ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৩০ মাঘ ১৪৩১

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো...

মনোয়ার হোসেন

প্রকাশিত: ২৩:২৮, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো...

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনকে দমিয়ে রাখতে নানা কৌশল

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনকে দমিয়ে রাখতে নানা কৌশল অবলম্বন করেছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। একুশে ফেব্রুয়ারির কর্মসূচিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিতে জারি করেছিল ১৪৪ ধারা।  কিন্তু  মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার দ্রোহের আগুনে জ্বলে উঠেছিল বাংলা মায়ের সন্তানেরা। সেই সুবাদে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে ১৪৪ ধারা না ভাঙার সিদ্ধান্তকে অগ্রাহ্য করেছিল ভাষাসংগ্রামীরা। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রক্ষা করেছিল মায়ের ভাষার মর্যাদা।      
মূলত তিনটি পক্ষ ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। সাধারণ ছাত্রদের সঙ্গী করে যুবলীগ নেতা-কর্মীসহ কয়েকজন সাহসী ছাত্র নেতা অগ্রাহ্য করেছিল দলীয় সিদ্ধান্তকে। আন্দোলনের রাশ টেনে ধরতে আওয়ামী মুসলিম লীগ ও গুপ্ত কমিউনিস্ট পার্টির  গৃহীত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলনের আকাক্সক্ষা  ভেস্তে গিয়েছিল।

বায়ান্নর ২০ ও ২১ ফেব্রুয়ারির গভীর রাতে ফজলুল হক হল ও ঢাকা হলের (বর্তমানে শহীদুল্লাহ হল) মধ্যবর্তী পুকুরপাড়ে রচিত হয়েছিল নতুন ইতিহাস। সেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, যে কোনো মূল্যেই হোক ভাঙা হবে ১৪৪ ধারা। সেজন্য কিছু কৌশল অবলম্বনের সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছিল।

যেহেতু আওয়ামী মুসলিম লীগ  ছিল ১৪৪ ধারা ভাঙার বিপক্ষে এবং পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের একুশে ফেব্রুয়ারির ছাত্রসভায় সভাপতিত্ব করলে ১৪৪ ধারা ভাঙার বিরুদ্ধে মত দিতে পারেন  তাই গাজীউল হককেই আমতলার সভায় সভাপতিত্ব করার সিদ্ধান্ত হয়। তিনি যদি সভার আগেই গ্রেপ্তার হন সেক্ষেত্রে এম আর আখতার মুকুল সভাপতিত্ব করবেন। আবার তিনিও গ্রেপ্তার হলে সভাপতিত্ব করবেন কমরুদ্দিন শহুদ।
বশীর আল্্হেলালের ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ গ্রন্থে উঠে এসেছে সেদিনের ঘটনার প্রকৃত চিত্র। সেখানে পুকুরপাড়ের ওই বৈঠকের বর্ণনায় মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেছেন, ‘২০ ফেব্রুয়ারির সন্ধ্যাটা আমার কাছে খুব থমথমে মনে হয়েছিল। কিরকম একটা বিপদ-সংকেতের মতো শোনাচ্ছিল সরকারী গাড়ি থেকে ১৪৪ ধারা জারির সংবাদ-পরিবেশনটি। যখন শুনলাম সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিপক্ষে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তখন আমরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হই। ...

রাত ন’টা-দশটার সময় আমরা সাত আটজন বন্ধুবান্ধব মিলিত হই ফজলুল হক হলের পূর্ব পাড়ে। যতদূর মনে পড়ে সেখানে মুহম্মদ সুলতান, আবদুল মমিন, জিল্লুর রহমান, কামরুদ্দিন শহুদ, গাজীউল হক, আনোয়ারুল হক খান ও এম আর আখতার মুকুল উপস্থিত ছিলেন। অনেক পরে শুনেছি যে, ওই বৈঠকে একজন গুপ্তচরও উপস্থিত ছিলেন। আমি এখন তার চেহারা মনে করতে পারছি না।’
অন্যদিকে গাজীউল হক বলেছেন, ওই বৈঠকে ১১জন উপস্থিত ছিলেন। তিনি এ ছাড়া অন্য যেসব নাম বলেছেন সেগুলো হলো এস এ বারী, এটি মশিয়ুর রহমান, আনোয়ার হোসেন। তিনিও একজনের নাম মনে করতে পারেননি। এ ছাড়া তিনি জানিয়েছেন বৈঠকটি রাত প্রায় বারটার দিকে হয়েছিল।
এম আর আখতার মুকুল অসতর্কভাবে দুটি নাম বলেছেন আহমদ রফিক ও অলি আহাদ। তবে অলি আহাদ জানিয়েছেন তিনি সেখানে ছিলেন না। মুহম্মদ সুলতানও ১১ জনের কথা বলেছেন এবং অন্যের তালিকায় নেই এমন একটা নাম বলেছেন তিনি কে জি মোস্তফা।
১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে নাÑসর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে সভা শেষে বেরিয়ে আসেন অলি আহাদ। এ সময় তার সঙ্গে দেখা হয় জগন্নাথ কলেজের ছাত্র ও যুবলীগ কর্মী নেয়ামাল বাসির ও তার সঙ্গীদের সঙ্গে। অলি আহাদ তাদের সুশৃঙ্খলভাবে একুশে ফেব্রুয়ারি ভোরবেলা ঢাকা বিশ্বদ্যিালয় কলাবিভাগ প্রাঙ্গণে উপস্থিত হয়ার নির্দেশ  দেন।  

সেদিন গভীর রাতে যুবলীগের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক ও অনাবাসিক কর্মী ৪৩/১ যোগীনগরে যুবলীগ কার্যালয়ে অলি আহাদের সঙ্গে দেখা করেন। ঢাকার নানা এলাকার যুবলীগ কর্মীরাও এসেছিলেন নির্দেশ জানতে।
প্রকৃতপক্ষে ১৪৪ ধারা জারির মাধ্যমে ছাত্রদের দ্রোহী চৈতন্যে চরমভাবে আঘাত করেছিল তৎকালীন সরকার। তাদের সেই অপমানের জ্বালা তীব্র খরতাপ ছড়িয়েছিল বসন্তের বাতাসে। তাই পলাশের রং মাখা ফাগুনে ভাষার দাবিতে উত্তপ্ত হৃদয়ের বহ্নিশিখায় প্রজ্বলিত হয়ে  সবাই নেমেছিল রাজপথে।

আরো পড়ুন  

×