পাসপোর্ট
পাসপোর্টের জন্য গত নভেম্বরে আবেদন করেন ব্যবসায়ী ইয়ামিন (ছদ্মনাম)। আবেদনের কয়েকদিন পর ভেরিফিকেশনের জন্য কল করেন এক পুলিশ সদস্য। ইয়ামিন পুলিশের চাহিদা অনুযায়ী যাবতীয় ও সঠিক কাগজপত্র দেওয়ার পরও তার কাছ থেকে দুই হাজার টাকা দাবি করেন ভেরিফিকেশনে যাওয়া এসবির সদস্য।
ইয়ামিন এক হাজার টাকা দিতে চাইলে ওই পুলিশ সদস্য টাকা নেননি এবং ইয়ামিনকে আর কথা বলার সুযোগও দেননি। যাওয়ার সময় এসবি সদস্য ইয়ামিনকে বলে যান- ‘সমস্যা নাই, রিপোর্ট দিয়ে দেবো। আপনি চিন্তা করবেন না।’
কিন্তু নির্ধারিত সময়ে পাসপোর্ট হাতে না পাওয়ায় ইয়ামিন পাসপোর্টের সংশ্লিষ্ট অফিসে যোগাযোগ করেন এবং জানতে পারেন, তার পুলিশ রিপোর্ট তখনো আসেনি। পরবর্তীতে তিনি ফের নিয়ম অনুযায়ী আবেদন করেন এবং এ পর্যায়ে ভেরিফিকেশনে যাওয়া পুলিশ সদস্যকে টাকা দেন। পরে পাসপোর্ট হাতে পান। তবে তিনি ব্যবসায়িক কাজে দ্রুত একটি দেশে যাওয়া দরকার থাকলেও ইতোমধ্যে পাসপোর্ট পেতে দেরি হওয়ায় তার ব্যবসায়িক ক্ষতি হয়।
পাসপোর্ট ইস্যু ও নবায়নের ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশনের সময় হয়রানি, পুলিশের টাকা নেওয়ার প্রবণতা নতুন নয়। ইয়ামিনের মতো অনেকেই এমন ভোগান্তিতে পড়েছেন। এতে চাকরি, চিকিৎসা ও পড়ালেখাসহ বিভিন্ন উদ্দেশ্যে বিদেশ যেতে ইচ্ছুক ব্যক্তিরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। সম্প্রতি পাসপোর্ট ইস্যু ও নবায়নের ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশন বাদ দেওয়ার বিষয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে আলোচনা চলছে। এর মধ্যেই ইয়ামিনকে এমন ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের তথ্যানুযায়ী, পুলিশ প্রতিবেদন-সংক্রান্ত জটিলতার কারণে এই মুহূর্তে প্রায় ১৬ হাজার পাসপোর্ট ইস্যু ও নবায়নের অপেক্ষায় রয়েছে।
এ অবস্থা নিরসনের লক্ষ্যে মঙ্গলবার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব ড. নাসিমুল গণির সভাপতিত্বে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে পাসপোর্ট জটিলতা নিরসনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রণয়ন করা হয়। সভায় বেশিরভাগ প্রতিনিধি পাসপোর্টে ভেরিফিকেশন উঠিয়ে দেওয়ার বিষয়ে মত দিয়েছেন বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। তবে আরেকটি সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। সেই সভার পরই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
আবেদন করে নির্ধারিত সময়ে অনেক পাসপোর্ট প্রত্যাশী পাসপোর্ট পান না। পরবর্তীতে পাসপোর্টের সংশ্লিষ্ট অফিসে যোগাযোগ করে জানতে পারেন, পুলিশ ভেরিফিকেশনের প্রতিবেদন না আসায় পাসপোর্ট তৈরি হয়নি। ফলে ফের আবেদন করতে হয় পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের। এতে গুরুতর অসুস্থ রোগী ও শিক্ষার্থীদের ব্যাপক বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। এমন অভিযোগ পুরনো। শুধুমাত্র পুলিশ প্রতিবেদনের বাধ্যবাধকতা থাকায় নির্ধারিত সময়ে পাসপোর্ট পেতে বিলম্ব ও হয়রানির মুখে পড়তে হয়।
২০১৬ সালের ৩০ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমানের দুই মেয়ের পাসপোর্টের পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য তার ধানম-ির বাসায় উপস্থিত হয়ে পরিচয় লুকিয়ে নিজেকে পুলিশের এসআই সালাম হিসেবে পরিচয় দেন এসবির তৎকালীন এএসআই মো. সাদেকুল ইসলাম। তিনি বিচারপতির স্ত্রী ডা. সাবরিনার কাছে ভেরিফিকেশনের জন্য জনপ্রতি এক হাজার টাকা হিসেবে দুই হাজার টাকা দাবি করেন। এ ঘটনায় বিচারিক আদালতে সাদেকুলের দুই বছরের কারাদ- হয়।
রায়ের অভিমতে হাইকোর্ট বলেছেন, নাগরিকদের পাসপোর্টসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে পুলিশ ভেরিফিকেশন প্রয়োজন হয়। এই পুলিশ ভেরিফিকেশন প্রতিবেদন পেতে নাগরিকদের যথেষ্ট আর্থিক ও মানসিক ভোগান্তি হরহামেশাই পোহাতে হচ্ছে। এই মামলাটি তার একটি অন্যতম দৃষ্টান্ত।
