দুর্বল লা নিনার কারণেই এবার জেঁকে বসতে পারেনি শীত
দুর্বল লা নিনার কারণেই এবার জেঁকে বসতে পারেনি শীত। বিষেজ্ঞরা বলছেন, যে দাপটের সঙ্গে লা নিনা আসার কথা ছিল শেষ পর্যন্ত আসেনি। বলা যায়, শীতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে লা নিনা। ফলে লা নিনা নিয়ে নতুন করে চিন্তার কারণ নেই। বরং উদ্বেগের কারণ হচ্ছে ফেব্রুয়ারির শুরু থেকেই উধাও হচ্ছে শীত। প্রতিবছর যেভাবে বাংলায় শীতের আমেজ তৈরি হয় এবারে সেটা হলো না। তারা বদলে তৈরি হয়েছে বিপরীতমুখী বায়ু। ফলে সকাল বেলা দরজা খুলতেই দেখা যাচ্ছে হিমেল হাওয়ার বদলে বইছে হাওয়া।
বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, লা নিনার দুর্বল প্রভাবে এবার ঝড়বৃষ্টির আশঙ্কা অনেক বেশি। কালবৈশাখীর সময় আসার আগেই বেশ কয়েকটি বড় ঝড়বৃষ্টি দেখতে পারে বাংলাদেশ। শুধু বাংলাদেশই নয়, বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশের ওপরও লা নিনার এ ধরনের প্রভাব থাকবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি বছরে নিজের পথ বদলে নিয়েছে লা নিনা। ফলে সেখানে থেকে যখন শীতের আমেজ থাকার কথা সেখান থেকে গরম অনুভব হচ্ছে। চলতি বছরে ফের শীত আসবে কিনা তা নিয়েও তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। হঠাৎ করে এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে প্রতিটি মানুষের দেহে নানা ধরনের রোগ তৈরি হতে পারে। সেটাও বাড়তি মাথাব্যথা হিসাবে সামনে আসবে।
তবে আবহাওয়াবিদরা মনে করছেন, বর্তমান অবস্থান থেকে ফের সরে যাচ্ছে লা নিনা। যদি সে ফের নিজের অবস্থানে জায়গায় ফিরে যেতে পারে তাহলে ফের শীত ফিরতে পারে। যদিও সেই সম্ভাবনা যথেষ্ট কম। ফেব্রুয়ারি থেকেই বিদায় নিয়েছে শীত।
বিগত বছরেও খেলা দেখিয়েছে এল নিনো। ১৭৪ বছরের মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণ বছরের রেকর্ড গড়েছে ২০২৪ সাল। দেশে বৃষ্টিপাত অনেক বেড়েছে। বেশি বৃষ্টিতে প্রবল বন্যায় দেশর দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মাথায় হাত পড়েছে ওই অঞ্চলের কৃষকদের।
সেই বিবেচনায় আবহাওয়াবিদরা মনে করেছিল, এবার লা নিনার প্রভাব অনেক বেশি থাকবে। শীত এবার অনেক বেশি জোরালো এবং দীর্ঘস্থায়ী হবে। তবে সকলের চোখে ধুলা দিয়েছে লা নিনা। প্রশান্ত মহাসাগর থেকে যে শীতের পরশ নিয়ে আসার কথা ছিল তা থেকে বিরত হয়েছে লা নিনা।
ফলে জানুয়ারির শেষে আশাভঙ্গ হতে হচ্ছে আবহাওয়াবিদদের। আবহবিদরা মনে করছেন, এবার লা নিনার প্রভাব পড়তে পারে ৬০ শতাংশ। তাই ফেব্রুয়ারি থেকে ধীরে ধীরে বিদায় নিতে পারে শীত। সেখানে হয়তো মার্চ থেকেই ফের গরমের ঝলক দেখতে হতে পারে। তবে লা নিনা যদি শতভাগ সক্রিয় হত তাহলে এই পরিস্থিতি হয়তো তৈরি হতো না।
