ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৯ মাঘ ১৪৩১

উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে এমন নজির বিশ্বে আর নেই

কোচিংয়ের ফাঁদে ছাত্র ভর্তি

আসিফ হাসান কাজল

প্রকাশিত: ২২:৪৭, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

কোচিংয়ের ফাঁদে ছাত্র ভর্তি

কোচিং ছাড়া উচ্চশিক্ষায় নাম করা প্রতিষ্ঠানে সুযোগ পাওয়া দুঃসাধ্য

বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট বা মেডিক্যাল কলেজ। কোচিং ছাড়া উচ্চশিক্ষায় নাম করা প্রতিষ্ঠানে সুযোগ পাওয়া দুঃসাধ্য। শুধু এখানে পড়লেই বুয়েট-মেডিক্যালে সুযোগ মেলে। গত কয়েক বছর ধরে কলেজ পর্যায় শেষ করার আগেই শিক্ষার্থীরা ছুটছে কোচিংসেন্টারে। ভালো টেস্টপেপার, চটকদার বিজ্ঞাপন আর পরীক্ষার্থীদের স্বপ্নকে পুঁজি করে দাপট দেখাচ্ছে কোচিং ব্যবসায়ীরা। শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে বিক্রি করে প্রতিবছর কয়েক হাজার কোটি টাকা তুলে নিচ্ছে সেন্টারগুলো।

অভিযোগ রয়েছে, যেসব শিক্ষার্থী বুয়েট, মেডিক্যাল বা ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে প্রথম ৫ জনের মধ্যে হয়, তারা কোচিং না করলেও আর্থিক প্রলোভনে এসব শিক্ষার্থীদের ম্যানেজ করে। মেধাবীদের নানাভাবে প্রভাবিত করে ভিডিও ও ছবির মাধ্যমে কোচিং সেন্টারগুলো প্রচার চালায়। এমন চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে নিজের সন্তানকেও এসব সেন্টারে ভর্তি করাতে এক প্রকার বাধ্য হন অভিভাবকরা।

এতে পয়সাওয়ালা অভিভাবকদের ছেলে-মেয়ে ভালো বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। পিছিয়ে পড়ছেন গরিবের সন্তানরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে এভাবে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের নজির সেভাবে নেই বললেই চলে। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা যে দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষায় ভর্তি হচ্ছে সেটিও হচ্ছে ফলের ভিত্তিতে। কোনো পরীক্ষার মধ্য দিয়ে নয়।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আইইআরের সাবেক অধ্যাপক ডক্টর সিদ্দিকুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, কোচিং বন্ধ করতে হলে সরকারের সদিচ্ছা ও পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা ভালো করতে হবে। এক সময় ভালো স্কুলে ভর্তির জন্যও ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের কোচিং করতে হত। কোচিংয়ের চক্করে তাদের জীবন অতিষ্ঠ ছিল। কিন্তু শুধুমাত্র ভর্তি প্রক্রিয়া লটারির মাধ্যমে করার কারণে শিশু শিক্ষার্থীদের আর কোচিংয়ে পড়ার দরকার হচ্ছে না।
গত বছর বিভিন্ন সময় কোচিং সেন্টার উদ্ভাস-উন্মেষের একাধিক শাখা পরিদর্শন করা হয়। এই সেন্টারগুলোর শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক ও শাখার বিভিন্ন কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় বিভিন্ন তথ্য। নাম প্রকাশ না করে একজন জানান, শুধুমাত্র ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে উদ্ভাস-উন্মেষে দুই লাখের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। কিন্তু নানা কারণে ক্লাস করেছে মাত্র অর্ধেক শিক্ষার্থী। তাদের পড়ানোর মান নিয়ে ব্যবসা পরিচালনার সঙ্গে যুক্তরা চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। তবে উদ্ভাসের দাবি, দুই-তিন লাখ নয়, ৫০ হাজার শিক্ষার্থী কোচিং করেছে।

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের হিসেব মতে গত বছর এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে ১৩ লাখ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে পাস করেছে ১০ লাখের বেশি। এছাড়াও আগের বছর যেসব পরীক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় ভালো বিশ^বিদ্যালয়ে সুযোগ পায়নি। তারাও ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। এজন্য করেছে ভর্তি কোচিংও। এবার শুধুমাত্র মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে ১ লাখ ৩৫ হাজার শিক্ষার্থী।

যেসব শিক্ষার্থীর অধিকাংশের কোচিং নির্ভরতা রয়েছে। এর বাইরে ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে লাখো শিক্ষার্থী। এ ছাড়াও পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য উচ্চ শিক্ষায় ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী সবাই প্রায় কোচিং সেন্টারে ভর্তি হন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধুমাত্র ভর্তি যুদ্ধ নিয়ে এবার প্রতি শিক্ষার্থী ভেদে ২০-২৫ হাজার টাকা নিয়েছে কোচিং সেন্টারটি।

