![প্রাক্তন আইজিপি শাহিদুল হকের বিরুদ্ধে ৫৬০ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ প্রাক্তন আইজিপি শাহিদুল হকের বিরুদ্ধে ৫৬০ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ](https://www.dailyjanakantha.com/media/imgAll/2024April/50-2502070952.jpg)
ছবিঃ সংগৃহীত
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহিদুল হক, তার স্ত্রী ও সন্তানদের নামে থাকা ৭২টি ব্যাংক হিসাবে ৫৬০ কোটি টাকার অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। পাশাপাশি, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ফ্ল্যাট ও বাণিজ্যিক ফ্লোর স্পেস কেনার তথ্যও মিলেছে। এমনকি, একটি ব্যাংক থেকে উপহার পাওয়া ফ্ল্যাট পুনরায় সেই ব্যাংককেই ভাড়া দিয়ে বড় অঙ্কের অর্থ গ্রহণ করেছেন তিনি।
বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) জানিয়েছে, শহিদুল হক তার ক্ষমতা ও পদ ব্যবহার করে বিপুল অর্থ উপার্জন করেছেন, যা পরবর্তীতে তার পরিবারের সদস্য ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে লেনদেন করা হয়। সরকারি চাকরিজীবীর পরিবারের সদস্যদের এমন লেনদেন অস্বাভাবিক হিসেবে চিহ্নিত করেছে সংস্থাটি। বিষয়টি নিয়ে তদন্তের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে।
ব্যাংক লেনদেন ও সম্পদের হিসাব
২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত আইজিপির দায়িত্ব পালন করা শহিদুল হক, তার স্ত্রী শামসুন্নাহার রহমান এবং তাদের তিন সন্তানের নামে ৭২টি ব্যাংক হিসাবের তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন মজিদ-জরিনা ফাউন্ডেশনের একাধিক হিসাবও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
এসব হিসাবে ২০২৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ৫৬০ কোটি ২৮ লাখ টাকা জমা হয়(প্রায় ৫৩ মিলিয়ন ডলার), যার মধ্যে ৫৫০ কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে মাত্র ১০ কোটি ২০ লাখ টাকা অবশিষ্ট রয়েছে। এছাড়া, শহিদুল হকের একটি ঋণ হিসাবে মোট ৪ কোটি ৬৩ লাখ টাকা জমা হলেও, তৎপরবর্তী সময়ে ৪ কোটি ৭৬ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়, ফলে হিসাবটি বর্তমানে ১১ লাখ টাকার বেশি ঋণাত্মক রয়েছে।
তার স্ত্রী শামসুন্নাহার রহমানের দুটি বৈদেশিক মুদ্রার (RFCD) হিসাবে ২ লাখ ৩৫ হাজার মার্কিন ডলার জমা হয়, যার মধ্যে ১ লাখ ৬৫ হাজার ডলার তোলা হয়েছে।
ব্যাংকের উপহার ও সম্পদের বিস্তার
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের এক হিসাবে ১ কোটি ৬৪ লাখ ৫৫ হাজার টাকা জমা করে শহিদুল হক একটি অ্যাকাউন্ট খোলেন। এরপর নিয়মিত ভাড়া বাবদ বড় অঙ্কের অর্থ জমা হতে থাকে। এই ব্যাংক থেকেই তিনি ৪ হাজার ৫৭১ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট উপহার পান, যার বাজারমূল্য প্রায় ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা। পরে, একই ফ্ল্যাট ব্যাংকের কাছেই ভাড়া দিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ আয় করেন।
এছাড়া, পদ্মা ব্যাংকের এক হিসাবে তার নামে ১৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকা জমা হয়, যার মধ্যে ১৪ কোটি টাকা বিভিন্ন ব্যক্তির মাধ্যমে তুলে নেওয়া হয়েছে। অর্থ উত্তোলনের কাজে সানিবুর রহমান, নুরুল ইসলাম ঢালি ও ইমরান ব্যাপারীসহ কয়েকজনকে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া, মেসার্স ইরা বিল্ডার্স নামক একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের একাউন্টে বড় অঙ্কের অর্থ স্থানান্তর করা হয়, যা শহিদুল হকের পরিবারের নিয়ন্ত্রণাধীন।
অবৈধ সম্পদ বিনিয়োগ ও ফাউন্ডেশন
শহিদুল হক ও তার স্ত্রীর নামে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ১৪,৫০০ বর্গফুট বাণিজ্যিক স্পেস রয়েছে, যার বাজারমূল্য প্রায় ৬ কোটি ৫৮ লাখ টাকা।
- বাড্ডার প্রগতি সরণিতে: ৪,৫৭১ বর্গফুট ফ্লোর স্পেস (মূল্য ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা)
- উত্তরায়: ৬,০০০ বর্গফুট ফ্লোর স্পেস (মূল্য প্রায় ৩ কোটি টাকা)
এসব সম্পদ অবৈধ উপার্জনের মাধ্যমে কেনা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়া, শহিদুল হকের বাবা-মায়ের নামে মজিদ-জরিনা ফাউন্ডেশন নামের একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়। মার্কেন্টাইল ব্যাংকের এক হিসাবে ফাউন্ডেশনের নামে ৭৫ কোটি টাকা জমা হয়েছে। অথচ, এটি শুধুমাত্র একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিবন্ধিত।
এই হিসাবের লেনদেন বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিভিন্ন জেলা থেকে বড় অঙ্কের অর্থ একসঙ্গে জমা হয়েছে এবং পরবর্তীতে তা নগদ উত্তোলন করা হয়েছে বা প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে সম্পর্কহীন বিভিন্ন সংস্থার কাছে স্থানান্তর করা হয়েছে। এমনকি, এখান থেকে শহিদুল হকের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান ইরা বিল্ডার্সের হিসাবেও অর্থ পাঠানো হয়েছে।
প্রশ্নবিদ্ধ আয় ও ব্যবসায়িক লেনদেন
ব্যাংক নথি অনুযায়ী, শহিদুল হকের অবসরোত্তর ব্যবসা সারস শিপিং লাইন থেকে তার মাসিক আয় মাত্র ৪ লাখ টাকা। তার স্ত্রী একজন নামমাত্র ব্যবসায়ী।
এত সীমিত আয়ের পরও তার ও তার পরিবারের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ জমা, বেশি দামে ফ্ল্যাট কেনা এবং উচ্চমূল্যে ব্যাংকের কাছে ভাড়া দেওয়ার বিষয়টি বিএফআইইউ সন্দেহজনক হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, একজন আইজিপির মাসিক আয় গড়ে এক লাখ টাকার মতো। সরকারি চাকরিজীবী হওয়ায় তিনি ব্যবসা পরিচালনা করতে পারেন না। তাই তার এই বিপুল পরিমাণ সম্পদ ও লেনদেন নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে।
দুদকের তদন্ত ও ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ
বিএফআইইউ এই অর্থের উৎস ও লেনদেনের বিস্তারিত বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন দুদকে পাঠিয়েছে। সন্দেহজনক লেনদেন এবং অর্থপাচার সংক্রান্ত অভিযোগের ভিত্তিতে প্রতিরোধ আইন, ২০১২ অনুযায়ী, শহিদুল হকের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে দুদক।
শহিদুল হক বর্তমানে ব্যবসায়ী আবদুল ওয়াদুদ হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন। তবে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
রেজা