ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৮ মাঘ ১৪৩১

বিশ্বব্যাপী মার্কিন সহায়তা বন্ধের ঘোষণায় চাপে বাংলাদেশ

আরও জটিল হতে পারে রোহিঙ্গা সংকট

জনকণ্ঠ রিপোর্ট

প্রকাশিত: ২২:২১, ৩১ জানুয়ারি ২০২৫

আরও জটিল হতে পারে রোহিঙ্গা সংকট

.

দেশে রোহিঙ্গা সমস্যা আরও ঘনীভূত হচ্ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউক্রেন ও গাজা যুদ্ধে অনুদান কমানোর পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী মার্কিন সহায়তা বন্ধের ঘোষণা দেন। যদিও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা অর্থায়ন অব্যাহত রাখার আশ্বাস দিয়েছে। এর মাঝেই সুইজারল্যান্ড ঘোষণা দিয়েছে, আগামী  ২০২৬ সালের এলডিসি থেকে গ্র্যাজুয়েশনের কারণে ২০২৮ সালের পর বাংলাদেশকে আর উন্নয়ন সহায়তা দেওয়া হবে না। আশঙ্কা করা হচ্ছে, সুইজারল্যান্ডের হাত ধরে আরও কিছু উন্নত দেশ এমন ঘোষণা দিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ওসব দেশও রোহিঙ্গা অর্থায়নে বড় ভূমিকা রাখে। এক কথায় ট্রাম্পের ঘোষণা, বাংলাদেশের এলডিসি থেকে গ্র্যাজুয়েশন এবং বর্তমানের রাখাইন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা ইস্যুটি আরও জটিল আকার ধারণ করতে যাচ্ছে।
সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাহী আদেশে বিভিন্ন দেশে নতুন অনুদান ৯০ দিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন। এর আওতায় রয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ইউএসএআইডির সহায়তাও। যুক্তরাষ্ট্রের অনুদান বন্ধ হওয়ায় এর ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সংকট আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে। টেকনাফে শরণার্থী শিবিরের লাখ লাখ রোহিঙ্গার খাদ্য ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ বিঘিœত হতে পারে।
রোহিঙ্গাদের অনুদানের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র সবার শীর্ষে। মোট অনুদানের প্রায় অর্ধেকই দিয়ে থাকে দেশটি। গত বছর অপেক্ষাকৃত কম অর্থ দিলেও তা ছিল অন্যদের চেয়ে বেশি। দাতাদের মধ্যে আরও আছে যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া। গত সেপ্টেম্বরের শেষদিকে রোহিঙ্গাদের জন্য ২০ কোটি মার্কিন ডলার ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। এ সহায়তার ১২ কোটি ৯০ লাখ ডলার যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডি এবং ৭ কোটি ডলার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর দেয়। অনুদান বন্ধ ঘোষণা করে নতুন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশে মার্কিন কূটনীতিকের কাছে বার্তা  পাঠিয়েছেন। তবে এ নির্দেশনার আওতায় থাকছে না মিসর ও ইসরাইল। বিশ্বব্যাপী আবার অনুদান প্রদান শুরু হবে কিনা তা পর্যালোচনার ভিত্তিতে তিন মাস পর জানানো হবে।
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা তহবিল কমছিল। ২০২৩ সালে তাদের জন্য ৮৭ কোটি মার্কিন ডলার অনুমোদন হয়, যা তাদের প্রয়োজনীয় তহবিলের ৫০ শতাংশ। তহবিল খাটো হওয়ার সঙ্গে রোহিঙ্গাদের জনপ্রতি বরাদ্দ কমে যাওয়ার সম্পর্ক রয়েছে। ২০২৩ সালের নভেম্বরে বিশ্ব খাদ্য সংস্থা বা ডব্লিউএফপি রোহিঙ্গাদের জনপ্রতি বরাদ্দ কমিয়ে ৯ টাকা করে। যুক্তরাষ্ট্রের অনুদান কমলে এ বরাদ্দ আরও কমতে পারে। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্য-সুরক্ষাসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সরবরাহও ব্যাহত হতে পারে। মিয়ানমার থেকে আসা এসব শরণার্থীর কারণে টেকনাফের স্থানীয় বাসিন্দারাও নানা ভোগান্তিতে পড়েছেন। অনুদানে তাদের জন্যও বরাদ্দ থাকে। এতে তাদের জীবনও কঠিন হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশে বর্তমানে ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। এর মধ্যে ২০১৭ সালে রাখাইনে গণহত্যা, ধর্ষণ-নিপীড়ন, অগ্নিসংযোগ এড়াতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়  ৮ লাখ রোহিঙ্গা। তাদের অধিকাংশই কক্সবাজার জেলার টেকনাফের বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে থাকেন। ২০১৭ সাল থেকে রোহিঙ্গাদের সহায়তায় যুক্তরাষ্ট্র ২৫০ কোটি ডলারের বেশি দিয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে দিয়েছে ২১০ কোটি ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি সূত্রের বরাত দিয়ে বিবিসি জানায়, ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক সাহায্যের জন্য ৬৮ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। ট্রাম্প প্রশাসনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর বার্তায় বলা