
কঠোর আইন করেও থামানো যাচ্ছে না মানবপাচার
কঠোর আইন করেও থামানো যাচ্ছে না মানবপাচার। জীবিকার সন্ধানে দেশত্যাগী বেকার যুবকরা শুধু প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে নিঃস্বই হচ্ছেন না, জীবনও বিসর্জন দিচ্ছেন। ভূমধ্যসাগর থেকে সুদূর ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্র সর্বত্র যেন মানবপাচারকারীরা মৃত্যুফাঁদ গড়ে তুলেছে। এমন সর্বনাশা প্রতারণায় বার বার ঘুরে ফিরে আসছে কিছু রিক্রুটিং এজেন্সি ও দালালচক্রের নাম।
তারপরেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও তেমন কিছু করতে পারছে না। কিছু ঘটলে কিছুদিন সক্রিয় থাকে সংশ্লিষ্ট মহল। তারপর সেই আগের মতোই। বিচারহীনতার সংস্কৃতির দাপটেই থামানো যাচ্ছে না ্এ খাতের চিহ্নিত মানবপাচারকারীদের। এদের দৌরাত্ম্যের সর্বশেষ করুণ পরিণতি সর্বশেষ গত সপ্তাহে ভূমধ্যসাগরে। এতে প্রাণহাণি ঘটেছে ২৩ জনের।
এ নিয়ে গত এক যুগে শুধু ভূমধ্যসাগরেই সলিল সমাধি ঘটেছে অন্তত সাড়ে চারশ’ বাংলাদেশী বেকারের। যারা শুধু লিবিয়া থেকে নৌকায় ইতালি যাবার পথে ভূমধ্যসাগরে জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। এ ছাড়া অন্যান্য দেশে গিয়েও প্রতারিত হয়ে ফিরছেন বিপুলসংখ্যক প্রতারিত কর্মী। চুক্তি ও শর্ত মোতাবেক কাজ না পেয়ে দেশে ফিরতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকেই। সর্বশেষ আলজিরিয়া থেকেও এমন বিশজনকে দেশে ফিরতে হয়েছে।
তারা এখন ঢাকায় দেনদরবার করছেন-ক্ষতিপূরণ আদায়ের দাবিতে। দেশের একটি শক্তিশালী মানবপাচারকারী সিন্ডিকেট যুগের পর যুগ ধরে সক্রিয় থাকায় ভাগ্যান্বেষী বেকারদের বিপথগামী করছেন। এতে প্রাণ হারাচ্ছেন কেউ ভিটেবাড়িটুকুও শেষ করেছেন। এ অবস্থায় মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস উঠে গেছে জনশক্তি রপ্তানির এজেন্সিগুলো- তথা আদমবেপারিদের ওপর থেকে।
বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, যেভাবে গার্মেন্টস সেক্টরে দেশী বিদেশী শুকুনের নজর পড়েছে, যেভাবে ক্ষয়ের পথে এই খাত ঠিক একইভাবে হুমকির মুখে পড়ছে দেশের এই প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত। পরিস্থিতি কঠিনভাবে মোকাবিলা করা না হলে সামনের দিনগুলোতে চরম অন্ধকার নেমে আসবে।
প্রবাসী কল্যাণ, জনশক্তি রপ্তানি ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দেশের রিজার্ভ সামাল দেওয়া হচ্ছে এই খাতের অর্জিত মুদ্রায়। প্রবাসে প্রায় এক কোটি কর্মীর পাঠানো রেমিটেন্সেই দেশের অর্থনীতির চাকা সচল কিংবা রিজার্ভ সামাল দেওয়া হচ্ছে। অথচ নানা প্রতিকূলতা দরুন এই খাতও হুমকির মুখে পড়েছে।
জানা গেছে, শুধু ২০২৩ সালের জুন মাস থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৯ মাসে বিভিন্ন দেশে গিয়ে ছয় মাসের মধ্যেই আবার দেশে ফিরেছেন এমন কর্মীর সংখ্যা এক হাজার ৯২৬ জন। এর মধ্যে সৌদি আরব ফেরত ৭৭৬ জন, মালয়েশিয়া ২২১ জন, ওমান ২১৬ জন, দুবাই ১২২ জন, রুমানিয়া ৮৭ জন, কাতার ১২২ জন, আরব আমিরাত ৬৭ জন, কুয়েত ৭৪ জন, কিরগিজস্তান ৫২ জন, উজবেকিস্তান ৪৩ জন, কাজাখস্তান ২৮ জন ও সিঙ্গাপুর ফেরত ৮৭ জন।
এছাড়া ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত আউট পাস নিয়ে দেশে ফেরত এসেছেন ৪০ হাজার ৩০৫ কর্মী। বৈধ কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও কাজ না পাওয়া, চিকিৎসাবঞ্চিত ও প্রতারণার শিকার হয়ে বিভিন্ন দেশে কর্মী হিসেবে যাওয়ার ছয় মাসের মধ্যে দেশে ফিরেছেন এক হাজার ৯২৬ জন। তারা সবাই দালালের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব খুইয়েছেন।