তবে অনেক সময় বিভিন্ন সুপারিশ ও অফারের কারণে এটি ১৬-১৭ হাজার টাকার কম নয়। অর্থাৎ তিন লাখ শিক্ষার্থীর থেকে গড়ে ১৫ হাজার টাকা নিলেও শুধুমাত্র এই প্রতিষ্ঠানটিই ৫০০ কোটি টাকা একটি খাত থেকে এবার আয় করেছেন। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে আয় এর চেয়ে কম নয়। 
উদ্ভাসের ওয়েবসাইট ঘেটে দেখা যায়, মেডিক্যালে এবার প্রথম ২০ জনের ২০ জনই উন্মেষ থেকে চ্যান্স পেয়েছেন। বুয়েটের প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় প্রথম ৫০ জনের ৫০ জনই উদ্ভাসীয়ান। আবার গত বছরের ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের প্রথম ১০ জনই এই কোচিং থেকে ভর্তি পরীক্ষা যুদ্ধে বিজয়ী বলে দাবি করা হয়েছে।
মেডিক্যাল ভর্তির জন্য আরেক পরিচিত কোচিং সেন্টার রেটিনা। এই সেন্টারটিও দাবি করছে এ বছর মেডিক্যালে প্রথম ২০ জনের ১৮ জনই এই কোচিং সেন্টারের শিক্ষার্থী। বিশ^াসযোগ্যতা অর্জনে শিক্ষার্থীদের নাম, ছবি ও রোল নম্বরও প্রকাশ করা হচ্ছে। অথচ অভিভাবক ও পরীক্ষার্থীরাই বলছেন, এইচএসসির পর শিক্ষার্থীদের হাতে সময় থাকে খুবই কম। এই সময় পড়াশোনা করে একটি কোচিং সেন্টারেই ক্লাস-পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব হয় না।

কিন্তু একাধিক কোচিং সেন্টারই সব পর্যায়ের ভর্তি ফলে প্রথম ২০ জন নিজেদের বলে দাবি করে। এর অর্থ ওসব শিক্ষার্থী হয় দুইটি সেন্টারেই কোচিং করেছেন। অথবা তাদের কিনে নিয়ে প্রচারণা চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে সব পর্যায়ে দ্বিতীয় ঘটনাটিই সত্য বলে বারবার উঠে আসছে।
২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের সরকারি-বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়েছেন খুলনার সুশোভন বাছাড়। এই অর্জনে তিনি ১০০ এর মধ্যে ৯০ দশমিক ৭৬  নম্বর পেয়েছেন। তার গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার আনুলিয়া ইউনিয়নে। থাকেন খুলনা নগরের আজিজের মোড় এলাকায়। সুশোভনের বাবা সুভাস চন্দ্র বাছাড় খুলনার টি অ্যান্ড টি আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক। মা বন্দনা সেন একসময় শিক্ষক ছিলেন। তবে এখন গৃহিণী।

সুশোভনের বাবা সুভাস চন্দ্র বাছাড় জানান, আমার ছেলের স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হবে। কিন্তু সে জন্য কোনো কোচিংয়ে পড়ানো হয়নি। মেডিক্যালে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে বলেছিল ৯০ শতাংশের বেশি নম্বর পাবে। সেটাই হয়েছে। প্রথম হবে এটা ভাবিনি। তবে চান্স পাবে জানতাম।
মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর সুশোভনের বাবা কোচিং না করার দাবি করলেও একাধিক ভিডিও বার্তায় সুশোভনকে বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে কোচিং করেছেন বলে দেখা যায়। যা নিয়ে অভিভবাক ও সংশ্লিষ্টদের মধ্যেও প্রশ্ন উঠে। এ বিষয়ে উদ্ভাসের বক্তব্য হলো, সুশোভন বাছাড়ের বাবা কোচিং বলতে একাডেমিক কোচিংয়ের কথা বলেছেন। ভর্তি কোচিং নয়।

সে যে ১৬ হাজার টাকা দিয়ে ভর্তি হয়েছিল কোচিংয়ে সে প্রমাণও আমাদের হাতে রয়েছে। এবার কোটাসহ মেডিক্যালে মোট আসন ৫ হাজার ৩৮০টি। এ হিসাবে এ বছর একটি আসনের জন্য ২৫ (২৫ দশমিক ১৪) পরীক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। সংখ্যায় যা ১ লাখ ৩৫ হাজারের বেশি।
একটি সময় রেটিনা, ইউসিসি, ওমেগা, সানরাইজ, ফোকাস, আইকন প্লাসসহ একাধিক কোচিং সেন্টার থাকলেও বাজারে উদ্ভাস উন্মেষই অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে। এর সঙ্গে রেটিনা মেডিক্যাল কোচিংয়ে দীর্ঘ সময় শীর্ষ স্থান ধরে রেখেছে। বাংলাদেশ কোচিং অ্যাসোসিয়েশনের অন্যতম নেতা মাহবুব আরেফিন জনকণ্ঠকে বলেন, কোচিংগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা রয়েছে।