২০২৩-২৪ সালের এল নিনো যেভাবে গরম এবং তারপর বৃষ্টি দিয়েছে, সেখানে এবার অনেক বেশি জোরালো হওয়ার কথা ছিল লা নিনা। কিন্তু তা হয়নি বরং পরিস্থিতি একেবারে উল্টে গেছে। ফলে মিলছে না আবহাওয়ার কোনো পূর্বাভাসও।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি ঘটেছে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে। টানা এক দশকে ধরে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি রেকর্ডের পর রেকর্ড করে চলেছে। সব রেকর্ড ছাড়িয়ে নতুন রেকর্ড হয়েছে সদ্য সমাপ্ত ২০২৪ সালে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তন প্রকট হয়ে জলবায়ু সংকটে পরিণত হয়েছে। এতে বিশ্বজুড়ে জলবায়ু সংকটের বিরূপ প্রভাব তীব্র থেকে তীব্রতার হচ্ছে।
পুরো পৃথিবী জলবায়ু সংকটের আবর্তে আটকে গেছে। এই আবর্ত কোনোভাবেই বেরোতে পারছে না বিশ্ব। তারই প্রতিফলন ঘটেছে লা নিনার ক্ষেত্রে। বাংলাদেশও এই প্রভাবের বাইরে নয়, যার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে শীতের ভরা মৌসুমে।
এই পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক মনে করছেন না আবহাওয়াবিদরা। তারা বলছেন, এবার পুরো মৌসুমে সেভাবে শীতের প্রকোপ অনুভূত হয়নি। এবার সেভাবে শৈত্যপ্রবাহও দেখা যায়নি। প্রতিবার তীব্র শৈত্যপ্রবাহে দেশের মানুষ নাস্তানাবুদ হলেও এবার তা লক্ষ্য করা যায়নি। একবারের জন্যও এবার তীব্র শৈত্যপ্রবাহের কবলে পড়েনি গোটা দেশের মানুষ। উল্টো এখন জানুয়ারির শেষে এসে শীতও পাততাড়ি গোটাতে শুরু করেছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ওয়েদার অবজারভেশন টিমের (বিডব্লিউওটি) প্রধান আবহাওয়া গবেষক খালিদ হোসেন বলেন, ‘ফেব্রুয়ারির শুরু থেকেই বাংলাদেশ আস্তে আস্তে গরমের দিকে যাবে। বিশেষ করে আগামী মাসের মাঝামাঝি থেকে পুরোদমে গরম পড়া শুরু করবে। তবে ফেব্রুয়ারির প্রথম ১৫ দিন গরম গরম অনুভূত হলেও ভোর রাতের দিকে শীত অনুভূত হবে।’
একই কথা জানান অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ শাহনাজ সুলতানা। তিনি বলেন, ‘জানুয়ারির পর থেকেই আস্তে আস্তে শীত বিদায় নেবে।’
মিলছে না আবহাওয়ার পূর্বাভাস ॥ জলবায়ুর আচরণ ওলটপালট হওয়ায় আবহাওয়ার কোনো পূর্বাভাস মিলছেন। এই অমিল শুধু আভ্যন্তরীণ-ই নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও ঘটছে।
শীতল প্রশান্ত মাহসাগরীয় স্রোত লা নিনা গঠনের ক্ষেত্রেও মেলেনি পূর্বাভাস। ২০২৪ সালের মার্চে এল নিনো- সাউর্থান ওসিলেশন (ইএনএসও) এলার্ট সিস্টেম বলেছিল, ‘লা নিনা তৈরি হতে পারে এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর। এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণ বলছে, জুনের শুরুতেই লা নিনা দেখা দিতে পারে। তবে শক্তিশালী হয়ে উঠবে আগস্ট সেপ্টেম্বরে। লা নিনার প্রভাবে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হবে পূর্ব আফ্রিকা, পূর্ব এশিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে।
বাস্তবে ওই বছরের মে মাস থেকে এল নিনো নিরপেক্ষ অবস্থায় যায়। এই নিরপেক্ষতা ভাঙতে অনেক সময় নেয়। ফলে নিরপেক্ষ অবস্থায় সত্ত্বেও বিশ্বজুড়ে এল নিনোর তীব্র প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। যার ফলশ্রুতিতে ২০২৪ সালে বৈশ্বিক উষ্ণতার নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়।