এসব দালাল বা মানবপাচারকারীর যুগ যুগ ধরেই থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। মাঝে মাঝে কিছু দালাল র্যাব সিআইডি ডিবি গ্রেপ্তার করলেও তারা সহজেই জামিনে মুক্ত হয়ে ফের শুরু করে মানবপাচার।
জানা গেছে, কর্মসংস্থানের আশায় বেকার তরুণদের বিদেশে পাড়ি জমানোর প্রবণতা বাড়লেও প্রতারণার শিকার হয়ে অনেকে অসহায় অবস্থায় ফিরে আসছেন। সম্প্রতি একটি অভিযোগ নিয়ে হৈচৈ শুরু হয়েছে। ঢাকার একটি এজেন্সির মাধ্যমে আলজিরিয়ায় গিয়ে কজন শ্রমিক সেখানে কাজ করতে না পেরে দেশে ফিরে এসেছেন।
অথচ কাজের উদ্দেশ্যে গত বছরের ৬ জুন আলজিরিয়া যান ৪৩ জন শ্রমিক। ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড ভিশন নামের রিক্রুটিং এজেন্সি তাদের সেখানে পাঠায়। তাদের মধ্যে ২০ জন কাজ করতে না পেরে শূন্য হাতে গত ২১ জানুয়ারি দেশে ফিরে আসেন। পরদিন তারা প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রবাস সাপোর্ট সেন্টারে গিয়ে অভিযোগ করেন বিস্তর। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, আলজিরিয়ায় গিয়ে একমাস পাঁচদিন কাজ করার পর বলা হয়, হঠাৎ হুমকি দেওয়া হয় দেশে পাঠিয়ে দেওয়ার।
দেশে যাওয়ার ফিরতি টিকিটও করে আলমিনহা কোম্পানি। হঠাৎ এমন খবরে তারা সবাই হতভম্ব হয়ে পড়েন। ফোন করে বিষয়টি ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড ভিশন এজেন্সিকে জানান। এজেন্সি থেকে তাদের বলা হয়, তোমরা কাজ করতে থাক, কোনো সমস্যা হবে না।
প্রতারণার শিকার ঠাকুরগাঁওয়ের মো. জুয়েল বলেন, আমাদের ওপর হয়রানির শেষ নেই। সেখানে আট মাসে অনেক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে। ভার্চুয়াল এজেন্সির মালিক আমিনুল আমাদের আলজিরিয়ায় নিয়ে একবার একেক জায়গায় পাঠিয়েছেন। কিন্তু কোথাও আমাদের বৈধ হওয়ার জন্য ভিসা লাগাতে পারেননি। সেখানে তার ভারতীয় ও বাংলাদেশী এজেন্টও আছে।
একবার চাইনিজ কোম্পানি, আরেকবার ভারতীয় কোম্পানি। নানা জায়গায় পাঠিয়ে কোথাও কাজ করে টাকা পাইনি, ভিসাও পাইনি। আমাদের সঙ্গে যাওয়া আব্দুল্লাহ আল মামুন সেখানে কাজ করতে গিয়ে মারা যান। তার জন্য এজেন্সি দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা দেবে জানালেও দেয়নি। বরং এজেন্সি তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়।
এ সব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে ভার্চুয়াল ওয়াল্ডের মালিক মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, গত বছরের ১৪ মার্চ আলজিরিয়ার স্বনামধন্য একটি কোম্পানি থেকে কর্মী প্রেরণের জন্য চাহিদাপত্র গ্রহণ করি। সেখানকার ডেলিগেট ঢাকায় এসে সরাসরি সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে কর্মীদের বাছাই করার পর ভিসার জন্য পাসপোর্ট ও অন্যান্য কাগজপত্র জমা দেই।
ঢাকায় দূতাবাস থেকে ভিসা ইস্যুর জন্য বিএমইটি থেকে ক্লিয়ারেন্স নিয়ে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে দুদফায় ৪৩ জনকে পাঠানো হয়। তারা আলজিরিয়া যাবার আগে সবাই নিজেদের দক্ষ কর্মী বলে স্বীকারোক্তি দিয়ে নন জুডিসিয়াল স্ট্যাম্পে স্বাক্ষরও করেন। তারা সেখানে নিজেদের অদক্ষতার জন্য কাজ করতে ব্যর্থ হলে দেশে ফিরে কোন ধরনের ক্ষতিপূরণও দাবি করতে পারবে না বলে মুচলেকাও দিয়েছে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় তারা আলজিরিয়ায় গিয়ে নিজেদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব বা কাজ করতে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। এ নিয়ে শুরু হয় টাানাপোড়েন। তারপরও কোম্পানি তাদের লেবার কাজের সুযোগ দিলেও তারা কাজ না করে সেখানে আন্দোলন সংগ্রামের মতো কর্মসূচি দেয়। এতে ওই কোম্পানি বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে। তারপরও কোম্পানি বার বার তাদের কাজের সুযোগ দিলেও ওরা তাতে সাড়া না দিয়ে আন্দোলন করতে থাকে। একপর্যায়ে কোম্পানি তাদের বেতন-ভাতাদি ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধাসহ ৪০০ ইউরো প্রত্যেককে দিয়েছে।
