ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪৩১

চব্বিশের আন্দোলনে শহীদ পরিবারের সদস্যদের হুঁশিয়ারি

গণহত্যার বিচারের আগে কোনো নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না

জনকণ্ঠ রিপোর্ট

প্রকাশিত: ২৩:৩৪, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫; আপডেট: ০১:৪৫, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

গণহত্যার বিচারের আগে কোনো নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে ৭১৭ জন শহীদের তথ্য জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান

চব্বিশের রক্তস্নাত গণ-অভ্যুত্থানে ৭১৭ জন শহীদের তথ্য সংবলিত স্মারকের মোড়ক উন্মোচন করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। বুধবার বেলা সাড়ে ১১টায় জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে এ মোড়ক উন্মোচন হয়। অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে ’২৪-এর জুলাই আন্দোলনে শহীদ পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, গণহত্যার বিচারের আগে কোনো নির্বাচন দেশে হতে দেওয়া হবে না। শহীদ পরিবারের সঙ্গে একমত হয়ে জামায়াতও দাবি করেছে আগে বিচার তারপর জাতীয় নির্বাচন।  
অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী বক্তব্যে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল সাবেক এমপি মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, জামায়াতে ইসলামী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ঐতিহাসিকভাবে শহীদদের তথ্য প্রকাশ করবে তার আলোকে জামায়াতে ইসলামী ৫ আগস্টের পর থেকে টানা পরিশ্রম করে। এ তথ্য সংগ্রহে ২৩টি গ্রুপ কাজ করে। প্রাথমিকভাবে ১০টি খ-ে ৭১৭ জন শহীদের তথ্য ২৫০০ পৃষ্ঠায় তুলে আনা হয়েছে। আমাদের কাজ চলমান রয়েছে।

