বাঙালির মাতৃভাষার অধিকার
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রশ্নে পাক সরকারের সঙ্গে সুর মিলিয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু জাতীয় পত্রিকা। বাঙালির মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার নায্য দাবিকে অযৌক্তিককভাবে উপস্থাপিত হয়েছে সেসব পত্রিকায়। বেছে নেওয়া হয়েছিল অপসাংবাদিকতার কৌশল। মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাাদে সোচ্চার হয়েছিল ছাত্রসমাজ। ভ্রান্ত সাংবাদিকতার নজির গড়ে পূর্বপাকিস্তানের ভাষার আন্দোলনকে সাম্প্রদায়িকতা ও দেশদ্রোহিতা হিসবে প্রমাণ করতে চেয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানের সংবাদপত্রগুলো।
১৯৫২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি করাচির ‘ডন’ পত্রিকায় ‘প্রাদেশিকতা’ শীর্ষক সম্পাদকীয়তে পাকিস্তানের সব থেকে বড় শত্রুরূপে প্রাদেশিকতাকে আখ্যায়িত করে লেখা হয়, ‘বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্ররা যে আন্দোলন করছেন তা আন্দোলনের নামে রাষ্ট্রদোহিতা।
ভাষার বিষয়ে যুবকদের কাছে একটা আবেগময় আবেদন আছে; কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে একটি খুব শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যেসব মানুষ কায়েদে আজমের জীবদ্দশায় কোনোদিন মাথা তোলার সাহস করেনি তাদেরই প্ররোচিত করা হচ্ছে জাতির পিতার উপদেশ অগ্রাহ্য করতে।’ এমনকি পক্ষপাতদুষ্ট ওই সম্পাদকীয়তে লেখা হয় ‘যারা প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে প্রাদেশিকতার পক্ষে ওকালতি করে তাদেরকে রাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে ঘোষণা করা এবং কোনো প্রকার প্রশ্রয় না দেওয়া উচিত।’
এই সম্পদকীয়র প্রেক্ষাপটে ১৯৫২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রতিবাদ করেন। ছাত্রদের ওই সভায় এই সম্পাদকীয়র নিন্দা প্রস্তাব গৃহীত হয়। ছাত্ররা ঘোষণা দেওয়া, বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনের সঙ্গে রাষ্ট্রদ্রোহিতার বা প্রাদেশিকতার কোনো সংশ্রব নেই।
‘ডন’ ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানের অন্য পত্রিকাগুলোও পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলনকে প্রাদেশিকতা বলে উল্লেখ করে। মওলানা আব্দুল হামিদ ভাসানী সেই অপপ্রচারের বিরুদ্ধে তীব্র আপত্তি জানিয়ে এক বিবৃতিতে বলেন, ‘উর্দুর মতো একটি নূতন ভাষা পূর্ব বাংলার জনগণের ওপর জোর করিয়াই চাপাইয়া দিতে চাহিলে নিশ্চয় এই আশঙ্কাই জনগণের মনে উদ্রেক হওয়া স্বাভাবিক যে চাকুরী ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাহাদিগকে কোণঠাসা করিবার জন্যই ইহা করা হইতেছে।
একতার বুলি আওড়াইয়া যারা পাকিস্তানে একটিমাত্র রাষ্ট্রভাষার পক্ষে ওকালতি করিতেছেন, আমি তাহাদিগকে দুনিয়ার প্রগতিশীল ও সমৃদ্ধিশালী রাষ্ট্র রাশিয়া, সুইজারল্যান্ড ও কানাডার দিকে তাকাইতে বলিতেছি। তথায় একের অধিক রাষ্ট্রভাষা আছে এবং ইহাতে দেশের একতা শিথিল করা তো দূরের কথা, দেশবাসীর আর্থিক, নৈতিক ও সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ সাধনে প্রচুর সহায়তা করিয়াছে।’ তৎকালীন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদও ‘ডন’ পত্রিকার সম্পাদকীর্য় বিরুদ্ধে সংবাদপত্রে বিবৃতি দেন।