শেষ পর্যন্ত কোম্পানির খরচে মাত্র ৯ জন দেশে ফিরে আসেন। বাকিরা আলজিরিয়ায় অন্য কোম্পানির মাধ্যমে কাজ করতে থাকে। সেখান থেকে আর ক’জন কর্র্মী কাজ না করে ইউরোপ প্রবেশের সব আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত ২০ জন কর্মী সেখানকার আইএমও- অফিসে সারেন্ডার করলে তাদের দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।
আমিন বলেন, দেশে ফেরার পরই তারা এখন নানরা ধরনের অপপ্রচার ও মিথ্যা অভিযোগে আমাদের ব্ল্যাকমেইল করে টাকা আদায়ের জন্য বিভিন্ন মহলে দেনদরবার করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সব দায় আমাদের ওপর চাপানোর চেষ্ট করছে। এত কিছুর পরও আমরা এ বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য কর্মী পাঠানো দেশীয় এজেন্টদের সঙ্গে ওদের নিয়ে বসার তারিখও ধার্য করা হয়। কিন্তু ওরা সেখানেও আসেনি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ওরা সেখানে কাজ না করে দেশে ফিরে আসায় আমার কোম্পানি বড় ধরনের আির্থক ক্ষতির মুখে পড়ে। তারপরও এজেন্টরা সেটা মেনে নিয়ে নিজেদের লভ্যাংশ ওদের ফেরত দিতে রাজি হয়েছে।
আমিনুল ইসলাম আরও বলেন, আট মাস বেতন পায়নি এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। কোম্পানি যদি আমার অ্যাকাউন্টে টাকা দিয়ে থাকে, তাহলে এসে চেক করুক আলজিরিয়া থেকে কোনো টাকা আমার কাছে দেশে আসছে কি না। প্রতি মাসের স্যালারির ডকুমেন্ট ওদের কোম্পানির কাছে আছে। ওদের যে কোম্পানিতে পাঠিয়েছি তারা চার মাস কাজ করে পালিয়ে গেছে। ইউরোপ যেতে চাইছে সেখান থেকে। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরছে। আর আমি সাড়ে চার লাখ করে নিইনি।
এ বিষয়ে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) যুগ্ম মহাসচিব ফখরুল ইসলাম বলেন, এমন ঘটনা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমাদের বায়রায় এখন কোনো কমিটি নেই। ফলে আমরা কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছি না। যেহেতু প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ হয়েছে, আশাকরি প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার একান্ত সচিব মো. সারওয়ার আলম বলেন, ভুক্তভোগীদের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। যে এজেন্সি থেকে তারা গিয়েছিলেন তাদের সঙ্গেও কথা হয়েছে। ভুক্তভোগীরা যেসব দালালকে টাকা দিয়েছেন ওই দালালদের থেকে টাকা উদ্ধারের দায়িত্ব এজেন্সিকে নিতে হবে।
এদিকে লিবিয়ার মাধ্যম ইতালিসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশে পাচারের মাধ্যমে অনেককে ঠেলে দেওয়া হয়েছে মৃত্যুফাঁদে। তাদেরই একজন কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার সুমন মিয়া (৪৩)। ইতালি যাবার পথে তার মৃত্যু হয়েছে। সুমন মিয়া ভৈরব উপজেলা সদরের লক্ষ্মীপুর এলাকার মাহমুদ হোসেনের ছেলে। পরে জানা গেছে, তার মতো একই পরিণতি ভোগ করেছে আরও কজন।
