![আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো... আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো...](https://www.dailyjanakantha.com/media/imgAll/2024April/21-February-2502111716.jpg)
অজস্র দিনের মধ্যে জ্বলেছে একুশে ফেব্রুয়ারি
অজস্র দিনের মধ্যে জ্বলেছে একুশে ফেব্রুয়ারি/সালাম বরকত শফি রফিক জব্বার/আত্মায় আহত হয়ে তুলেছে উদ্দীপ্ত তরবারি ....। এই কবিতার পঙ্ক্তিমালার মতোই বায়ান্নর ফেব্রুয়ারিজুড়ে উত্তপ্ত ছিল পূর্ববঙ্গের রাজনীতি। ইতিহাসের বাঁক ফেরানো মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের লড়াইকে সঙ্গী করেই
এসেছিল একেকটি দিন। তেমনই একদিন ছিল ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি। এদিন পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের বাজেট অধিবেশন বসেছিল। সেই বাজেট অধিবেশনেও সামনে এসেছিল ভাষার প্রশ্ন। ১৪৪ ধারা জারির প্রশ্নে সরকারপক্ষ থেকে কৌশলে বিষয়টির আলোচনা এড়িয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু পরদিন একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের ওপর গুলি চললে প্রাদেশিক পরিষদে এ নিয়ে তুমুল উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। ক্ষোভের অনলে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী নুরুল আমিন ওইদিন ১৯৫২-৫৩ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন। ওই অধিবেশনে পরিষদ সদস্যদের অনেকেই জানতে চান, সরকার ভাষা কমিটির সুপারিশসমূহ গ্রহণ করেছে কিনা। উত্তরে শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদ জানান যে, এসব সুপারিশ গৃহীত হয়নি, বিবেচনায় রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আনোয়ারা খাতুন অধিবেশনে মুলতবি প্রস্তাব উত্থাপন করে বলেন, বিশিষ্ট রাজনৈতিক কর্মী শেখ মুজিবুর রহমান অনশন করছেন, জনগণ তার সম্পর্কে উদ্বিগ্ন।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিনের বিরোধিতায় সেই প্রস্তাবকে অগ্রাহ্য করা হয়। এরপর খয়রাত হোসেন অপর মুলতবি প্রস্তাবে পাকিস্তান অবজারভার বন্ধের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করলে প্রধানমন্ত্রীর বিরোধিতায় সেটিও নাকচ হয়ে যায়।
পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি যখন প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন শুরু হয়, তখন বাইরে প্রচ- আন্দোলন চলছে। অধিবেশনের শুরুতেই মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ স্পিকারকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘যখন দেশের ছাত্ররা, যারা আমাদের ভাবী আশাভরসাস্থল, পুলিশের গুলির আঘাতে জীবনলীলা সাঙ্গ করছে, সেই সময় আমরা এখানে সভা করতে চাই না। প্রথমে ‘এনকোয়ারি’ হোক তারপর ‘হাউস’ চলবে।’
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বলেন, ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করে শান্তিপূর্ণভাবে রাষ্ট্রভাষার দাবি জানাচ্ছিল। পুলিশ সেখানে অতর্কিতে হামলা চালিয়েছে এবং গুলি করেছে। শুধু তাই নয়, তারা অসংখ্য ছাত্রকে বিনা কারণে গেপ্তার করেছে। এটা আমাদের জন্য লজ্জার ও অপমানের। এ অবস্থায় এই অধিবেশন চলার কোনো মানে হয় না।
এ প্রসঙ্গে বশীর আল্হেলালের ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ গ্রন্থে কংগ্রেস দলের সংসদ সদস্য মনোরঞ্জন ধর জানিয়েছেন, বেলা আড়াইটার দিকে তিনি আর হুইপ গোবিন্দলাল ব্যানার্জি রিক্সায় করে আসছিলেন। এ সময় মেডিক্যাল কলেজের গেটের সামনে কয়েকজন ছাত্র তাদের থামান। তখনই তারা জানতে পারেন পুলিশের টিয়ার সেল নিক্ষেপ, লাঠিচার্জ ও গ্রেপ্তারের কথা।
পুলিশের লাঠিচার্জে আহত ছাত্রদের নাম-ধাম টুকে নিয়ে তারা অধিবেশনে যোগ দেন। আর ওই অধিবেশনের শুরুতেই মনোরঞ্জন ধর প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, ‘চলুন যাই, দেখে আসি ছাত্রদের কী অবস্থা । আমরা সামনে থাকবো। আপনার কোন ভয় নেই।’ এই আহ্বানে প্রধানমন্ত্রী নীরব থাকেন। এসময় সবাই মিলে জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুরু করেন। প্রতিবাদের মুখে তখন অধিবেশন সাময়িকভাবে মুলতবি করা হয়। তখন পূর্ব বাংলা সরকারের চিফ সেক্রেটারি আজিজ আহমেদের সঙ্গে কানে কানে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিন। মনোরঞ্জন ধরের ভাষায়, ‘আজিজ আহমেদ ওয়াজ দি রিয়াল রুলার অব দি কান্ট্রি।’
অধিবেশন থেকে বেরিয়েই তারা দেখতে পান একটা ম্যাসাকার ঘটে গেছে। ছাত্রদের মধ্যে ভীষণ উত্তেজনা। ছাত্রদের যেখানে গুলি করা হয়েছিল, সেখানেই সভা চলছে। সে সভায় মনোরঞ্জন ধর ও গোবিন্দ ব্যানার্জি বক্তৃতা করেন। তখন বিকাল সোয়া চারটে। তখন মুসলিম লীগের সদস্যরা ট্রাকে করে বাসায় ফিরে যান।
মনোরঞ্জন ধর ও গোবিন্দ হালদার এ সময় গোটা ঢাকা শহর ঘুরে দেখেন। মনোরঞ্জন ধরের ভাষায়, ‘এর মধ্যে আন্দোলন ছড়িয়ে গেছে আগুনের মতো। চারদিকে আন্দোলনের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। আমরা দেখলাম, ‘কজ উইল উইন! এমন একটা সময় আসে যখন কারণটা প্রধান হয়ে দাঁড়ায়।’