নিরপেক্ষ অবস্থা ভেঙ্গে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে এসে লা নিনার সূত্রপাত হয়। তখনো আবহাওয়াবিদরা আশঙ্কা করছিলেন, শীত থেকেই তার প্রভাব শুরু করবে লা নিনা। তাপমাত্রার তীব্রতা হ্রাস পেয়ে শীত চরম আকার ধারণ করবে এবং বর্ষা ঋতুর শেষ দিকে গিয়ে ভারি বৃষ্টিপাত হবে।
ওই বছরের ডিসেম্বরে শেষে এসে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা বলেছিল, আগামী তিন মাসে লা নিনা কার্যকর হতে পারে। আর তারই জেরে বদলে যেতে পারে আবহাওয়া। যদিও আবহাওয়াবিদদের একাংশের এ ব্যাপারে দ্বিমত ছিল। তাদের পূর্বাভাস ছিল, এবছর লা নিনা দুর্বল হবে এবং এই বছর লা নিনার সম্ভাবনা থাকবে ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত।
শেষ পর্যন্ত সব পূর্বাভাসকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ২৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর থেকে ২৫ সালের ৫ জানুয়ারি সময়ে প্রশান্ত মহাসাগরে লা নিনা হওয়ার জন্য যে ঠান্ডা ¯্রােত হওয়া দরকার সেই ক্রাইটেরিয়া পূর্ণ করে এবং এবারের শীত দুর্বল অবস্থায় আবির্ভূূত হয়।
গত বছরের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তিন মাসের দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে আবহাওয়া অফিস জানিয়েছিল, ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝে মোট ১২টি শৈত্যপ্রবাহ ও শিলাবৃষ্টি হতে পারে। সে সময় বলা হয়, এই সময়ের মাঝে অন্তত তিনটি, সর্বোচ্চ আটটি মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। তবে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে তিন-চারটি তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বইতে পারে। কিন্তু আবহাওয়ার পূর্বাভাসের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন, এর আগে গত বছরের ডিসেম্বরের শেষ দিকে একটি এবং জানুয়ারিতে ৩টি মৃদু ও মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহ হয়েছে। অপরদিকে, ফেব্রুয়ারি থেকেই শীত বিদায় নেওয়ার তথ্য জানিয়েছেন। এখানে দেখ যাচ্ছে, বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের দেয়া আভ্যন্তরীণ পূর্বাভাসও মিলছে না।
এবার শীতকালের দ্বিতীয় মাস জানুয়ারিতে পূর্বাভাস অনুযায়ী শৈত্যপ্রবাহ হয়নি। কিন্তু শীতকালে কনকনে ঠান্ডা বলতে যা বোঝায়, তা এবার শুধু দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষই টের পেয়েছে। তবে ওই দুই অঞ্চলের কোনো কোনো স্থানে ঠান্ডার অনুভবটা বেশি হলেও তার পেছনের কারণ কোনো শৈত্যপ্রবাহ নয়। আবহাওয়াবিদদের বলছেন, উত্তরাঞ্চলে ঠান্ডা পড়ছে কুয়াশার কারণে। অবশ্য গত বছরের ডিসেম্বরেই বলা হয়েছিল, কুয়াশার কারণে শীতের অনুভূতি বেশি হবে।
তারা আরও বলছেন, এবছর দেশে শৈত্যপ্রবাহের সংখ্যা কম। ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মিলিয়ে এখন অবধি বাংলাদেশ চারটি শৈত্যপ্রবাহ দেখেছে। যদিও সেগুলোর সবই ছিল মৃদু ও মাঝারি মাত্রার শৈত্যপ্রবাহ এবং তার প্রভাব পড়েছে কেবল ওই উত্তর-পূর্বাঞ্চলেই।
