![বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক: অস্বস্তি কাটানোর পথ কী? বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক: অস্বস্তি কাটানোর পথ কী?](https://www.dailyjanakantha.com/media/imgAll/2024April/৩-2502101625.jpg)
ছবি : সংগৃহীত
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সরকারি পর্যায়ে কিছু বৈঠক হলেও পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি। দুই দেশের মধ্যে তলব-পাল্টা তলব, বিবৃতি ও পাল্টা বিবৃতি অব্যাহত রয়েছে। ফলে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের উপায় কী?
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মধ্যে একটি বৈঠকের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এটি আগামী ৪ এপ্রিল ব্যাংককে বিমসটেক সম্মেলনের সময় অনুষ্ঠিত হতে পারে। উল্লেখ্য, দায়িত্ব গ্রহণের পর ড. ইউনূস ও মোদীর মধ্যে একবার ফোনালাপ হয়েছিল।
এদিকে, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন আবারও বৈঠকে বসতে পারেন। সম্ভাব্য বৈঠকটি ১৬-১৭ ফেব্রুয়ারি ওমানের মাস্কটে ভারত মহাসাগরীয় সম্মেলনের (Indian Ocean Conference) ফাঁকে অনুষ্ঠিত হতে পারে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, এবং তৌহিদ হোসেন সেখানে যোগ দিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
এর আগে, গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সময় নিউইয়র্কে জয়শঙ্করের সঙ্গে তৌহিদ হোসেনের প্রথম বৈঠক হয়েছিল। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এটিই ছিল অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ভারতের প্রথম উচ্চ পর্যায়ের আলোচনা, যেখানে পারস্পরিক সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে উভয়পক্ষ সম্মত হয়।
অন্যদিকে, অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর গত ডিসেম্বরে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি ঢাকা সফর করেন। তার ১২ ঘণ্টার সংক্ষিপ্ত সফরে তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিন, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন, এবং সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গে বৈঠক করেন।
এছাড়া, আগামী ১৭-২০ ফেব্রুয়ারি ভারতের নয়াদিল্লিতে বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের চার দিনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, যা সীমান্ত পরিস্থিতি ও দ্বিপাক্ষিক নিরাপত্তা ইস্যুতে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েন: সমস্যা কোথায়?
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েন মূলত ৫ আগস্টের পর থেকে স্পষ্ট হতে শুরু করে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত ব্রিফিংগুলোতে বাংলাদেশ ইস্যু নিয়মিতভাবে উঠে আসছে, একইভাবে বাংলাদেশেও বিষয়টি আলোচনায় থাকছে।
একটি বড় সংকট তৈরি করেছে ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রচারণা, যা অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশবিরোধী ন্যারেটিভ ছড়াচ্ছে। সীমান্ত পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে, বাংলাদেশে ভারতের রপ্তানি কমেছে, এবং বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ভারতীয় ভিসা কার্যত স্থগিত রয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই সমস্যার মূল কারণ হলো ভারত অন্তর্বর্তীকালীন ইউনূস সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিতে চাচ্ছে না। পাশাপাশি, বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করছে ভারতীয় গণমাধ্যম। ফলে দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে।
শেখ হাসিনার ইস্যুটি আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের দৃষ্টিতে, ভারত শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে ভুল করেছে এবং তাকে ফেরত না দিয়ে বরং ‘বাংলাদেশবিরোধী কার্যক্রমে’ ব্যবহার করছে।
বিশ্লেষকদের মতামত
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ূন কবির বলেন, “ভারত স্পষ্টতই জানিয়ে দিয়েছে যে তারা বাংলাদেশে একটি নির্বাচিত সরকারের অপেক্ষায় আছে এবং সেই সরকারের সঙ্গেই কাজ করতে চায়। এখান থেকেই বোঝা যায় তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কীভাবে দেখছে। এটি বাংলাদেশের জন্য সম্মানজনক নয়।”
তিনি আরও বলেন, “৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান, স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে ভারত ন্যারেটিভ পরিবর্তনের চেষ্টা করছে। বাস্তবতা হচ্ছে, তারা এখন আর আগের মতো সুবিধা পাচ্ছে না, যা তাদের অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. লাইলুফার ইয়াসমিন মনে করেন, “বাংলাদেশ তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিজেই নির্ধারণ করবে। আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় কিভাবে সমাধান করা হবে, সেটাও আমাদের ব্যাপার। ভারতকে এটি বুঝতে হবে। তারা বাংলাদেশের সরকারকে অনির্বাচিত বলছে, অথচ তারা অনির্বাচিত আফগান সরকারের সঙ্গেও কাজ করেছে। ভারতের উচিত এই দ্বৈতনীতি থেকে বেরিয়ে আসা।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, “ভারত বাংলাদেশকে সমান মর্যাদার দেশ হিসেবে দেখে না, এটিই বড় সমস্যা। তারা প্রায়ই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য করে, যা সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “ভারতের দাবি, তারা একটি নির্বাচিত সরকার আসার পর সম্পর্ক পুনরায় এগিয়ে নেবে। এটি আসলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল। কারণ বর্তমান সরকার জনগণের সর্বসম্মত পছন্দ, যা নির্বাচিত সরকারের চেয়েও বড় বিষয়।”
বৈঠক কি সমাধান আনতে পারে?
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক উন্নয়নে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বা মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শুধু কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে এই জটিলতা কাটবে না।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ূন কবির বলেন, “পররাষ্ট্র মন্ত্রী, উপদেষ্টা বা সচিব পর্যায়ের বৈঠকগুলো মূলত আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। এগুলো থেকে খুব বেশি সমাধান আসার সম্ভাবনা কম। বরং সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে পারে যদি বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মধ্যে সরাসরি বৈঠক হয়। তবেই দুই দেশের মধ্যে আস্থার সংকট কিছুটা দূর হতে পারে।”
অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী মনে করেন, “বৈঠক অবশ্যই ইতিবাচক, তবে কেবলমাত্র উপদেষ্টা বা মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক দিয়ে সমস্যা মিটবে না। বরং প্রধানমন্ত্রী বা প্রধান উপদেষ্টা পর্যায়ের বৈঠক হলে সম্পর্কের বরফ গলতে পারে। তবে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন জরুরি। ভারতের উচিত বাংলাদেশকে ছোট করে দেখার প্রবণতা বাদ দেওয়া এবং সম্পর্ককে সমমর্যাদার ভিত্তিতে এগিয়ে নেওয়া।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. লাইলুফার ইয়াসমিন বলেন, “উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হলে সম্পর্ক উন্নতির পথ তৈরি হতে পারে, তবে তাতেও সময় লাগবে। কারণ দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের ফারাক অনেক বেড়ে গেছে। সবার আগে ভারতীয় মিডিয়াকে বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচার বন্ধ করতে হবে। বাংলাদেশেও কিছু প্রচার হয়, তবে তা ভারতের তুলনায় অনেক কম। মিডিয়ার লাগাম টানতে না পারলে সম্পর্ক উন্নয়ন আরও কঠিন হয়ে পড়বে।”
মো. মহিউদ্দিন