ছবিঃ জনকণ্ঠ
নানা বাঁধা হুমকিধামকি আতংক পরিস্থিতি পেরিয়ে অবশেষে শান্তিপূর্ণভাবেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে তাবলীগ জামাতের সাদপন্থীদের বিশ্ব ইজতেমা। তাবলীগ জামাতের বিবদমান দুই গ্রুপ শুরায়ে নেজাম ও সাদপন্থীদের ইজতেমা আয়োজন ঘিরে নানা নাটকীয়তা ঘটেছে গত বেশকিছু দিন ধরে। অবশেষে শত সংকট কাটিয়ে সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় সাদপন্থীদের বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠান করতে যাচ্ছেন! কাল শুক্রবার থেকে শুরু হবে সাদপন্থীদের ৩ দিনব্যাপী বিশ্ব ইজতেমা।
শুরায়ে নেজামের মুখপত্র হাবিবুল্লাহ রায়হান জনকণ্ঠকে বলেছেন, ভবিষ্যতে সাদপন্হীরা টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে আর কোনো দিন বিশ্ব ইজতেমা করতে পারবে না এমন মুচলেকা দিয়েই ইজতেমা অনুষ্ঠান করছে। এবছর এটিই তাদের শেষ বিশ্ব ইজতেমা!
অপরদিকে সাদপন্থীদের মুখপত্র মোহাম্মদ সায়েম জনকণ্ঠকে বলেছেন, আমরা কোন শর্ত মেনে বা মুচলেকা দিয়ে ইজতেমা করছি না। শর্তহীনভাবে আমরা বিশ্ব ইজতেমা করছি। ভবিষ্যতে সাদপন্হীরা ইজতেমা অনুষ্ঠান করতে পারবে কি পারবে না সেটা ভবিষ্যতে দেখার বিষয়। মোহাম্মদ সায়েম বলেন, সাদপন্হীরা আদি তাবলীগ জামাত। তাবলীগের ছয় উছুল বিশ্বের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে সাদ অনুসারীরা কাজ করে যাচ্ছে।
টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা মাঠে শুরায়ে নেজাম, সাদপন্হীদের জোড় ইজতেমা অনুষ্ঠান করতে না দেওয়ার ঘোষণায় ১৮ ডিসেম্বর ভোররাতে ইজতেমা ময়দানে হামলা সংঘর্ষে উভয় পক্ষে ৪ মুসল্লী নিহত ও শতাধিক আহতে মামলা মোকদ্দমা শীর্ষ মুরুব্বিদের গ্রেপ্তারে দু'পক্ষ আরো মারমুখী অবস্থানে চলে যায়। সাদপন্হীদের বিশ্ব ইজতেমা করতে না দেওয়ার দৃঢ় পদক্ষেপ নেয় শুরায়ে নেজাম।
সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ঘোষণা আসে শুরায়ে নেজাম ইজতেমা করবে ৩১ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আর ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি করবে সাদপন্হীরা। শুরায়ে নেজাম সাদপন্হীদের ইজতেমা করতে না দিতে দুপর্বের বিশ্ব ইজতেমা শুরায়ে নেজাম এককভাবে অনুষ্ঠান করতে ৩১ জানুয়ারি থেকে দুই ধাপে একটানা ৬দিন ইজতেমা করার ঘোষণা দিয়ে তা বাস্তবায়ন করে। এমন পরিস্থিতিতে সাদপন্হীরা তাদের পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারি ইজতেমা অনুষ্ঠানে অনড় থাকলে প্রশাসনও শেষমেশ সাদপন্হীদের ঘোষিত তারিখ অনুযায়ী ইজতেমা অনুষ্ঠানে প্রস্তুতি নেয়।
টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানে শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া তাবলীগ জামাতের সাদপন্হীদের ৩ দিনব্যাপী বিশ্ব ইজতেমায় মুসল্লীরা আসতে শুরু করেছেন। রবিবার সাদপন্হীদের আখেরী মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে ২০২৫ সালের বিশ্ব ইজতেমা। সাদপন্থীদের বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠানে মুসল্লীদের জন্য ইজতেমা মাঠ এখন পুরোপুরি প্রস্তুত। আয়োজকরা আশা করছেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ দেশবিদেশের লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ সাদপন্হী অনুসারী মুসল্লী তাদের বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দেবেন।
এর আগে ৩১ জানুয়ারি থেকে দুই ধাপে টানা ৬দিন বিশ্ব ইজতেমার অনুষ্ঠান আয়োজন করে শুরায়ে নেজাম তথা জোবায়ের গ্রুপ। তাবলীগ জামাতের বিবদমান দুই গ্রুপের গন্ডগোলে এমন ভাগাভাগির ইজতেমার আয়োজন এবার। ভাগাভাগির ইজতেমায় সাধারণ মুসল্লীরা দুই পক্ষের উপরই এখন ত্যাক্তবিরক্ত। টঙ্গী গাজীপুর সিটির স্হানীয় বাসিন্দাদের দাবি, দীর্ঘ সময় ধরে চলা দলাদলি মারামারি কাটাকাটি রেষারেষি হামলা সংঘর্ষের বিশ্ব ইজতেমা মিলেমিশে একসাথে একবার একপর্বে অনুষ্ঠানের। নাগরিকরা বলছেন, টঙ্গীতে যতদিন ইজতেমা অনুষ্ঠান হয়ে থাকে তত দিনের ইজতেমা শুরুর আগে পরেসহ প্রায় ১৩ দিন টঙ্গীর রাস্তাঘাটে অচলাবস্থা দেখা দিচ্ছে এবার। বিবদমান দুগ্রুপের আলাদা ইজতেমা আয়োজনে থমকে যায় স্কুল কলেজে ছাত্র ছাত্রীদের যাওয়া আসা, গতি থেমে যায় কর্মজীবীদের! নানা উদ্বেগ উৎকন্ঠা বিরাজ করে সারাক্ষণ!
