ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৯ মাঘ ১৪৩১

অমর একুশে বইমেলা উদ্বোধনীতে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস

মহান আত্মত্যাগে অর্জিত গণঅভ্যুত্থান বইমেলায় নতুন তাৎপর্য এনেছে

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ২২:৪৯, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

মহান আত্মত্যাগে অর্জিত গণঅভ্যুত্থান বইমেলায় নতুন তাৎপর্য এনেছে

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস শনিবার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অমর একুশে বইমেলা উদ্বোধন করেন

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, মহান আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত অভ্যুত্থান এবারের বইমেলায় আমাদের সামনে নতুন তাৎপর্য নিয়ে এসেছে। বরকত, সালাম, রফিক, জব্বারের রক্তে যে অঙ্গীকার মাখা ছিল, তাতে ছিল জুলাই অভ্যুত্থানকে নিশ্চিত করার মহাবিস্ফোরক শক্তি।

অর্ধশতাব্দী পর এই মহাবিস্ফোরণ গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে দেশকে পাল্টে দিল। এই বিস্ফোরণ আমাদের ১৭ কোটি মানুষের সত্তায় নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় প্রোথিত করে দিয়ে গেছে। অমর একুশের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এ প্রত্যয় শপথ নিতে এসেছি।
শনিবার বিকেলে বাংলা একাডেমিতে মাসব্যাপী অমর একুশে বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, একুশ মানে আত্মপরিচয়ের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়া। একুশ মানে অবিরাম সংগ্রাম। নিজের পরিধিকে আরও বাড়িয়ে নেওয়া। এবারের একুশের প্রেক্ষিত আমাদের নতুন দিগন্তে প্রতিস্থাপন করেছে।
এ বছর বইমেলার প্রতিপাদ্য ‘জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান এবং তার মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ’। বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ও সচিব (রুটিন দায়িত্ব) মো. মফিজুর রহমান।

স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম এবং শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন প্রকাশক প্রতিনিধি মো. রেজাউল করিম বাদশা। অনুষ্ঠানের শুরুতেই জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
এবারের বইমেলায় ৭০৮টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান অংশ নিচ্ছে। এর মধ্যে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ৯৯টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৬০৯টি। প্যাভিলিয়ন ৩৭টির মধ্যে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে একটি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৩৬টি থাকবে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জাতির ঘাড়ে দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে চেপে থাকা স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটেছে। আমাদের সাহসী তরুণদের এই অভূতপূর্ব আত্মত্যাগ বিশ্বকে চমকে দিয়েছে। এই বিজয়ের মাধ্যমে এসেছে নতুন বাংলাদেশ গড়ার ইস্পাতকঠিন প্রতিজ্ঞা।’ এ সময় প্রধান উপদেষ্টা জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে যেসব দুঃসাহসিক ছাত্র-জনতা-শ্রমিক প্রাণ দিয়েছেন এবং গুরুতর আহত হয়েছেন, তাঁদের গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। 
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, অমর একুশে বইমেলার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা এই প্রত্যয়ে শপথ নিতে এসেছি। একুশ আমাদের মূল সত্তার পরিচয়, একুশ আমাদের ঐক্যের দৃঢ় বন্ধন। এই বন্ধন ছোট-বড়, যৌক্তিক-অযৌক্তিক, ক্ষণস্থায়ী-দীর্ঘস্থায়ী সকল দূরত্বের ঊর্ধ্বে। এজন্য সকল প্রকার জাতীয় উৎসবে, সংকটে, দুর্যোগে আমরা শহীদ মিনারে ছুটে যাই। যেখানে আমরা স্বস্তি পাই, শান্তি পাই; আমরা সমাধান পাই। সাময়িকভাবে অদৃশ্য ঐক্যকে খুঁজে পাই। একুশ আমাদের মানুষকে এভাবে  তৈরি করে দিয়েছে।
তিনি বলেন, একুশ আমাদের পথ দেখায়। মাত্র ছয় মাস আগে জুলাই অভ্যুত্থান জাতিকে ঐতিহাসিক গভীরতায় ঐক্যবদ্ধ করে দিয়েছে, যার কারণে আমরা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রাতিষ্ঠানিক এবং মানবিক দিক থেকে বিধ্বস্ত এই দেশকে দ্রুততম গতিতে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য  তৈরি করার প্রস্তুতি নিতে সাহস পেয়েছি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, একুশের টান বয়সের ঊর্ধ্বে, প্রজন্মের ঊর্ধ্বে। একুশ প্রজন্মের পর প্রজন্ম বিস্তৃত হয়েছে। শুধুই তাই নয়, এটা গভীরতর হয়েছে। আমাদের দুঃসাহসী করেছে। ছাত্রজনতার অভ্যুত্থান তার জ্বলন্ত প্রমাণ। দুঃস্বপ্নের বাংলাদেশকে ছাত্র-জনতা নতুন বাংলাদেশে রূপান্তর করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তারা অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছে। আমাদের তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরীরা রাস্তার দেওয়ালে তাদের স্বপ্নগুলো, তাদের আশঙ্কাগুলো, তাদের দাবিগুলো অবিশ্বাস্য দৃঢ়তায় এঁকে দিয়েছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনুস বলেন, আমাদের রাস্তার দেওয়াল এখন ঐতিহাসিক দলিলে রূপান্তর হয়েছে। এগুলোর স্থান এখন আমাদের বুকের মধ্যে এবং জাদুঘরে হওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। আমি অভিনন্দন জানাচ্ছি বইমেলার উদ্যোগকে। তারা এই দেওয়ালচিত্রগুলো আসা এবং যাওয়ার পথে খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছে। বাংলা একাডেমি আয়োজিত এই বইমেলা আমাদের জাতীয় জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। ক্রমে ক্রমে এর গুণগত এবং আয়োজনগত পরিবর্তন হয়েই থাকবে।
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, বাংলা একাডেমি আয়োজিত বইমেলা আমাদের জাতীয় জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। ক্রমে ক্রমে এর গুণগত ও আয়োজনগত বিবর্তন হতেই থাকবে। বইমেলায় হাজির করার জন্য লেখক লেখিকারা সারা বছর প্রস্তুতি নিতে থাকেন যথাসময়ে নিজ নিজ বই সমাপ্ত করার জন্য।