আবহাওয়াবিদ ড. মো. বজলুর রশিদ বলছেন, ‘এবছর মূলত রংপুর ও রাজশাহী বিভাগে এবং সেইসঙ্গে যশোর ও কুষ্টিয়ায় শৈত্যপ্রবাহ দেখা গেছে। শৈত্যপ্রবাহের সংখ্যা কমে গেলেও সামগ্রিকভাবে শীত কম। কুয়াশার কারণে কোথাও কোথাও শীতের তীব্রতা দেখা গেছে।’
শীত বাড়ার কারণ হিসাবে আবহাওয়াবিদরা বলছেন, লম্বা সময় ধরে ঘনকুয়াশা পড়লে সূর্যের আলো ভূপৃষ্ঠে পড়ার সুযোগ পায় না। ফলে তা ভূমিকে উষ্ণ করতে পারে না এবং শীত বেশি লাগে। এর সঙ্গে সূর্যের দক্ষিণায়ন বা সূর্যের আলোর প্রাপ্যতা কমে যায়। সাধারণত সূর্যের আলোর প্রাপ্যতা সাধারণত আট থেকে ১০ ঘণ্টা হওয়ার কথা। কিন্তু কুয়াশা বেশি হলে এবং বেশিক্ষণ থাকলে ভূপৃষ্ঠ সূর্যের আলো পায় পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা। এগুলোকেই শীত বাড়ার একটি কারণ হিসাবে উল্লেখ করছেন তারা।
আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ বলেন, ‘গত কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, রাতের তাপমাত্রা কমছে না। গতবারও ঘন কুয়াশার কারণে দুই সপ্তাহের মতো দিনের তাপমাত্রা কমে গেছে।’
তিনি বলেন, বাংলাদেশে গত কয়েকবছরে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ আসছে না। এ বছর শীতের সময়ে ওপর থেকে যে হিমেল হাওয়া নিচে নেমে আসার কথা। তার জন্য পশ্চিমা লঘুচাপ থাকতে হয়। পশ্চিমা লঘুচাপ তৈরি হয় ভূমধ্যসাগরে। ওখান থেকে কাশ্মীর হয়ে দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। কিন্তু ওদিক থেকে এবার বাতাস ঢুকতে পারেনি।’
আবহাওয়াবিদরা এই ঘটনাকে ব্যতিক্রম হিসাবে উল্লেখ করেছেন। তারা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের ব্যাতিক্রমী আবহাওয়া দেখা যায়নি। এ প্রসঙ্গে আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘কাছাকাছি সময়ে এরকম আবহাওয়া দেখিনি। এ বছর সারাদেশের কোথাও সেভাবে শীত পড়েনি। ‘উত্তরবঙ্গে যে ঠান্ডা লেগেছে, তা শৈত্যপ্রবাহের কারণে না। ওখানে শৈত্যপ্রবাহ ছিলই না কয়েকদিনে। ওখানে দিনেরবেলা সূর্য নাই, তাই সেখানে তাপমাত্রা কম এবং মানুষের শীতের অনুভূতি বেশি।’
তিনি বলেন, ‘রাতের তাপমাত্রা ১০-এর ওপরে থাকুক বা যা-ই থাকুক, আর দিনেরবেলা যদি সূর্য না ওঠে, তাপমাত্রা ১৫ এর কাছাকাছি থাকে। তাহলে শীতের অনুভূতি তীব্র হবে। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর কুয়াশা বেশি ছিল না। অন্যান্য বছর টানা কয়েক দিন কুয়াশা থাকে, সূর্যের আলো দেখা যায় না। এ বছর শুধু রংপুরেই দুই একদিন ধরে কুয়াশা দেখা গেছে। কিন্তু দেশের বেশিরভাগ জায়গায় রোদ বেশি পাওয়া গেছে। আর কুয়াশার প্রভাব কম থাকার কারণেও মানুষের শীতের অনুভূতিও কম হয়েছে।’
শৈত্যপ্রবাহ কম হওয়ার হওয়ার আরেকটি কারণ, বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপের আনাগোনা। আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক বলেন, ‘এবার ডিসেম্বরের পুরোটা সময় জুড়েই দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপের আনাগোনা ছিল। দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ থাকার কারণে এই পুরো অঞ্চলটায় তাপ বেশি ছিল। সে কারণে শীতের মাত্রা জোরালোভাবে আসতে পারেনি।’
