প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুম করে আটকে রাখার গোপন বন্দিশালা ‘আয়নাঘর’ পরিদর্শন করেন। এ সময় কয়েকজন উপদেষ্টা উপস্
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার দেশে ‘আইয়ামে জাহেলিয়া (অন্ধকার যুগ)’ প্রতিষ্ঠা করেছিল উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘আইয়ামে জাহেলিয়া বলে একটা কথা আছে না! গত সরকার আইয়ামে জাহেলিয়া প্রতিষ্ঠা করে গেছে। এটা (গোপন বন্দিশালা) তার একটি নমুনা। এটা বীভৎস দৃশ্য।
বুধবার রাজধানীর তিনটি স্পটে বহুল আলোচিত ‘আয়নাঘর’ পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘এটা বীভৎস দৃশ্য। মানুষের মনুষ্যত্ববোধ বলতে কোনো জিনিস আছে, সেটা থেকে বহু গভীরে নিয়ে গেছে তা (মনুষ্যত্ব) নিশ্চিহ্ন করার জন্য। নৃশংস অবস্থা, প্রতিটি জিনিস এখানে হয়েছে। যতটুকু শুনেছি, এটা অবিশ্বাস্য মনে হয়। এটা কি আমাদেরই জগৎ? আমাদেরই সমাজ?’
বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর আগারগাঁও, কচুক্ষেত ও উত্তরা এলাকায় তিনটি স্পট পরিদর্শন করেন প্রধান উপদেষ্টা। ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিত এই স্পটগুলো আগে ‘নির্যাতন সেল’ এবং ‘গোপন কারাগার’ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এ সময় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সদস্য, দেশী-বিদেশী গণমাধ্যমকর্মী ও ভুক্তভোগীরা উপস্থিত ছিলেন।
এ সময় ভুক্তভোগীরা নির্যাতনের ভয়াবহতার প্রতীক হিসেবে কচুক্ষেত বন্দিশালার দেওয়ালগুলো দেখান। এ ছাড়া আগারগাঁও বন্দিশালায় একটি ইলেক্ট্রিক চেয়ার দেখানো হয় প্রধান উপদেষ্টাকে। শেখ হাসিনার শাসনামলে এসব গোপন বন্দিশালায় জিজ্ঞাসাবাদের নামে আটক ব্যক্তিদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন চালানো হতো।
পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে প্রধান উপদেষ্টা এসব ‘নির্যাতন সেল’ এবং ‘গোপন কারাগারের’ ভুক্তভোগীদের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘যারাই নিগৃহীত হয়েছেন, যারা এটার শিকার হয়েছেন; তারাও আমাদের সঙ্গে আছেন। তাদের মুখ থেকেই শুনলাম- কীভাবে হয়েছে। কোনো ব্যাখ্যা নেই। বিনা কারণে রাস্তা থেকে উঠিয়ে আনা হলো, বিনা দোষে কতগুলো সাক্ষী তৈরি করে কোনো একটা ঘটনায় ঢুকিয়ে দিয়ে বলা হলো-তুমি সন্ত্রাসী, জঙ্গি। এগুলো বলে বলে তাকে নিয়ে আসা হয়েছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘এ ধরনের ইন্টারোগেশন সেল, টর্চার সেল দেশজুড়ে আছে, সেটা শুনলাম আজকে। আমার ধারণা ছিল, এই আয়নাঘর শুধু এখানেই (রাজধানীতে) যে কয়েকটা আছে। এরপর আজ শুনলাম এগুলোর বিভিন্ন ভার্সন সারাদেশে আছে। কেউ বলছেন ৭০০, কেউ বলছেন ৮০০; সংখ্যাও নিরূপণ করা যায়নি, কতটা আছে। এরমধ্যে কতগুলো জানা আছে, কতগুলো অজানা।’
মানুষকে সামান্যতম মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘একজন বলছিলেন, খুপরির মধ্যে রাখা হয়েছে। এর থেকে তো মুরগির খাঁচাও বড় হয়। বছরের পর বছর এভাবে রাখা হয়েছে। এসব থেকে বের করে না আনা গেলে, সমাজ টিকবে না’ বলেও মন্তব্য করেন প্রধান উপদেষ্টা। নতুন সমাজ গড়া, অপরাধীদের বিচার করা ও প্রমাণ রক্ষার ওপর জোর দেন তিনি।
