![বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লব নিয়ে জাতিসংঘের বিস্ফোরক প্রতিবেদনের ৮টি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লব নিয়ে জাতিসংঘের বিস্ফোরক প্রতিবেদনের ৮টি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য](https://www.dailyjanakantha.com/media/imgAll/2024April/3-24-2502121904.jpg)
জাতিসংঘের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লবের ঘটনাবলি নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এই প্রতিবেদনে ভয়াবহ নির্যাতন, হত্যাকাণ্ড ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিশদ বিবরণ উঠে এসেছে। এখানে উল্লেখযোগ্য ৮টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরা হলো:
১. মৃত্যুর সংখ্যা:প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুলাই বিপ্লবে কমপক্ষে ১,৪০০ জন নিহত হয়েছেন এবং ১২-১৩% ভুক্তভোগী শিশু। হাজার হাজার মানুষ স্থায়ী শারীরিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন। নিরাপত্তা বাহিনী শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর পয়েন্ট-ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে গুলি চালিয়েছে। সাংবাদিকদের টার্গেট করে হত্যা করা হয়েছে এবং কমপক্ষে ২০০ জন সাংবাদিক আহত হয়েছেন।
২. মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণ:প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের দ্বারা সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের অনেকগুলো মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের সংজ্ঞায় পড়ে, যা রোম স্ট্যাটিউটের ৭ নং অনুচ্ছেদ অনুসারে অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের সরাসরি হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি চালানো হয়েছে, যা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের ইঙ্গিত দেয়।
৩. অপরাধীদের পরিচয়:প্রতিবেদনটি চিহ্নিত করেছে যে, কমপক্ষে সাতটি নিরাপত্তা বাহিনী সম্মিলিতভাবে এই দমন-পীড়নের সাথে জড়িত ছিল। এদের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই), ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স (এনএসআই) এবং গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো অবৈধ নজরদারি, আহতদের চিকিৎসা পেতে বাধা প্রদান এবং ছাত্রনেতাদের গুমের সাথে জড়িত ছিল। এছাড়াও, ছাত্রলীগকে বিক্ষোভকারীদের দমন করতে সংগঠিতভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। তারা পুলিশের সাথে যৌথভাবে লাঠি, দা এবং আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে হামলা চালিয়েছে।
৪. নারী বিক্ষোভকারীদের টার্গেট করা:প্রতিবেদনটি নারীদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত যৌন সহিংসতার বিষয়টি তুলে ধরেছে, যা নিরাপত্তা বাহিনী ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভরত নারীদের মারধর, যৌন হয়রানি এবং ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনে। আটক অবস্থায় নারী বিক্ষোভকারীদের শারীরিক ও যৌন নির্যাতন করা হয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ আক্রমণ করা হয়েছিল।
৫. চিকিৎসা সেবা ব্যাহত করা ও তথ্য গোপন করা:প্রতিবেদনটি জানিয়েছে যে, নিরাপত্তা বাহিনী আহত বিক্ষোভকারীদের চিকিৎসায় বাধা প্রদান করেছে। পুলিশ, র্যাব, ডিজিএফআই এবং এনএসআইয়ের সদস্যরা হাসপাতালে অবস্থান নিয়ে চিকিৎসকদের ভয় দেখিয়েছে এবং আহতদের চিকিৎসা না দিতে চাপ সৃষ্টি করেছে। চিকিৎসা প্রতিবন্ধকতা ও ভুল রিপোর্ট তৈরির ঘটনা ঘটেছে, যা রাষ্ট্রীয় সহিংসতার প্রমাণ ধামাচাপা দেওয়ার উদ্দেশ্যে ছিল।
