। তিনি বলেন, সরকার ঠিক থাকলে কেউ কাজে ফাঁকি দিতে পারবে না।
প্রধান উপদেষ্টা বা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ডিজি-পরিচালকরা সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কার্যক্রম তদারকি করেন। এ ছাড়া তারা রাষ্ট্রের জরুরি কাজে রাখেন বড় ভূমিকা। বিগত আমলে যারা এসব পদে ছিলেন, তাদের নামে অনিয়মের বিস্তর অভিযোগ ছিল। তাদের অনেকেই এখনো বহাল। এ ছাড়া বিগত আমলের নানা অনিয়মের বিষয়ে অন্তর্র্বর্তী সরকার উদ্যোগ নিলেও নির্বাচনে জালিয়াতিতে জড়িতরা এখনো শাস্তির আওতায় আসেননি।

×