ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২০ মাঘ ১৪৩১

দিল্লির বাতাসও ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’

ঝুঁকিপূর্ণ’ বায়ুদূষণে বিশে^র ১২৩ শহরের মধ্যে শীর্ষে ঢাকা

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ২৩:৪৭, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ঝুঁকিপূর্ণ’ বায়ুদূষণে বিশে^র ১২৩ শহরের মধ্যে শীর্ষে ঢাকা

বায়ুদুষণে বিশ্বের ১২৩ শহরের মধ্যে দূষিত শহরের প্রথম স্থানে রাজধানী ঢাকা

বায়ুদুষণে বিশ্বের ১২৩ শহরের মধ্যে দূষিত শহরের প্রথম স্থানে রাজধানী ঢাকা। রবিবার সকাল সাড়ে ৮টায় সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার সূচক থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
সংস্থাটি জানায়, ৩৩৯ স্কোর নিয়ে বায়ুদূষণের তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। অর্থাৎ এখানকার বাতাসের মান বসবাসকারীদের জন্য ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বা দুর্যোগপূর্ণ। এদিন সকালে বায়ুদূষণের তালিকায় ঢাকার আশপাশে কোনো শহরকে দেখা যায়নি। পরের স্থানে থাকা দিল্লির থেকে ১৩৪ পয়েন্টে এগিয়ে ঢাকা।
দ্বিতীয় স্থানে থাকা দিল্লির স্কোর ২০৫, সেখানকার বাতাসও নাগরিকদের জন্য ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’। তৃতীয় স্থানে মিয়ানমারের শহর ইয়াঙ্গুন, তাদের স্কোর ১৯৬। আইকিউএয়ারের ভাষ্য অনুযায়ী, সেখানকার বাতাস বসবাসকারীদের জন্য ‘অস্বাস্থ্যকর’।
বাতাসের গুণমান সূচক (একিউআই) দিয়ে বায়ুদূষণের মাত্রা নির্ধারণ করে নিয়মিত বায়ুদূষণের পরিস্থিতি তুলে ধরে আইকিউএয়ার। বৈশ্বিক মানদ- অনুযায়ী, বায়ুমান সূচক ৫০-এর নিচে থাকলে ‘বিশুদ্ধ বাতাস’ ধরা হয়। ৫১-১০০ হলে তা ‘সহনীয়’। ১০১-১৫০-এর মধ্যে হলে সতর্কতামূলক বা সংবেদনশীল মানুষের (শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তি) জন্য ‘অস্বাস্থ্যকর’। ১৫১-২০০ হলে সবার জন্য ‘অস্বাস্থ্যকর’ এবং সূচক ২০১ থেকে ৩০০ হলে বাতাসকে ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ বলা হয়। আর সূচক ৩০০ ছাড়ালে সেই বাতাস বসবাসকারীদের জন্য ‘ঝুঁকিপূর্ণ বা দুর্যোগপূর্ণ’।
বাংলাদেশে রবিবার ‘দুর্যোগপূর্ণ’ বায়ু বিরাজ  করেছে। কোনো অঞ্চলে পর পর তিনদিন এমন বায়ুর মান থাকলে সেখানে স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। ঢাকায় গত জানুয়ারিতে একাধিক দিন বায়ুর মান ৩০০-এর বেশি উঠেছে।
বায়ুদূষণের পরিস্থিতি নিয়মিত তুলে ধরে আইকিউ এয়ারের তৈরি করা এই লাইভ বা তাৎক্ষণিক সূচক একটি নির্দিষ্ট শহরের বাতাস কতটা নির্মল বা দূষিত, সে সম্পর্কে মানুষকে তথ্য দেয় এবং সতর্ক করে।
এ বিষয়ে সতর্কবার্তায় ঢাকাবাসীর উদ্দেশে আইকিউ এয়ারের পরামর্শ হচ্ছে, বাইরে বের হলে সুস্বাস্থ্যের জন্য অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। খোলা স্থানে ব্যায়াম করা যাবে না। আরও একটি পরামর্শ, ঘরের জানালা বন্ধ রাখতে হবে।
ঢাকার বায়ুদূষণের প্রধান উপাদান হলো বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা বা পিএম ২ দশমিক ৫-এর উপস্থিতি। ঢাকার বাতাসে এর উপস্থিতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মানমাত্রার চেয়ে প্রায় ৫২ গুণ বেশি।
ঢাকার গড় বায়ুমানের স্কোর ৩৩৯ হলেও এলাকাভিত্তিক স্কোর ছিল আরও আকাশচুম্বী। রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকাগুলোর মধ্যে যেসব এলাকায় বায়ুর মান মারাত্মক দূষিত, সেগুলোর মধ্যে ছিল ইস্টার্ন হাউজিং-২ (৬৪১), সাভারের হেমায়েতপুর (৪৫১) ও শানস্তা ফোরামর (৪৪১)।
এ ছাড়া বিভাগীয় শহরগুলোর বায়ুর মানও নাজুক। এর মধ্যে চট্টগ্রামে বায়ুর মান ১৫০, রাজশাহী ১৯৮ ও খুলনায় ১৮৫।
গত ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে একটি দিনও নির্মল বায়ু পায়নি রাজধানীবাসী। দূষণ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ক্যাপসের এক জরিপে দেখা গেছে, ডিসেম্বরে যত বায়ুদূষণ ছিল, তা গত ৯ বছরে সর্বোচ্চ।
আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকার বায়ুতে শ্বাস নিলে প্রতিদিন ২২টি সিগারেট খাওয়ার সমান প্রভাব পড়ছে। মানবসৃষ্ট সংকটগুলোর মধ্যে সবার আগে রয়েছে বায়ুদূষণ। এমনকি দেশের গ্রামীণ এলাকাগুলোও এই দূষণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর এই দূষণের প্রধান কারণগুলো হচ্ছে অবাধে চলাচল করা পুরোনো যানবাহনের ধোঁয়া, অবৈধ ইটভাঁটি ও নির্মাণকাজের ধূলিকণা এবং শিল্পকারখানা থেকে নির্গত ক্ষতিকর বর্জ্য।
ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে বায়ুদূষণের ফলে শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ, হৃদ্রোগ, স্ট্রোক ও ফুসফুসের ক্যান্সারের মতো গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে চলেছে। ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হওয়ায় তারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। শহরের বাসিন্দা ও শিল্পকারখানার কর্মীদের জন্যও এ সমস্যা আরও উদ্বেগজনক।
শহরের বায়ুতে উপস্থিত ক্ষুদ্র কণা (পিএম ২ দশমিক ৫) মানুষের শ্বাসতন্ত্র ও ফুসফুসকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, যা দীর্ঘ মেয়াদে প্রাণঘাতী রোগের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এমন অবস্থায় ঢাকাবাসীর জীবনযাত্রার মান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শিশু, বয়স্ক ও স্বাস্থ্যগত সমস্যায় ভুগছেন এমন ব্যক্তিরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুদূষণ কেবল স্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে এমন নয়; বরং একইসঙ্গে উৎপাদনশীলতা হ্রাসের প্রধান কারণও এটি। দূষণের কারণে একদিকে স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় বাড়ছে, অন্যদিকে কর্মক্ষম জনশক্তি কমে গিয়ে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে স্বাস্থ্য ও অর্থনীতিতে এই সংকটের দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