এর পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনের ভূমিকা কতটা? জানতে চাইলে ওমর ফারুক বলেন, ‘কোনোকিছু দীর্ঘমেয়াদে হলে জলবায়ু পরিবর্তন বলা যায়। এক দুই বছরের পরিবর্তন জলবায়ু পরিবর্তন না। আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।’
তবে আবহাওয়া অফিস বিশ্লেষণ করে দেখেছে, ১৯৭১ থেকে ২০০০ সাল, এই ৩০ বছরে বাংলাদেশের যে তাপমাত্রা এবং ১৯৯১ থেকে ২০২০ সাল, ৩০ বছরের যে তাপমাত্রা, তা তুলনা করলে দেখা যায় যে সাম্প্রতিক সময়ে সারা বছরের তাপমাত্রাই বেড়েছে ও বৃষ্টিপাত কমেছে।
শীত কম পড়ার কারণ উল্লেখ করে বাংলাদেশ ওয়েদার অবজারভেশন টিমের (বিডব্লিউওটি) প্রধান আবহাওয়া গবেষক খালিদ হোসেন বলেন, এই বছরটা গেছে নিউট্রাল টু লা নিনা এয়ারের দিকে। সাধারণত লা নিনা এয়ারের মধ্যে থাকলে শীত কম পড়ে। শীতকালে বাতাস ভূমি থেকে সাগরের দিকে যায়। কিন্তু ওয়েস্টার্ন ডিস্টার্বেন্সের কারণে ভূমি থেকে সাগরে বাতাস যাওয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে। ফলে শীতকাল হওয়াটাও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
তিনি বলেন, কুয়াশা বেল্টের কারণেও শীত কম পড়েছে। কুয়াশা বেল্ট থাকলে ওপরের দিকে ঢেকে থাকে। এর ফলে শহর বা লোকাল অঞ্চল থেকে যে গরম বাতাস বের হয়, সেটা আর ওপরের দিকে যেতে পারে না। গরম বাতাস ওপরে যেতে না পারার কারণে হিট ডোমের মতো কাজ করে বা কুয়াশা বেল্টে বাতাসটা আটকা থাকে। এর ফলে শক্তিশালী শৈত্যপ্রবাহ তৈরি হতে পারে না। শীত অনুভূত হলেও শৈত্যপ্রবাহ সেভাবে হয় না। এই কারণগুলোতেই এ বছর শীত কিছুটা কম অনুভূত হয়েছে।
উল্লেখ্য, শীতকালে বাংলাদেশে যে ঠান্ডা বাতাস প্রবাহিত হয় তা ভারতের দিল্লি, উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
গরমের দাপট নিয়ে চিন্তায় আবহাওয়াবিদরা ॥ দুর্বল লা নিনার ফল হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা করছেন আবহাওয়াবিদরা। তারা বলছেন, লা নিনা দুর্বল হয়ে যাওয়ায় হতে পারে উল্টো ফল। আশঙ্কা করা হচ্ছে এ বছর ঠান্ডা কম হবে কিন্তু উষ্ণতা রেকর্ড ভেঙে দিতে পারে।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিওএমও) থেকেই একই ধরনের আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। সংস্থাটি সতর্ক করেছে যে, লা নিনা এবং এল নিনোর মতো প্রাকৃতিক জলবায়ু ঘটিত ঘটনা মূলত বিশ্বজুড়ে মনুষ্যসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘটছে। মানুষের তৈরি পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের তাপমাত্রা বাড়ছে। এর ফলে মৌসুমি বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রার ধরনে আমূল পরিবর্তন হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার মহাসচিব সেলেস্তে সাওলো বলেন, ২০২৪ সাল এল নিনো দিয়ে শুরু হয়েছিল এবং এটি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে উষ্ণ বছরের রেকর্ড গড়েছে। কিন্তু এবছর লা নিনা কার্যকর হলেও, এর স্বল্পমেয়াদি শীতল প্রভাব বায়ুম-লে গ্রিনহাউস গ্যাসের কারণে উষ্ণতা বৃদ্ধি ঠেকানোর জন্য যথেষ্ট নয়।