প্রকাশকরা অনেক আয়োজন করেন নিজেদের বইগুলো যথাসময়ে হাজির করার জন্য। তাই গুণগত প্রতিযোগিতা সৃষ্টির জন্য এবং আগ্রহ বাড়ানোর জন্য প্রতিবছর বিষয়ভিত্তিক সেরা লেখক স্বীকৃতি আয়োজন করলে সেরা লেখক ও সেরা প্রকাশক হওয়ার জন্য অনেক সহায়ক হবে। আমি তাই এই প্রস্তাব দিচ্ছি।
তিনি বলেন, আমরা যদি একুশের ভাষা আন্দোলনকে আরও গভীরতর প্রেক্ষিতে স্বাধিকার আন্দোলন হিসেবেও দেখি, তাহলে অমর একুশের গণ্ডি বৃহত্তর হয়ে দাঁড়ায়। তখন আমরা ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের তাদের সৃজনশীলতার জন্য স্বীকৃতি দিতে পারি।

নতুন উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য স্বীকৃতি দিতে পারি। শহর ও গ্রামের নারী পুরুষকে কৃষি, শিল্প, সাংস্কৃতিক জগত, বিজ্ঞান, বাণিজ্য, শিক্ষা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে যারা নির্দিষ্ট বছরে জাতির জন্য অবদান রেখেছন, তাদের স্বীকৃতি দিতে পারি। তাদের জন্য আনুষ্ঠানিক আয়োজন করে দিতে পারি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা প্রবাসী বাংলাদেশীদের অবদানের জন্য স্বীকৃতি দিতে পারি। সারা পৃথিবীজুড়ে নানা কাজে বাংলাদেশিরা কৃতিত্ব দেখাচ্ছেন। আমরা একুশের দিনে তাদের স্মরণ করতে চাই। তারা সবাই একুশের দিনে নিজের দেশকে স্মরণ করেন। সব সময় অনুষ্ঠান করে। তারা আমাদের পরিবারের অংশ হিসেবে তাদের সন্তান-সন্তুতির কাছে বাংলাদেশকে পরিচয় করিয়ে দেন।
সাত কবি-লেখককে পুরস্কার ॥ মাসব্যাপী ‘অমর একুশে বইমেলা’ উদ্বোধনের দিন শনিবার দেশের সাত কবি-লেখকের হাতে ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ২০২৪’ তুলে দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এসময় প্রত্যেককে তিন লাখ টাকার চেক, সম্মাননাপত্র ও সম্মাননা স্মারক তুলে দেওয়া হয়েছে।
এবছর এই পুরস্কারের জন্য প্রথমে মনোনীত ১০ জনের নাম প্রকাশ করে বাংলা একাডেমি। তবে সেই তালিকা নিয়ে বিতর্ক শুরু হলে তা স্থগিত করা হয় এবং চারদিন পর তিনজনকে বাদ দিয়ে নতুন করে তালিকা প্রকাশ করা হয়; যা নিয়েও ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়। শনিবার বিকালে অমর একুশে বইমেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে অবশেষে আলেচিত সেই পুরস্কার তুলে দেওয়া হলো।
‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার-২০২৪’ প্রাপ্তরা হলেন- মাসুদ খান (কবিতা), শুভাশিস সিনহা (নাটক ও নাট্যসাহিত্য), সলিমুল্লাহ খান (প্রবন্ধ/গদ্য), জি এইচ হাবীব (অনুবাদ), মুহম্মদ শাহজাহান মিয়া (গবেষণা), রেজাউর রহমান (বিজ্ঞান) ও  সৈয়দ জামিল আহমেদ (ফোকলোর)। এই সাতজনের হাতেই অনুষ্ঠানে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়।

×