
.
বিচারাঙ্গন রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করার সুপারিশ করেছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। আইনজীবীদের সনদপ্রাপ্তির পরীক্ষার সিলেবাসে নতুন আইন সংযোজন করার আহ্বান জানানো হয়েছে। আপিল বিভাগের বিচারাধীন মামলার সিদ্ধান্ত সাপেক্ষে মোবাইল কোর্টের দন্ড প্রদানের ক্ষমতা সংশোধন করে শুধু জরিমানা প্রদানের বিধান করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রধান বিচারপতিসহ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের মেয়াদ ৬৭ বছর থেকে তিন বছর বাড়িয়ে ৭০ করার কথাও বলা হয়েছে। ৩৫২ পৃষ্ঠার এ প্রতিবেদনে বিচার বিভাগের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা নিশ্চিতে ৩২ বিষয়ে সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। বুধবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে এ প্রতিবেদন তুলে দেন বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান।
কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন, হাইকোর্ট বিভাগের সাবেক বিচারপতি এমদাদুল হক, ফরিদ আহমেদ শিবলী, সাবেক জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ আমিনুল ইসলাম, মাসদার হোসেন, সিনিয়র অ্যাডভোকেট তানিম হোসেইন শাওন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মাহফুজুল হক সুপন ও শিক্ষার্থী প্রতিনিধি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী আরমান হোসাইন।
বিচার বিভাগকে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও কার্যকর করতে প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রস্তাব করার লক্ষ্যে গত ৩ অক্টোবর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদনক্রমে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। সংস্কার প্রস্তাবে বলা হয়, বিচারাঙ্গনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তকরণের উদ্দেশ্যে আদালত প্রাঙ্গণে আইনজীবী বা অন্য কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দল কর্তৃক সব ধরনের সভা- সমাবেশ বা মিছিল নিষিদ্ধকরণের জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন এবং বিচারাঙ্গনে আইনজীবীদের সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করা নিরুৎসাহিতকরণ। বার সমিতি নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ বিলোপ করা।
সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন ক্রমে পৃথক সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় স্থাপন এবং অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি, পদোন্নতি, ছুটি মঞ্জুরিসহ শৃঙ্খলা বিধানের ক্ষেত্রে নির্বাহী কর্তৃত্বের অবসান ঘটিয়ে এসবের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ সুপ্রিম কোর্টের অধীনে আনার বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে। সে উদ্দেশ্যে বিচার কর্মবিভাগের সংশ্লিষ্ট বিধিমালা সংশোধন। সংবিধানের ৮৮ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সংযুক্ত তহবিলের ওপর দায়মুক্ত ব্যয়ের আওতায় বিচার কর্মবিভাগের বিচারক ও কর্মচারীদের পারিশ্রমিক অন্তর্ভুক্ত করা।
বিচার বিভাগে দুর্নীতি প্রতিরোধ ॥ সুপ্রিম কোর্ট ও অধস্তন সকল পর্যায়ের বিচারকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য দুর্নীতিবিরোধী সুস্পষ্ট বিধানসংবলিত আচরণ বিধিমালা প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতি তিন বছর পরপর সুপ্রিম কোর্ট এবং অধস্তন আদালতের বিচারকদের সম্পত্তির বিবরণ সুপ্রিম কোর্টে প্রেরণ এবং তা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে প্রকাশ করা। প্রতি তিন বছর পরপর সুপ্রিম কোর্ট ও অধস্তন আদালতের সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পত্তির বিবরণ সুপ্রিম কোর্টের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে এবং অধস্তন আদালতের ক্ষেত্রে জেলা আদালতের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা। সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ লিখিতভাবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে পৌঁছানোর জন্য সুপ্রিম কোর্টে অভিযোগ বাক্স স্থাপন এবং ইমেইলের মাধ্যমে অভিযোগ দাখিলের জন্য ডেডিকেটিড ইমেইল অ্যাড্রেস জনসাধারণকে প্রদান করা।
বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্ট সংবিধান সংশোধনী ॥ প্রধান বিচারপতি এবং অন্য বিচারকদের নিয়োগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংবিধানের বিধানগুলো সংশোধন যার মধ্যে রয়েছে, অনুচ্ছেদ ৪৮(৩) (রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাকে সীমিত করে নিয়োগ কমিশনকে ক্ষমতায়িত করা), ৫৫(২) (প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতা থেকে প্রধান বিচটারপতি এবং অন্য বিচারকদের নিয়োগের বিষয়কে পৃথক করা), ৯৪ (বিচারকদের সংখ্যা নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির মতকে প্রাধান্য দেওয়া এবং আপিল বিভাগের ন্যূনতম বিচারকের সংখ্যা ৭ জন করা), ৯৫ (রাষ্ট্রপতি আপিল বিভাগের কর্মে প্রবীণতম বিচারককেই প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করবেন, অর্থাৎ প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রক্রিয়ার রাষ্ট্রপতির কোনো স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা থাকবে না বা নির্বাহী বিভাগের কোনো প্রভাব থাকবে না।
প্রধান বিচারপতিসহ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের মেয়াদ ৬৭ বছর থেকে তিন বছর বাড়িয়ে ৭০ করার সুপারিশ করেছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। এর জন্য সংশোধন করতে হবে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ। সংবিধানের ৯৬ (১) অনুচ্ছেদ অনুসারে বর্তমান বিচারপতিদের বয়সসীমা ৬৭ বছর।
হাইকোর্ট বেঞ্চ বিভাগীয় সদরে: সংস্কার প্রস্তাবের সারসংক্ষেপে ‘আদালতের বিকেন্দ্রীকরণ’ সংক্রান্ত সুপারিশে বলা হয়, সংবিধানের ১০০ অনুচ্ছেদ সংশোধনীর মাধ্যমে রাজধানীর বাইরে প্রতিটি বিভাগীয় সদরে হাইকোর্ট বিভাগের স্থায়ী বেঞ্চ প্রতিষ্ঠা করা। তবে হাইকোর্ট বিভাগের এখতিয়ারের পূর্ণাঙ্গতা বা অবিভাজ্যতা এমনভাবে বজায় রাখতে হবে, যেন স্থায়ী বেঞ্চগুলো স্থাপনের কারণে দেশের সর্বত্র কর্তৃত্ব প্রয়োগের ক্ষেত্রে হাইকোর্ট বিভাগের এখতিয়ার কোনো ভৌগোলিক সীমারেখা দ্বারা বিভাজিত না হয় এবং রাষ্ট্রের একক চরিত্র ক্ষুন্ন না হয়।
উপজেলা সদরে আদালতের বিষয়ে বলা হয়, উপজেলা সদরের ভৌগোলিক অবস্থান ও বৈশিষ্ট্য, জেলা-সদর থেকে দূরত্ব ও যাতায়াত ব্যবস্থা, জনসংখ্যার ঘনত্ব ও বিন্যাস এবং মামলার চাপ বিবেচনা দেশের বিভিন্ন উপজেলায় সিনিয়র সহকারী জজ ও প্রথম শ্রেণির জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত স্থাপন করা। সংবিধানের ১০০ অনুচ্ছেদে বলা হয়, রাজধানীতে সুপ্রিম কোর্টের স্থায়ী আসন থাকবে, রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিয়ে প্রধান বিচারপতি সময়ে সময়ে অন্য যে স্থান বা স্থানসমূহ নির্ধারণ করবেন, সেই স্থান বা স্থানসমূহে হাইকোর্ট বিভাগের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে।
আর্থিক স্বাধীনতা ॥ বিচার বিভাগের বাজেট নির্ধারণের জন্য সুপ্রিম কোর্টের একটি কমিটি থাকবে এবং সেই কমিটিতে নির্বাহী বিভাগের প্রতিনিধিরা সদস্য হিসেবে থাকবে। বরাদ্দকৃত বাজেট স্বাধীনভাবে খরচ করা এবং তা উপযোজন এবং পুন:উপযোজনের পরিপূর্ণ ক্ষমতা প্রদানসহ সুপ্রিম কোর্টের জন্য উন্নয়ন বাজেট বরাদ্দকরণ। বিচার বিভাগের বাজেট বৃদ্ধি।
রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শন ॥ আদালতের রায়ে চূড়ান্তভাবে দন্ডিত অপরাধীকে রাষ্ট্রপতি বা নির্বাহী বিভাগের ক্ষমা প্রদর্শনের একচ্ছত্র ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের সুপারিশ করেছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। এ লক্ষ্যে একটি বোর্ড প্রতিষ্ঠা ও সেই বোর্ডের সুপারিশের ভিত্তিতে ক্ষমা প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সংস্কার প্রতিবেদনে এ সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে ‘রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শন’ সংক্রান্ত সুপারিশের সার সংক্ষেপে বলা হয়, ‘আদালত কর্তৃক চূড়ান্তভাবে দন্ডিত অপরাধীকে রাষ্ট্রপতি বা নির্বাহী বিভাগ কর্তৃক ক্ষমা প্রদর্শনের একচ্ছত্র ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে বোর্ড প্রতিষ্ঠা, যার সুপারিশের ভিত্তিতে ক্ষমা প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে।’
মামলা জট হ্রাস ॥ মামলা জট নিরসনে বা ভবিষ্যতে মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সম্ভাব্য জট নিরসন কল্পে প্রয়োজন বিচার বিভাগের দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্প মেয়াদি সংস্কার প্রয়োজন। এ বিষয়ে কমিশন প্রস্তাব করেছে, বিচার প্রক্রিয়া এবং বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিশেষত, বিচারক, ফৌজদারি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এবং প্রসিকিউটর এবং বিচারঙ্গনে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ করতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগে স্বচ্ছতা, দক্ষতা এবং গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিতকরণের জন্য একটি কমিশন গঠন, বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে সচেতনা বৃদ্ধি। স্বল্প মেযাদির মধ্যে অধিকসংখক ফৌজদারি আপিল, ফৌজদারি রিভিশন, দেওয়ানি আপিল ও দেওয়ানি রিভিশন নিষ্পন্নাধীন আছে এরূপ জেলাসমূহে অবসরপ্রাপ্ত সৎ দক্ষ এবং সুস্বাস্থ্যের অধিকারী জেলা জজগণকে ২/৩ বছর মেয়াদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রাদান করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ন্যূনতম ১০০০টি আপিল/রিভিশন বিচারাধীন আছে এরূপ জেলাতে চুক্তিভিত্তিক জেলা জজগণকে নিয়োগ করা যেতে পারে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিচারকদের ছুটি, বিভিন্ন দিবস উদযাপন, আদালতে প্রকাশ্যে পরবর্তী তারিখ ঘোষণা না করা, আইনজীবীর মৃত্যুতে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ রাখা ইত্যাদি কারণে বিচারপ্রার্থীরা যে হয়রানির শিকার হন, তা বন্ধ করতে হবে।
মোবাইল কোর্ট ॥ আপিল বিভাগের বিচারাধীন মামলার সিদ্ধান্ত সাপেক্ষে মোবাইল কোর্টের দ- প্রদানের ক্ষমতা সংশোধন করে শুধু জরিমানা প্রদানের বিধান করা এবং বিভিন্ন আইনে বর্ণিত ক্ষেত্রে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটগণ কর্তৃক মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা।
আইনপেশার সংস্কার ॥ আইনজীবীদের সনদপ্রাপ্তির পরীক্ষার সিলেবাসে নতুন আইন সংযোজনের সুপারিশ করা হয়েছে। পেশাগত মানোন্নয়নের লক্ষ্যে একটি স্থায়ী প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট স্থাপন। বার কাউন্সিল আদেশে পেশাগত অসাদাচরণের সংজ্ঞা স্পষ্টীকরণ করা। ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বৃদ্ধি করে স্থায়ীভাবে ৫টি এবং ঢাকার বাইরে প্রতিটি জেলায় একটি করে ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করা। ট্রাইব্যুনালের গঠন সংশোধন করে সেখানে একজন বিচারক এবং দুইজন আইনজীবী সদস্য নিয়োগদান করা। আইনজীবী সমিতিগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা। যেন তারা রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত না হয়।