তিনি আরও বলেন, মে মাস থেকে এল নিনো বা লা নিনা না থাকা (নিরপেক্ষ অবস্থা) সত্ত্বেও অস্বাভাবিক আবহাওয়া লক্ষ্য করা গেছে। এতে রেকর্ড ভাঙা বৃষ্টি ও বন্যার মুখে পড়তে হয়েছে মানুষকে। পরিবর্তিত আবহাওয়ায় এ ধরনের ঘটনা যদিও ক্রমশ সাধারণ হয়ে উঠছে।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে সমুদ্রকে শীতল করা কঠিন হয়ে পড়ছে। ফলে লা নিনার প্রভাবে শীত সঠিকভাবে না পড়ায়, সেটা আগামী দিনে বিশ্ব উষ্ণায়নের দিকে অনেক বড় প্রভাব ফেলতে পারে।
লা নিনা ও এল নিনোর প্রভাব ॥ এল নিনো এবং লা নিনা উভয়ই প্রতি বছর সমগ্র বিশ্বকে প্রভাবিত করে। আবহাওয়াবিদদের ব্যাকরণে এল নিনো এবং লা নিনা এই দুই পরিস্থিতিই একে অন্যের বিপরীত, তৈরি হয় প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে। সাধারণত ‘এল নিনো’ বা ‘লা নিনা’-র প্রভাবে দুই প্রকারই চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার মুখে পড়তে হয় পৃথিবীর মানুষকে।
তাদের কখনো পড়তে হয় খরার মুখে, কখনো বা অতিবৃষ্টি বন্যার মুখে, এমনকি সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে দেখা দেয় ঘূর্ণিঝড়ও। লা নিনা এবং এল নিনো সাধারণত ৯ থেকে ১২ মাসের মধ্যে স্থায়ী হয়, কিন্তু কখনো কখনো দুই বছর পর্যন্ত চলতে পারে।
লা নিনা কী ॥ প্রকৃতপক্ষে, প্রশান্ত মহাসাগরে ঘটতে থাকা একটি ঋতু প্যাটার্নকে লা নিনা বলা হয়। এই সময়কালে, নিরক্ষীয় প্রশান্ত মহাসাগরে সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা গড়ের চেয়ে শীতল হয়ে যায়। লা নিনা দুর্বল হয়ে পড়লে প্রচ- তাপ সৃষ্টি হয়। ‘লা নিনা’ একটি স্প্যানিশ শব্দ। মানে ছোট মেয়ে। পেরু, ইকুয়েডর উপকূলেই এল নিনোর বিপরীত একটি শীতল স্রোত সৃষ্টি হয়। তার নাম লা নিনা। বিশ্ব জুড়ে দুই বিপরীতধর্মী স্রোতের প্রভাব পড়ে আবহাওয়ায়।
অর্থাৎ লা নিনা হচ্ছে এল নিনোর ঠিক বিপরীত। লা নিনা সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা শীতল করে। এই কারণে, ঠান্ডার প্রকোপ বাড়ে এবং প্রচ- গরমের সম্ভাবনা কম থাকে। লা নিনা বলতে বোঝায় মধ্য ও পূর্ব নিরক্ষীয় প্রশান্ত মহাসাগরে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রার বড় মাত্রায় শীতলতা। সেই সঙ্গে বাতাস, চাপ ও বৃষ্টিতেও পরিবর্তন দেখা যাবে।
এল নিনো কী ॥ এল নিনো হচ্ছে এর ঠিক বিপরীত। আবহাওয়ার এই কার্যকলাপের কারণে সমুদ্র উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এল নিনোও একটি স্প্যানিশ শব্দ। এল নিনো শব্দের অর্থ ছোট ছেলে। পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের পশ্চিম উপকূল ঘেঁষে পেরু, ইকুয়েডর বরাবর কোনো কোনো বছর উষ্ণ দক্ষিণমুখী স্রোতের সৃষ্টি হয়। এরই নাম এল নিনো, যার ফলে সামগ্রিকভাবে বিশ্বে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়।