ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২২ মাঘ ১৪৩১

ছাত্রদের বিরুদ্ধে মামলা করেও তাদের অধীনে ডিজি!

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৯:১৩, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ছাত্রদের বিরুদ্ধে মামলা করেও তাদের অধীনে ডিজি!

ছবি : সংগৃহীত

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে সেই আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামের অধীনেই ডাক অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের (ডিজি) দায়িত্ব পালন করছেন এস এম শাহাব উদ্দীন। গ্রেডেশনে জ্যেষ্ঠ না হওয়া সত্বেও এই কর্মকর্তাকে অতিরিক্ত মহাপরিচালক থেকে মহাপরিচালকের চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে পতিত সরকারের প্রতিমন্ত্রী পলকের নির্দেশে। অন্য কর্মকর্তাদের সামনেই পলকের কাছে নিজেকে সাবেক ছাত্রলীগের নেতা পরিচয় দিয়েছেন শাহাব উদ্দীন।

সাবেক সরকারের সময় এই কর্মকর্তাসহ বেশ কয়েকজন মিলে নগদে টাকা পাচারের অপকর্মে সায় দিয়েছেন। এখন অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে এই ডিজি নগদের অপকর্ম আড়াল করতে নানা ফন্দি আঁটছেন। নগদে নিযুক্ত সরকারের প্রশাসক ২ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকা গায়েবের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে মতামত দিলেও দীর্ঘদিন কোনো ব্যবস্থা নেননি ডিজি।

জানা গেছে, অতিরিক্ত মহাপরিচালক থাকাকালে গত ১৭ জুলাই ২০২৪ খ্রি. তারিখে পোস্টাল একাডেমি, রাজশাহীতে প্রশিক্ষণ কর্মশালায় অংশ নিতে যান। পরবর্তীতে ২০ জুলাই ২০২৪ খ্রি. তারিখে তৎকালীন মহাপরিচালকের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে দেশব্যাপী  ছাত্রজনতার লাগাতার অবরোধ আন্দোলনের মধ্যেই সরকার কর্তৃক ঘোষিত কার্ফিউ চলাকালীন কার্ফিউ পাস ছাড়াই ৭২ লাখ টাকা মূল্যমানের সরকারি গাড়িতে (পাজেরো স্পোর্টস) ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা করেন। পথিমধ্যে গাজীপুরের গাছাথানাধীন ছয়দানা সাকিনস্থ হাজীরপুকুর ময়মনসিংহ টু ঢাকা মহাসড়কে আন্দোলনকারী ছাত্র জনতার রোষানলে পড়েন, গাড়ি ভাংচুর হয় এবং একপর্যায়ে গাড়িতে অগ্নি সংযোগ করা হলে সম্পূর্ণ গাড়ি ভস্মীভূত হয়। দেশের এরকম একটা পরিস্থিতিতে গাড়ি বের করা সরকারি সম্পদের অপব্যবহার এবং সাধারণ জনগণের দাবি দাওয়াকে উপেক্ষা /অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখার পরিচায়ক। এছাড়া কার্ফিউ পাস না নেওয়া সরকারি বিধি নিষেধকেও সম্পূর্ণরুপে অগ্রাহ্য করার সামিল। গাড়ি ভাংচুরের সময় অতিরিক্ত মহাপরিচালক শাহাব উদ্দীন আহত হন তাঁর মুখের পাশে গাড়ির কাঁচ লেগে কেটে যায়। দূর্ঘটনার পরে তিনি তাঁর ড্রাইভার তরিকুল ইসলামকে দিয়ে ২৪/০৭/২৪ তারিখে গাছা থানায় একটি এজাহার দায়ের করান (এফআইআর নং- ২০, জিআর নং ১৭৬) এবং সেখানে ২০০/২৫০জন আন্দোলনকারী ছাত্র জনতাকে দূষ্কৃতিকারী আখ্যা দিয়ে আসামি করা হয়।

সরকারি সম্পদ নষ্টে নেই নথি!

ডিজির আদেশ অমান্য করে এবং কারফিউ পাস ছাড়াই বেরিয়ে ৭২ লক্ষ টাকা মূল্যের গাড়ি পোড়ালেও নেওয়া হয়নি বিভাগীয় কোনো ব্যবস্থা। নিয়ম অনুয়ায়ী সরকারি গাড়ি পোড়ানোর বিষয়ে একটা ফাইল ওপেন হওয়ার কথা। যা তদন্ত করে রিপোর্ট দিলে সে আলোকে ব্যবস্থা হওয়ার কথা। কিন্তু সে তথ্য বা সে সম্পর্কিত কোনো প্রতিবেদন তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেননি। এ বিষয়ে কোনো তদন্তও হয়নি। সচিবের জিজ্ঞাসায় শাহাব উদ্দীন গাড়ির মূল্য ৩৬ লক্ষ টাকা বলে উল্লেখ করেন। গ্রেড ওয়ান পদ পাওয়ার জন্য এসব তথ্য গোপন ক‌রে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদনও প্রেরণ করেছেন।

সুস্থ হয়ে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে পলকের অনুষ্ঠানে বক্তব্য 

ডাক অধিদপ্তরে গত ২৭/০৭/২৪ তারিখে ডাক টেলিযোগাযোগ এবং তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এর  নির্দেশে অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। ওই অনুষ্ঠানে প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য "আমি ইন্টারনেট বন্ধ করিনি ,ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেছে" ভাইরাল হয়। সেই অনুষ্ঠানেই তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিচালক শাহাব উদ্দিন তাঁর মুখের কেটে যাওয়া অংশ সেরে যাওয়া সত্বেও একটি ব্যান্ডেজ বেঁধে এসে জুলাই আন্দোলনকারীদেরকে নাশকতা সৃষ্টিকারী, দেশদ্রোহী, দূষ্কৃতিকারী আখ্যা দিয়ে বক্তৃতা দেন।