৬. নজরদারি ও ইন্টারনেট বন্ধের কৌশল:প্রতিবেদনটি জানিয়েছে যে বাংলাদেশে গোয়েন্দা সংস্থাগুলি-ডিজিএফআই, এনএসআই এবং এনটিএমসি-বিক্ষোভ দমন করতে ব্যাপক নজরদারি, ভীতিপ্রদর্শন এবং যোগাযোগ বিঘ্নিত করার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই সংস্থাগুলি ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট বাস্তবায়ন করেছে এবং বিক্ষোভকারীদের সংগঠিত হওয়ার ক্ষমতা ব্যাহত করেছে।
৭. সেনাবাহিনীর দ্বৈত ভূমিকা:প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে যে সেনাবাহিনী দ্বৈত ভূমিকা পালন করেছে—প্রথমে রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে এবং পরবর্তীতে শেখ হাসিনার শাসন শেষ করতে এবং ক্ষমতার হস্তান্তর করতে একটি সিদ্ধান্তমূলক ভূমিকা পালন করেছে। সেনাবাহিনী ২০ জুলাই ২০২৪ তারিখে পুলিশ, র্যাব এবং বিজিবি’র সাথে যৌথভাবে সহিংস দমন অভিযান চালাতে নিয়োগ দেওয়া হয়। সেনারা বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে সরাসরি গুলি চালায়, যার ফলে অযথা হত্যাকাণ্ড ঘটে, এবং তারা ব্যাপক ধরপাকড় ও অভিযান পরিচালনায় সহায়তা করে।
প্রাক্তন সিনিয়র কর্মকর্তাদের সাক্ষ্য অনুযায়ী, সেনাবাহিনী হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জানতো, তবে সেগুলি প্রতিরোধে কিছুই করেনি। ফরেনসিক পরীক্ষাগুলি দেখায় যে, ৬৬% মৃত্যুর ঘটনা সেনাবাহিনীর গ্রেডের রাইফেল (৭.৬২x৩৯মিমি গোলাবারুদ) দ্বারা ঘটেছে, যা শুধুমাত্র সেনাবাহিনী, র্যাব এবং বিজিবির কাছে রয়েছে। বর্মভেদী গোলাবারুদ ব্যবহার করার প্রমাণ পাওয়া গেছে, যা নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিল, এবং এই ধরনের অস্ত্র পুলিশের হাতে বা সাধারণ মানুষের কাছে নেই। ফরেনসিক এবং বলিস্টিক বিশ্লেষণে পাওয়া গুলি এবং ক্ষতগুলি সেনাবাহিনীর রাইফেলগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত।
আগস্টের প্রথম দিকে সেনাবাহিনীর মধ্যে অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়, এবং জুনিয়র কর্মকর্তারা বেসামরিক নাগরিকদের উপর গুলি চালাতে অস্বীকৃতি জানায়। ৫ আগস্ট, যখন হাজার হাজার বিক্ষোভকারী ঢাকা অভিমুখে marcha করতে থাকে, তখন সেনাবাহিনী ও বিজিবি তাদের পথ রোধ করার পরিবর্তে তাদের বসে যায়। এই পরিস্থিতি শেখ হাসিনাকে ঢাকা থেকে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে সরিয়ে নেওয়ার দিকে নিয়ে যায়, যা তার শাসনের অবসান ঘটায়।
৮. পরবর্তী প্রতিশোধমূলক সহিংসতা:প্রতিবেদন অনুযায়ী, সরকার পতনের পর প্রতিশোধমূলক সহিংসতা ও নিপীড়ন হয়েছে, যেখানে আওয়ামী লীগ সমর্থক, পুলিশ ও সংবাদমাধ্যমের সদস্যদের লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে। এছাড়া হিন্দু সম্প্রদায়, আহমদিয়া মুসলিম এবং চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চলের আদিবাসীদের উপর আক্রমণ করা হয়েছে এবং তাদের বাড়ি ও মন্দির পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। নতুন অন্তর্বর্তী সরকার প্রক্রিয়া শুরু করেছে, তবে বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং ভয়ভীতির কারণে চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে।
সূত্র: https://tinyurl.com/yn38hjvb
https://tinyurl.com/4jd4utpf
আফরোজা