তাই এ সংকট কাটিয়ে উঠতে আমাদের সবার সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।
এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স (একিউএলআই) অনুযায়ী, ক্ষুদ্র কণার (পিএম ২ দশমিক ৫) এই বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ু ৪ দশমিক ৮ বছর কমছে। এই সূক্ষ্ম কণা শ্বাসতন্ত্রে প্রবেশ করে শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে; দীর্ঘ মেয়াদে হৃদ্রোগ ও ফুসফুসের নানা প্রাণঘাতী রোগ সৃষ্টি করে যাচ্ছে।
বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে গাড়ির টেইলপাইপ থেকে নির্গত ধোঁয়া। বিশেষ করে পিএম ২ দশমিক ৫ ও পিএম ১০-এর মতো ক্ষুদ্র কণা গাড়ির টেইলপাইপ থেকে নির্গত হয়। এর মধ্যে এককভাবে পিএম শূন্য দশমিক ২ নিঃসরণের সর্বোচ্চ উৎস এই টেইলপাইপ। এ অবস্থায় শহরের বায়ুদূষণ কমাতে ও জনস্বাস্থ্য রক্ষা করতে হলে টেইলপাইপ নিঃসরণ কমাতেই হবে।
এই দুষণ থেকে পরিত্রান পেতে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হলো- যানবাহনের বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর নীতিমালা, যানবাহনের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং পরিবেশবান্ধব পরিবহনের প্রসার ঘটানো আমাদের জন্য খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। একই সঙ্গে ইটভাঁটি, নির্মাণ ও শিল্প খাত থেকে হওয়া বায়ুদূষণের মাত্রা কমিয়ে আনতে হলে আমাদের পরিবেশবান্ধব নীতি ও কৌশল প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত জরুরি। নির্মাণকাজের সময় যেন ধুলাবালি উড়ে বায়ুদূষণকে আরও বাড়াতে না পারে, সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন হতে হবে।

×