গুমের শিকার ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ন্যায়বিচার যেন পায়, সেটা এখন প্রাধান্য। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা নতুন বাংলাদেশ ও নতুন পরিবেশ গড়তে চাই। সরকার সে লক্ষ্যে বিভিন্ন কমিশন করেছে। যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, তার পুনরাবৃত্তি যেন না হয়, সরকার সে লক্ষ্যে কাজ করবে।’
গুম কমিশনকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘তারা বহু কষ্ট করেছে। অন্যান্য কমিশন তো করেছে অন্তত তারা নিজেদের ঘরে বসে করতে পেরেছে। গুম কমিশনকে এগুলো বের করে আনতে হয়েছে। কিসের মধ্যে ঢুকিয়েছিল, কারা কি করেছে, এখনো ধ্বংসাবশেষ।’
‘আয়নাঘর’কে দেশের চূড়ান্ত অবনতির প্রতিচ্ছবি বলে বর্ণনা করে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘গুম কমিশন যেটা আমাদের সামনে নিয়ে আসল, সেটা হলো কী পরিমাণে একটা দেশকে সবদিকে ধ্বংস করা যায়, এমনকি মানুষের সামান্যতম মানবিক অধিকার, সেটুকু থেকে বঞ্চিত করে রেখে দেওয়া হয়েছে। আজকে এটা জাতির জন্য একটা বড় চূড়ান্ত রকমের ডকুমেন্ট হবে। আপনাদের সাক্ষী রেখে, আপনাদেরকে নিয়ে এসে আমরাও শরিক হলাম।’
তিনি বলেন, ‘আজকে আমরা মুক্ত হলাম। এ মুক্ত বাংলাদেশে আমরা যেন নতুন করে আবার সমাজ গড়তে পারি, এটার থেকে অতি দূরে যেন আমরা চলে যেতে পারি। এটার নমুনা, এটার সাক্ষী, এটার ডকুমেন্টেশন গুম কমিশনের রিপোর্টের মধ্যে থাকবে এবং এটা অবশ্য পাঠ্য হিসেবে সবাইকে পড়তে হবে এবং যারা করেছে তাদের বিচার করতে হবে, তা না হলে আমরা নিষ্কৃতি পাব না এটা থেকে। আমাদের আবেদন দেশের সবার কাছে, এ বিচারটা যেন করতে পারি।’
‘আয়নাঘর’ ও এর আনুষঙ্গিক সামগ্রী প্রমাণ হিসেবে সিলগালা করে রাখা হবে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বিচারের কাজে যেন প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা দেখছি যে ন্যায়বিচারটা তার যেন হয়, অতি তাড়াতাড়ি হয়। বিচার দীর্ঘসূত্রতায় পড়ে থাকবে, সে যেন নিষ্কৃতি পায়, এটা আমাদের ফার্স্ট প্রেফারেন্স।’
এ ধরনের ঘটনার যাতে কোনো পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেটাই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিজ্ঞা উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এই সরকারের অস্তিত্ব এটার কারণেই। আমরা অন্ধকারে থাকতে চাই না, যেটা আমাদের চারপাশে গড়ে তোলা হয়েছিল।
আমরা নতুন পরিবেশ তৈরি করতে চাই, নতুন বাংলাদেশ গঠন করতে চাই। গুম কমিশন আমাদের এগুলো দেখিয়েছে। যদি আমাদের এ কমিশন না থাকত তাহলে এটি একটি গল্পই থাকত, এখন আমাদের হাতে প্রমাণ আছে। এটা প্রথম পদক্ষেপ।’
এ সময় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ছিলেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম এবং স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া প্রমুখ।