যে পর্যন্ত সকল শহীদের তালিকা শেষ না হচ্ছে ততদিন আমাদের কাজ চলমান থাকবে। প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, যে কাজটিতে জামায়াত হাত দিয়েছে, এটি জামায়াতের একার সম্পত্তি নয়, এটি জাতীয় সম্পত্তি। এটা একার দায়িত্বও নয়, সকলের দায়িত্ব। সরকার ও আরও যারা অংশীজন আছেন, তাদেরও দায়িত্ব। আমরা এই কাজের কোনো ক্রেডিট (কৃতিত্ব) নিতে চাই না। আমরা শুধু নৈতিক দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করছি।
তিনি বলেন, আমাদের চেয়ে আরও সুন্দর করে, আরও নিখুঁতভাবে করার জন্য আরও সংস্থা, সংগঠন ও অংশীজন এগিয়ে আসুক। তাহলেই আমাদের এই ভূমিকা নেওয়াটা সার্থক হবে। সেক্ষেত্রে জামায়াত সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে। 
তিনি বলেন, আমরা শহীদ পরিবারগুলোর কাছে গিয়েছি তাদের প্রতি সম্মান দিতে ও তাদের থেকে দোয়া নিতে। কারণ তারা সৌভাগ্যবান, তাদের পরিবার দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। ফ্যাসিবাদী সরকারের কাছে মুক্তিকামী সকলেই ছিলেন মজলুম। ’২৪-এর গাজী ও শহীদ পরিবারগুলোর হতাশা কিছুটা দূর করতে অসম্পূর্ণ রেখেই শহীদ স্মরণিকা আজ প্রকাশিত হলো? এই স্মরণিকা পূর্ণাঙ্গ করার কাজ চলমান থাকবে।
ডা. শফিক বলেন, ২৪-এর শহীদরা বৈষম্যহীন, মানবিক বাংলাদেশ চেয়েছিলো। তাদেরকে স্মরণে রেখে আমাদের উচিত এমন কোনো কাজ থেকে বিরত থাকা যা জুলাই বিপ্লবের চেতনাবিরোধী। বৈষম্য, দুর্নীতি ও দুঃশাসনমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে সকলের মধ্যে জুলাই বিপ্লবের চেতনা সমুন্নত রাখতে হবে।
জামায়াত আমরি বলনে, কিছু ইতিহাস মানুষের জন্য হয় বিষাদের, কিছু হয় আনন্দের, আর কিছু হয় গৌরবের। জাতিকে মুক্ত করার আন্দোলনে যারা জীবন দেন, অতীতেও এ রকম যারা দিয়েছেন, ৪৭, ৫২ সর্বশেষ ২০২৪ যারা জীবন দিয়েছেন তারা গৌরবের। শহীদ পরিবারগুলোর জন্য এটি কান্নার ইতিহাস, আর দেশবাসীর জন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করার ইতিহাস।
অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে চব্বিশের আন্দোলনে শহীদ নাসিব হাসানের পিতা গোলাম রাজ্জাক বলেন, সন্তান হত্যার বিচার ছাড়া কোনো নির্বাচন হতে দিব না। একই সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ সংস্কার ছাড়া কোনো নির্বাচন এ দেশে হবে না। প্রয়োজনে আমরা আবার মাঠে নামব। 
তিনি বলেন, ৫ আগস্টের পর আমরা হারিয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের এই শহীদ পরিবারকে উদ্ধার করেছে জামায়াত। কোনো দল আমাদের কাছে যায়নি, জামায়াত সহযোগিতা করেছে এখনো করছে। 
রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের ছাত্র শহীদ ফারহান ফায়াজের পিতা শহীদুল ইসলাম বলেন, আমরা সন্তান হারিয়ে যে শোকে ছিলাম তা শক্তিতে পরিণত করেছি। ’৭১ এ শুধু ভূখ- পেয়েছিলাম, স্বাধীনতা পরবর্তী সময় সবাই ভারতের তাঁবেদারি করেছে। ’২৪ এ শহীদের পর স্বাধীনতা পেয়েছি, আমরা কি আবারও ভারতের তাঁবেদারি করতে চাই না। যারা লুটপাট চালানোর জন্য নির্বাচনের জন্য পাগল হয়েছেন তারা সাবধান হয়ে যান। নির্বাচনের আগে বিচার তারপর সংস্কার। এর আগে কোনো নির্বাচন নয়। 
শহীদ মাহফুজুর রহমানের পিতা আব্দুল মান্নান বলেন, আমার ছেলে ২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। কী অপরাধ ছিল আমার সন্তানের? সে শুধু ইনসাফ ভিত্তিক সমাজ, রাষ্ট্র চেয়েছিলো। ২ হাজারের বেশি ছাত্র-জনতা জীবন দিয়েছিল দেশ গঠনের জন্য। শহীদ পরিবার বিচার না পাওয়া পর্যন্ত দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। 
যাত্রাবাড়ীতে আলোচিত শহীদ ইমাম হাসান তায়েবের ভাই রবিউল আওয়াল বলেন, যাত্রাবাড়ীতে যার লাশ টেনে নেওয়ার সময় বারবার গুলি করা হচ্ছিল সে তায়েবের ভাই আমি। গত পরশু দেখেছি মাত্র ৩৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিচারের আগে বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন হবে না। আপনাদের ক্ষমতায় যাওয়ার এত লোভ কেন? অভ্যুত্থান না হলে ২৯ সালে নির্বাচন হতো। তখন কারা ক্ষমতায় আসত? শহীদদের রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করবেন না। 
অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য বিদায়ী ছাত্রশিবিরের সভাপতি আবু সাদিক কায়েম বলনে, অনেকেই মাস্টারমাইন্ড সাজার চেষ্টা করছেন। আসল মাস্টারমাইন্ড আমাদের শহীদরা এবং আন্দোলনের আহতরা। রাষ্ট্র থেকে শহীদদের নিয়ে দৃশ্যমান কোনো কাজ দেখতে পাচ্ছি না। শহীদরা আমাদের প্রেরণার বাতির ঘর। তাদের জেন সর্বোচ্চ সম্মান দেওয়া হয়। 
ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম উপদেষ্টাদের উদ্দেশে বলেন, শহীদদের রক্তের স্তূপের ওপরে বসে আছেন আপনারা। শহীদদের খুনিদের বিচার শেষ না করতে পারলে চেয়ার ছেড়ে দিন। শহীদদের ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই, জামায়াতে ইসলামী বিচার নিশ্চিত করবে। শহীদদের প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সার্বিক ব্যবস্থা করা করবে জামায়াত। 
বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব অ্যাডভোকেট গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক বলেন, যে কাজ কেউ করেনি তা করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।  যে স্মারক তৈরি করার কথা ছিল সরকারের, বড় রাজনৈতিক দলের কিন্তু তা করেছে জামায়াত। বাংলাদেশের মানুষ সেবক চায়, জামায়াতে ইসলামী মানুষের সেবক হয়ে কাজ করছে জামায়াত। আমরা চাই আগামী দিনে জামায়াতের নেতৃত্বে দেশ পরিচালনা হোক।   আমরা চাই। আমরা চাই এ দেশ ধার্মিক এবং আধ্যাত্মিক মানুষ দিয়ে দেশ পরিচালিত হোক। 
স্মারক অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন জাময়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমির নূরুল ইসলাম বুলবুল,  কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের আমির মুহাম্মদ সেলিম  উদ্দিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুকমল বড়ুয়া, জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা, যুগান্তর পত্রিকার সম্পাদক ও কবি আব্দুল হাই শিকদার, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক, জাগপার সহ-সভাপতি প্রকৌশলী রাশেদ প্রধান, ১২ দলের মুখপাত্র সেলিম প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন জুলাই বিপ্লবে শহীদ পরিবারের সদস্য, দলটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মোবারক হোসেন ও সাইফুল ইসলাম খান মিলন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ ও  ঢাকা মহানগরী উত্তরের সেক্রেটারি ড. রেজাউল করিম।

×