নিহতের পরিবার জানায়, চার মাস আগে ইতালি যেতে স্থানীয় এক দালালের মাধ্যমে লিবিয়ায় পাড়ি জমান সুমন। দেশের বাড়িতে তার স্ত্রী ও জমজ ছেলে-মেয়েসহ পরিবারে অন্য সদস্যরা রয়েছেন। গত ২৪ জানুয়ারি সেখান থেকে ২৫ জন মিলে একটি বোটে করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার সময় সুমনসহ আরও অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ ছাড়া যাত্রাপথে মাল্টা পৌঁছার পর বোটে সমস্যা দেখা দেয়। পরে সবাই বোট থেকে নেমে গেলেও সুমনকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।
সুমনের মৃত্যুর বিষয়টি চারদিন পর জানতে পারেন তার স্বজনরা। এরপর থেকে সুমনের পরিবারে চলছে শোকের মাতম। স্ত্রী পলি বেগম ও বোন শিল্পী বেগমসহ পরিবারের সদস্যরা সুমন মিয়ার মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকারের সহযোগিতা কামনা করেছেন।
মানব পাচারের আরও ভয়ঙ্কর ঘটনা ফাঁস হয়েছে রাশিয়ায় যুদ্ধক্ষেত্রে। সংসারে স্বচ্ছলতা আর সন্তানদের ভবিষ্যতের আশায় রাশিয়ায় পাড়ি জমিয়েছিলেন নাটোরের সিংড়ার হুমায়ুন কবির ও তার ভগ্নিপতি রহমত আলী। কিন্তু সেখানে চাকরির নামে অংশ নিতে হয়েছিল ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে। যেই যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন হুমায়ুন কবির। আর দুলাভাই রহমত আলী ফিরতে চান দেশে।
একমাত্র ছেলের মৃত্যু আর জামাইকে ফিরে পেতে অসহায় কারিমুন বেগমের চোখের পানি যেন শুকিয়ে গেছে। জানা গেছে, আডাই লাখ টাকা বেতন পাবেন প্রতিমাসে- দালালের এমন প্রলোভনে জমিজমা, স্ত্রীর গহনা বিক্রি করে এবং উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে গত বছরের ২৮ অক্টোবর ড্রিম হোম ট্রাভেল অ্যান্ড টুরস লিমিটেড নামের ঢাকার একটি কোম্পানির মাধ্যমে তারা পাড়ি জমিয়েছিল রাশিয়ায়।
সেখানে যাবার পর তাদের জোর করে বাধ্য করা হয রাশিয়া ইউক্রেনের চলা যুদ্ধে অংশ নিতে। ২৬ জানুযারি ড্রোন হামলায মৃত্যু হয় হুমায়ুন কবিরের। এখন স্বামীকে হারিয়ে এক বছরের মেয়ে প্রীতিকে নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যত হুমায়ুনের স্ত্রী তারা বেগমের। তিনি বলেন, স্বামীকে হারিয়ে আমি একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছি। আমার স্বামী স্বর্ণ বিক্রি করে, টাকা পয়সা গুছিয়ে বিদেশ গিয়েছিল। কিন্তু কোনো স্বপ্ন পূরণ হলো না।
সঙ্গে আমার ননদের জামাইও গিয়েছিল। সে বাঁচার জন্য বারবার ফোন করে আকুতি জানাচ্ছেন। কিন্তু আমরা দালালদের বললে তারা শুধু আশ্বাসে দিচ্ছেন, কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। আমি সরকারের কাছে দাবি করছি আমার স্বামীর লাশসহ ননদের জামাইকে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনা হোক।
রহমত আলীর স্ত্রী বলেন, হাসান নামে এক দালালের মাধ্যমে সাইপ্রাস যাওয়ার কথা হয় আমার স্বামী এবং ভাইদের সঙ্গে। কিন্তু তিনি সাইপ্রাসের ভিসা না দিয়ে বলেছেন রাশিয়া নিয়ে যাবেন। এর জন্য সৌদি আরবে গিয়ে দুই মাস থাকতে হবে, ওমরাহ করতে হবে। সেখান থেকে তাদের রাশিয়ার ভিসা দেবেন। আডাই লাখ টাকার বেতনের প্রলোভন দেখিয়ে তাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু রাশিয়া পৌঁছানোর পর সেখানকার দালাল তাদের বিক্রি করে দেয়।
এরপর সেখানে ট্রেনিং করিয়ে জোরপূর্বক যুদ্ধে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ইউক্রেন যুদ্ধে আমার একমাত্র ভাই মারা গেছে। আমার স্বামীর হাতের ওপর মারা গেছে আমার ভাই। আমার স্বামী ফোন দিয়ে কান্নাকাটি করে বলে, আমাকে বাঁচাও। আমরা এখন কি করব? কার কাছে বলব।