তিনি বলেন, সরকারি কাজে রাজশাহী থেকে ঢাকা আসার পথে সংঘবদ্ধ দুষ্কৃতকারীরা আমার উপরে হামলা চালায়, আমাকে শারিরীকভাবে আহত করে সরকারি গাড়ি ভাংচুর করে, আগুন দেয়। দেশে যে বিশৃঙ্খলা এরা (বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীরা) সৃষ্টি করেছে, দেশের শান্তি নষ্ট করে সাধারণ জনজীবনকে অচল করর দিয়েছে। তাদের বিচার ও শাস্তি দাবি করি।

ছাত্রলীগ পরিচয়, ডিজি দেখতে চান পলক

প্রতিমন্ত্রী পলকের কাছে নিজেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ছাত্রলীগের সাবেক সমাজকল্যাণ সম্পাদক হিসাবে পরিচয় দিতেন শাহাব উদ্দীন। ছাত্র আন্দোলনের পারফরমেন্সে সন্তুষ্ট হয়ে এবং ছাত্রলীগের ব্যাকগ্রাউন্ড থাকায় প্রতিমন্ত্রী পলক এডিজি শাহাব উদ্দীনকে ডিজি হিসেবে দেখতে চান। প্রতিমন্ত্রী পলকের আনুকূল্যের কারণেই তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত মহাপরিচালক তরুন কান্তি সিকদারকে সরিয়ে এস এম শাহাব উদ্দীনকে মহাপরিচালক পদে আনা হয়। তরুন কান্তি সিকদার গ্রেডেশনে জ্যেষ্ঠ হলেও তাঁকে ফিরে যেতে হয় পূর্বপদে। অথচ ৫ আগস্টের পর শাহাব উদ্দীন নিজেকে বিএনপি-জামায়াতপন্থী হিসাবেই সবার কাছে উপস্থাপন করছেন।

এ বিষয়ে প্রাক্তন এক ডিজি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, হামলার ঘটনাটি দিয়ে তৎকালীন প্রতিমন্ত্রীকে সন্তুষ্ট করেছেন, তাই তিনি তাকে ডিজি করেছেন। 

নগদের অনিয়মের বিরুদ্ধে নেই ডিজির তৎপরতা

মোবাইলে আর্থিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ‘নগদ লিমিটেড’-এ ভুয়া পরিবেশক ও এজেন্ট দেখিয়ে আর্থিক জালিয়াতি এবং অতিরিক্ত ইলেকট্রনিক অর্থ বা ই-মানি তৈরি করা হয়েছে। এসব কারণে ২ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকার হিসাব মিলছে না। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দেওয়া নগদের প্রশাসক মুহম্মদ বদিউজ্জামান দিদার ৫ ডিসেম্বর ডাক অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, ক্ষতিগ্রস্ত ও চুক্তিবদ্ধ পক্ষ হিসেবে ডাক বিভাগ এসব অনিয়ম/চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন/ক্ষতিপূরণের জন্য আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার সংরক্ষণ করে বলে প্রশাসক দল মনে করে। প্রশাসকের আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো এখতিয়ার নেই।

ডাক অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন এ নিয়ে কোনো ব্যবস্থা না নিলেও এই প্রতিবেদক জানতে চাওয়ার পর আইনজীবীর বক্তব্য চেয়েছে অফিসিয়ালি।

এসব বিষয়ে বক্তব্য নিতে গত এক মাস যাবত কখনো আগারগাঁও অফিস, কখনো গুলিস্তান অফিসে চেষ্টা করেও ডাক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এস এম শাহাব উদ্দীনের সাড়া পাওয়া যায়নি। অফিসে থেকেও পিয়ন দিয়ে ‘অফিসে নাই’ বলে বিদায় করে দেন ডিজি। এক পর‌্যায়ে ব্যক্তিগত সহকারীর মাধ্যমে লিখিত প্রশ্ন দেওয়ার পরও গত ২০ দিনে কোনো জবাব দেননি।

সাবেক এক ডিজি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,  নগদের বিষয়গুলো আগে থেকে হয়ে আসছে। অনেক ডিজি বাস্তবতার আলোকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ক্যারি (চলমান) করেছে। তবে বর্তমান ডিজি আগের দায়িত্বে থাকতে নগদ তার অধীনে ছিল। সে কী করছে আমার জানা নেই। 
 
এসব নিয়ে ডাক টেলিযোগাযোগ উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘অর্থ পাচারের বিষয়টা প্রাথমিকভাবে ডাক বিভাগের তদন্তে উঠে এসেছে। তবে মামলার জন্য আগে ডিজিটাল ফরেনসিক পরীক্ষা করা লাগবে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক চারটা প্রতিষ্ঠানকে প্রাথমিকভাবে মনোনীত করেছে।’

প্রাক্তন ডিজি তরুণ কান্তি শিকদার বলেন, ওই সময় আমরা রওয়ানা হয়ে টাঙ্গাইলের কালিহাতিতে পুলিশের সহায়তা নিয়ে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে গেছি। কিন্তু তিনি গাজীপুরে গিয়ে হামলার স্বীকার হন। তার এই যাত্রায় আমার অনুমোদন ছিল না।
 

মো. মহিউদ্দিন

×