এ কারণে তারা বিভিন্ন পন্থায় শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করে। এটি অস্বীকার করবো না। তবে এখনো মেডিক্যালে রেটিনাকে এগিয়ে রাখছেন। প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য উদ্ভাস যে এক চেটিয়া ব্যবসা করছেন তাও স্বীকার করেন।
কোচিং ব্যবসায়ীরা কি ভ্যাট ট্রাক্সের বাইরে ॥ দেশে শত শত কোচিং সেন্টারে কোটি শিক্ষার্থী ভর্তি হলেও এই খাতে ভ্যাট দেওয়ার তেমন নজির নেই। তবে বিশ^বিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি কিছু কোচিং সেন্টার এখন ভ্যাটের আওতায় এসেছে। কিন্তু এর মধ্যে শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। যেমন শিক্ষার্থী সংখ্যা কমিয়ে দেখানো, নোটগাইডের আইটেমকে বই হিসেবে দেখিয়ে ভ্যাট মুক্ত রাখা।

এ সব বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় উদ্ভাসের সঙ্গে। তাদের সেন্টারের পক্ষ থেকে কে এম পলাশ বলেন, একজন শিক্ষার্থী যদি ২০ হাজার টাকা ভর্তি ফি দিয়ে কোর্সে ভর্তি হয় সেক্ষেত্রে টিউশন ফি থাকে ভর্তির টাকার অর্ধেক। আর এই অর্ধেক টাকার ১৫ শতাংশ ফি দেওয়া হয়। এসব জানতে এনবিআরের জনসংযোগ শাখায় যোগাযোগ করা হলে তারাও এর সত্যতা জানান। বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে সদস্য (মূসক নীতি) ড. মো. আবদুর রউফের যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।
এদিকে উদ্ভাসের ওয়েবসাইটে দেখা যায়, ৬ষ্ঠ থেকে ভার্সিটি কোচিংয়ের জন্য অন্তত ৩০ ধরনের কোর্স রয়েছে। এর মধ্যে এখন আলোচিত বুয়েট ভর্তি, ইঞ্জিনিয়ারিং, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়-ক, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়-খ ও শুধু বিশ^বিদ্যালয় ভর্তি কোচিং। যেমন ঢাবি ‘ক’ সম্ভাবনা পরীক্ষা ২০২৪। এই কোর্সে ৩ লাখ টাকার মেধাবৃত্তির বিজ্ঞাপন রয়েছে। শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি যাচাই পরীক্ষা হিসেবে যেকোনো শিক্ষার্থী দেশব্যাপী ৯১টি শাখায় একযোগে পরীক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
আবার যেসব শিক্ষার্থী মেডিক্যালে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নেয় তারা গণিত ও পদার্থ ও রসায়নের অধ্যাবসায়ের সুযোগ কম পান। কিন্তু মেডিক্যালে ভর্তির সুযোগ বেহাত হওয়া শিক্ষার্থীরা সাধারণত বিশ^বিদ্যালয়ের পরীক্ষায় তেমন ভালো করে না। এসব শিক্ষার্থীকেও টার্গেট করে কোচিং সেন্টারগুলো। যেমন এই ওয়েবসাইটে মেডিক্যাল পরবর্তী ক ইউনিটে ক্র্যাশ কোর্সে ভর্তির বিজ্ঞাপনই ঠিক তেমন।
ব্যবসা বন্ধে দরকার সরকারের সদিচ্ছা ॥ কোচিং ব্যবসার কারণ সম্পর্কে শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতাকে দায়ী করেছেন অধ্যাপক ডক্টর সিদ্দিকুর রহমান। তিনি বলেন, বিদেশের বিশ^বিদ্যালয়ে, মেডিক্যালে ও প্রকৌশল বিদ্যায় আমাদের যেসব শিক্ষার্থী পড়তে যাচ্ছে তাদের কাউকেই তো ভর্তি পরীক্ষা দেওয়া লাগছে না। কারণ ভালো কোনো দেশেই এমন পদ্ধতি নেই। আমাদের দেশের ছেলে মেয়েরা কিন্তু সেখানে পড়ছে ও ভাল গবেষক হচ্ছে। কিন্তু এভাবে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার পরও দেশে ভালো গবেষক পাওয়া যাচ্ছে না।
তিনি মনে করেন, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার সঠিক উত্তরপত্র মূল্যায়ন, নকল বন্ধ করা ও নির্ভরযোগ্য করা যেত তবে ভর্তি পরীক্ষার দরকার হতো না। ছেলে মেয়েরা তাদের পরীক্ষার ফলের মূল্যায়নের মাধ্যমে উচ্চ শিক্ষায় ভর্তির সুযোগ পেত। সেটি না করে আমরা কোচিংয়ের দিকে গোটা শিক্ষাকে ঠেলে দিয়েছি। আর গুটি কয়েক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী শত শত কোটি টাকার মালিক হচ্ছেন।

×