রাজধানী ঢাকার জিরো পয়েন্ট থেকে ২২ কিলোমিটার উত্তরে টঙ্গী তুরাগ নদীর তীরে বিশ্ব ইজতেমার এ বিশাল আয়োজন। সম্প্রতি ইজতেমা ময়দানে সাদপন্হীদের জোড় ইজতেমা করতে না দেওয়ার ঘোষণায় শুরায়ে নেজাম-সাদ গ্রুপের হামলা সংঘর্ষে ৪ মুসল্লী নিহত ও শতাধিক আহতের ঘটনার শংকা কাটিয়ে সাদপন্থী মুসল্লীরা বৃহস্পতিবার বিকাল থেকেই দলে দলে ইজতেমা ময়দানে আসা শুরু করবেন। আয়োজকরা আশা করছেন মুসল্লীদের ভীড়ে ইজতেমা শুরুর আগের রাতেই মাঠ কানায় কানায় পূর্ন হয়ে যাবে।
তাবলীগ জামাতের সাদপন্হীদের অন্যতম মিডিয়া সমন্বয়ক মোহাম্মদ সায়েম জনকণ্ঠকে বলেছেন, টঙ্গী ইজতেমা ময়দানে নিজামুদ্দিনের অনুসারী (মাওলানা সাদ সাহেবের অনুসারীদের) ইজতেমার প্রস্তুতি শেষ। বুধবার রাতে দিল্লি নিজামউদ্দিন থেকে মুরুব্বিদের জামাত ময়দানে এসে পৌঁছেছে। পাকিস্তান থেকে ইতিমধ্যে এক জামাত ময়দানে অবস্থান করছে। বিশ্বের প্রায় অর্ধেক দেশের ১০ হাজার তাবলীগ অনুসারী মুসল্লী মাওলানা সাদ সাহেবের বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দেবেন বলে সাদপন্হীদের মিডিয়া সমন্বয়ক মোহাম্মদ সায়েম জনকণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন। বৃহস্পতিবার বাদ ফজর-জোহর সাধারণ সাথীদের উদ্দেশ্যে হেদায়েত বয়ান শুরু হবে। শুক্রবার থেকে ৩দিনের ইজতেমা শুরু হলেও বৃহস্পতিবার বাদ আছর থেকেই ইজতেমার আম বয়ান শুরু হবে।
গাজীপুর মহানগর পুলিশের পুলিশ কমিশনার ডক্টর মোহাম্মদ নাজমুল করিম খান সাংবাদিকদের বলেছেন, সাদপন্হীদের বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠানেও ব্যাপক নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়েছে। শান্তিপূর্ণ ইজতেমা অনুষ্ঠানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সকল নিরাপত্তা ব্যবস্হা প্রস্তুত। ইজতেমা ঘিরে কোনো নাশকতার আশংকা নাই, কেউ কোন নাশকতা করতে পারবে না।
বৃহস্পতিবার বাদ ফজর সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে এক বর্গ কিলোমিটারের বিশ্ব ইজতেমা ময়দানের উত্তর পশ্চিম কোণে বিদেশি মেহমানদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ময়দানের পশ্চিম পাশে নির্মাণ করা হয়েছে বয়ান মঞ্চ। সরকারিভাবে টয়লেট গোসলখানা ও খাবার পানির ব্যবস্হা করা হয়েছে মাঠের চারপাশে। পুরো মাঠ জুড়ে শব্দ প্রতিরোধক ছাতা মাইক লাগানো হয়েছে।
মুসল্লীদের তুরাগ নদী পারাপারে ময়দানের পশ্চিম পাশে কামারপাড়া ব্রিজ থেকে টঙ্গী ব্রিজ পর্যন্ত তুরাগ নদীতে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সদস্যরা পাঁচটি ভাসমান সেতু নির্মাণ করেছেন। এছাড়াও ফেরিঘাটের জেটি দিয়ে অপর একটি পন্টুন সেতু তৈরি করেছে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে ময়দানের চারপাশে পুলিশ ও র্যাবের পক্ষ থেকে নির্মাণ করা হয়েছে ওয়াচ টাওয়ার। পুরো ইজতেমা ময়দানকে আগের মতো ৩৩৫টি সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়েছে। ইজতেমায় এবারও ড্রোন দিয়ে পর্যবেক্ষণ করার ব্যবস্হা নেয়া হয়েছে। এছাড়া র্যাবের হেলিকপ্টার আকাশপথে টহল এবং নৌপুলিশের সদস্যরা তুরাগ নদীতে স্পিড বোট দিয়ে টহল দেবেন।