এমন দৃষ্টান্তমূলক রায়ের পরও থেমে নেই ভেরিফিকেশনের নামে ভোগান্তি, পুলিশের ঘুষ দাবি। প্রায়ই ভেরিফিকেশনে যাওয়া পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ উঠে। পাসপোর্টের জন্য ভেরিফিকেশন করতে গেলে পুলিশের কাছে ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা দেওয়ার একটি অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ কাগজে-কলমে এ ধরনের টাকা দেওয়ার বিধান নেই।
আবেদনকারীর তথ্যের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পুলিশ ভেরিফিকেশনের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও তথ্য সংগ্রহের প্রক্রিয়া চলাকালে নানা ধরনের ভোগান্তি, পক্ষপাতমূলক আচরণ এবং ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ এ পদ্ধতিকে কলুষিত করেছে। বিগত সময়ে সরকারগুলো পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে হয়রানি থেকে মুক্তি পেতে নানা উদ্যোগ নিলেও তা কার্যকর হয়নি।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণে পুলিশ ভেরিফিকেশনের জটিলতা নিরসন করে পাসপোর্ট জারি ও নবায়নের নির্দেশনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সভায়। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে জরুরি ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগকে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
জাতীয় পরিচয়পত্র ও জন্ম নিবন্ধন সনদকে পাসপোর্ট ইস্যুর ক্ষেত্রে মূল ভিত্তি ধরা হয়। এ দুটি সঠিক থাকলে পাসপোর্ট দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকার কথা নয়- উপদেষ্টা পরিষদের সভায় এমন মতামত উঠে আসার পরই এ নিয়ে কাজ শুরু করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ।
কতগুলো পাসপোর্ট আদেশ ইস্যু ও নবায়নের অপেক্ষায় রয়েছে তার প্রয়োজনীয় তথ্য চাওয়া হয় বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর এবং পুলিশের বিশেষ শাখায়। পরবর্তী সময়ে জানানো হয়, পুলিশ প্রতিবেদনসংক্রান্ত জটিলতার কারণে প্রায় ১৬ হাজার পাসপোর্ট জারি ও নবায়নের অপেক্ষায় রয়েছে। এর ফলে পাসপোর্ট প্রত্যাশীরা নানা ভোগান্তির সম্মুখীন হচ্ছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, পরবর্তীতে আরেকটি সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
প্রসঙ্গত, গতবছর মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) কর্তৃপক্ষ পুলিশ ভেরিফিকেশন বাদ দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র দেখে পাসপোর্ট দেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দেয়। মন্ত্রণালয় থেকে পুলিশের বিশেষ শাখায় মতামত চাওয়া হলে দ্বিমত পোষণ করে এসবি। অথচ এমআরপি আবেদন ফরমের শেষাংশে যেসব তথ্যের প্রয়োজনীয়তাকে পুলিশ ভেরিফিকেশনের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা রয়েছে, আবেদনপত্রের সঙ্গেই তা জমা দিতে হয়। এসব তথ্য দেওয়ার পর আর পুলিশ ভেরিফিকেশনের প্রয়োজন পড়ে না বলে মত প্রকাশ করেছে কমিশন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা উপজেলা সদরে বসেই পুলিশ প্রতিবেদন প্রস্তুত করেন। এক্ষেত্রে কিছু অনৈতিক কর্মকা-ের অভিযোগও আছে। রিপোর্ট পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক আবেদনকারী হয়রানির শিকার হচ্ছেন। কেননা ওই প্রতিবেদন পেতে এক থেকে দেড় মাসের মতো সময় লেগে যায়।
এ কারণে জরুরি প্রয়োজনে অনেকেই পাসপোর্ট পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তারা আরও জানান, যাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তাদের ছবিসহ তথ্য কম্পিউটারে গোয়েন্দা সংস্থার পাশাপাশি পাসপোর্ট অফিসে জমা দেওয়া হলে লাখ লাখ মানুষকে পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে হয়রানির শিকার হতে হবে না।
এর আগে পুলিশ সংস্কার কমিশন গত ১৯ নভেম্বর জমা দেওয়া সুপারিশে জানায়, চাকরি ও পাসপোর্ট ভেরিফিকেশনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা যাচাই বন্ধের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন সেদিন বলেন, ভেরিফিকেশনের নামে হয়রানি ও দুর্নীতি বন্ধ হওয়া জরুরি। প্রার্থীর বা তার পরিবারের রাজনৈতিক পরিচিতি বিচার করা অযৌক্তিক।