২৬ জানুযারি রাতে ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে পাঁচ দিন ধরে শুধু বিলাপ করে যাচ্ছেন হুমাযুন কবিরের মা কারিমুন। তিনি বলেন, আমার ছেলে তো মারাই গেছে, এখন জামাইটা যেন ফিরে আসে। ছেলের লাশটা যেন দেশে ফিরে আসে সরকারের কাছে সেই দাবি জানাই। হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের সহ-সভাপতি শাকিল আহম্মেদ তপুবলেন, ঘটনাটি জানার পর থেকেই আমরা পরিবারটির সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছি এবং তাদের পাশে রয়েছি। দায়ীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ এবং হুমায়ুন কবিরের মরদেহ এবং রহমত আলীকে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনার দাবি করছি।
জানা গেছে- ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা এরই মধ্যে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে বিষয়টি শ্রম ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টিতে এনেছেন। ঢাকা থেকে বিষয়টি রাশিয়ায় বাংলাদেশের শ্রম কল্যাণ উইংয়ে জানানো হয়েছে। উইংয়ের প্রথম সচিব মাজেদুর রহমান সরকার বলেন, প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব স্যারের মাধ্যমে বিষয়টি আমি জেনেছি। আমি রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি জানিয়েছি। তারা আবার তাদের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলাপ করে ব্যবস্থা নেবে। এটা বেশ লম্বা একটা প্রসেস।
জানা গেছে, এ ঘটনায় তোলপাড় দেখা দিয়েছে। এতে প্রশাসনের টনক নড়েছে। রাশিয়ায় মানব পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে ৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানী থেকে এক নারীকে গ্রেপ্তারের তথ্য দিয়েছে সিআইডি। এসএসপি জসীম উদ্দিন খান বলেন, নেপালে পালিয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে ঢাকার বিমানবন্দর এলাকা থেকে ফাবিহা জেরিন তামান্না নামের ওই নারীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তামান্না ‘ড্রিম হোম ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস লিমিটেড’ নামের একটি কোম্পানির অংশীদার। তিনি একটি মানব পাচার চক্রেরও সদস্য। চক্রটি রাশিয়ায় মাসে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা বেতনে কাজের প্রলোভনে দশ জনকে পাচার করেছে।
রাশিয়ার মানবপাচার চক্র সম্পর্কে জানা গেছে সিংড়া উপজেলার হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদটি স্থানীয়ভাবে খুবই শক্তিশালী। স্থানীয়দের নানা বিষয় নিয়েই সেটি কাজ করে। এলাকার মানুষের ভোটের মাধ্যমে এই সংগঠনটির নেতৃত্ব নির্বাচিত হয়। হুমায়ুন কবীর নিহত হওয়ার খবর পাওয়ার পর থেকেই সংগঠনটির চেয়ারম্যান আমিনুল ম-ল পরিবারটির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। তিনি বলেন, আমরা তাদের পাশে রয়েছি।
দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ এবং হুমায়ুন কবিরের মরদেহ এবং রহমত আলীকে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনার দাবি করছি। চৌগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে পালাতক। তার মোবাইল ফোনে বার বার কল করা হলেও তিনি তা ধরেননি। ঢাকার ড্রিম হোম ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরিজম লিমিটেডের মালিক হাসান আলীর একটি মোবাইল নম্বরে কল করলেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।
দালাল হিসেবে পরিচিত নওগাঁর আত্রাইয়ের শামীমকে মোবাইলে বার বার ফোন দিলেও তিনি ধরেননি। এসব অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে সাইপ্রাস প্রবাসী সাখাওয়াতের সঙ্গে যোগাযোগের কোনো মাধ্যম পাওয়া যায়নি।