ইজতেমা ময়দানের আশপাশে বিশটি চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। ওয়াচ টাওয়ার থেকে বাইনোকুলার এর মাধ্যমে গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হবে। ইজতেমা ময়দানের অভ্যন্তরে প্রতিটি খিত্তায় সাদা পোশাকে পুলিশ সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করবেন। টঙ্গী টেশিস মাঠে পুলিশের কন্ট্রোল রুম এবং মন্নু টেক্সটাইল কম্পাউন্ডে র্যাবের ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কন্ট্রোল রুম স্হাপন করা হয়েছে। বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ বিতরণে মন্নু টেক্সটাইল কম্পাউন্ডে থাকছে দেশের নানা স্হান থেকে আসা নানা স্বেচ্ছাসেবী স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান।
তাবলীগ জামাতের শীর্ষ মুরুব্বিরা জনকণ্ঠকে বলেছেন, বিশ্ব ইজতেমার ইতিহাসে এবারই প্রথম শবে বরাতের পূন্যময় রজনীতে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ইজতেমা শুরুর দিন বিশ্ব ইজতেমার প্রথম রজনী শবেবারত হওয়ায় মুসল্লীদের মাঝে বাড়তি আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাই এবারের ইজতেমা আরও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক হতে যাচ্ছে৷ এ বিষয়ে জামিয়া কাশিফুল উলুম ঢাকার মহাপরিচালক বিশিষ্ট আলেমেদ্বীন ও গবেষক মাওলানা সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ বলেন, এমন পবিত্র ও বরকতময় মর্যাদাপূর্ন রাতে বিশ্ব ইজতেমার মতো বৃহৎ ইসলামী জমায়েতের আয়োজন নিঃসন্দেহে এক অনন্য ও ঐতিহাসিক ঘটনা।
এই রাতের ফজিলতের কারণে এবারের ইজতেমা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও আধ্যাত্মিক বরকতে ভরপুর হবে। এ রাতে মুসলীম উম্মাহর জন্য লাখ লাখ মানুষ আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করবেন এই ময়দানে সমবেত হয়ে। তিনি বলেন, শবে বরাত ইসলামের বরকতময় রাতগুলোর মধ্যে অন্যতম, যেখানে বান্দাবান্দিদের জন্য আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে বিশেষ রহমত ও মাগফিরাতের দরজা উন্মুক্ত হয়। হাদিস শরিফে শবে বরাতের রাতকে গুনাহ থেকে মুক্তি, তাকদির নির্ধারণ এবং দোয়া কবুলের রাত হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। বান্দার এক বছরে ভাগ্য নির্ধারন করা হয় শবেবরাতের রজনীতে। বান্দার গুনাহ মাফ ও আশা পূর্ণ করা হয়।
এই রাত মুসলমানদের কাছে বিশেষ সম্নান ও মর্যাদার। সেই সাথে বিশ্ব ইজতেমায় রাতে ঈমান আমলের বয়ান শুনে মুসলমানরা নিজেদেরকে আরো পূত-পবিত্র করে তুলবেন। সাদপন্থীদের মিডিয়া মুখপত্র মোহাম্মদ সায়েম জনকণ্ঠকে বলেন, শবে বরাতের রাতে মুসল্লীরা দেশ জাতি ও মুসলিম উম্মাহর শান্তি কল্যান কামনা করে বিশেষ দোয়ার আয়োজন থাকছে এবারের বিশ্ব ইজতেমায়। সবকিছু মিলিয়ে সাদপন্থীদের এবারের বিশ্ব ইজতেমা বরকত আর রহমতে ভরপুর থাকবে।
জাফরান