হয়, পর্যালোচনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো নতুন তহবিল অনুমোদিত হবে না বা বিদ্যমান কোনো চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করা যাবে না। চলমান প্রকল্পের কাজও বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা জশ পল বলেন, এ নোটিস যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে বিদেশী সাহায্য কর্মসূচির ওপর অনেক বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। বিশ্বজুড়ে মানবিক সহায়তা কার্যক্রম হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়ার কথাটি একবার ভাবুন। এটি অনেক বড় একটি বিষয়। মধ্যপ্রাচ্যে ইউএসএইড মিশনের সাবেক পরিচালক ডেভ হার্ডেন বলেন, এ পদক্ষেপ ‘অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ’, যা বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে মানবিক ও উন্নয়ন সহায়তা কর্মসূচিগুলোকে স্থগিত করে দিতে পারে। বিদেশী সহায়তা বন্ধের এ সিদ্ধান্তের প্রভাব পানীয়জল, স্যানিটেশন এবং আশ্রয়সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্পে পড়তে পারে।
অপরদিকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ সহায়তা অব্যাহত থাকবে বলে আশ্বাস পাওয়ার কথা জানালেও ঢাকা বা ওয়াশিংটনে মার্কিন প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকর্তা বিষয়টি নিশ্চিত করেননি।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে যুক্তরাষ্ট্রের সকল আন্তর্জাতিক সহায়তা কার্যক্রম ৯০ দিনের জন্য স্থগিতের ঘোষণা দেওয়ার পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ঢাকা জানায়, মার্কিন রোহিঙ্গা সহায়তা অব্যাহত থাকবে। এ জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর বলেছে, মার্কিন প্রশাসনের বৈদেশিক সহায়তা কর্মসূচিতে তহবিল স্থগিত করার বিষয় আমরা অবগত আছি। আমরা অনুমান করছি কিছু ভিন্ন সিদ্ধান্ত আসতে পারে। তবে আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। তাই আমরা এ মুহূর্তে কোনো মন্তব্য করতে পারছি না
সাংবাদিকদের ই-মেইলের জবাবে সংস্থাটি আরও জানায়, আমরা অনেকদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের  সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে আসছি। বিশ্বস্ত সহযোগী হিসেবে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আরও কার্যকর ও গঠনমূলকভাবে কাজ এগিয়ে নিতে চাই সামনের দিনগুলোতেও। এ বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে যোগাযোগ করে তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে জানানো হয়, আমরা সাধারণত বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কূটনৈতিক যোগাযোগের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করি না।
তবে প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়ক বিশেষ দূত ড. খলিলুর রহমানের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা শাহ আলম খোকন মঙ্গলবার বলেন, যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গাদের খাদ্য ও পুষ্টি সহায়তা অব্যাহত রাখার আশ্বাস দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের কার কাছ থেকে এ আশ্বাস পাওয়া গেছে জানতে চাইলে তিনি বিস্তারিত বলেননি।
এদিকে গত রবিবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোহিঙ্গাদের সহায়তার বিষয়টি তার নির্বাহী আদেশ থেকে অব্যাহতি দেওয়ায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব অপূর্ব জাহাঙ্গীর বলেন, ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের কর্মকর্তারা রোহিঙ্গা বিষয়ক প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত ড. খলিলুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে এ সহায়তা অব্যাহত রাখার আশ্বাস দিয়েছেন। বাংলাদেশকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে যে, এ নির্বাহী আদেশে রোহিঙ্গাদের সহায়তা বাধাগ্রস্ত হবে না, বলেন জাহাঙ্গীর।
২০২৮ সালের পর উন্নয়ন সহযোগিতা বন্ধ করবে সুইজারল্যান্ড ॥ দ্বিপক্ষীয়ভাবে উন্নয়ন সহযোগিতা ২০২৮-এর পরে বন্ধ করে দেবে সুইজারল্যান্ড। বাংলাদেশ, জাম্বিয়া ও আলবেনিয়া– এই তিনটি স্বল্পোন্নত দেশের জন্য এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সুইজারল্যান্ড। এই তিনটি দেশ আগামী কয়েক বছরের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে যাবে।
এ বিষয়ে একটি সূত্র জানায়, বর্তমানে সুইজারল্যান্ড যে সহযোগিতা দিয়ে থাকে, সেটি ২০২২-২৫ মেয়াদের জন্য কৌশলপত্রের অধীনে। এর পর ২০২৮ পর্যন্ত সুইজারল্যান্ড কীভাবে সহযোগিতা দেবে সেটি নিয়ে তারা কাজ করছে। তিনি বলেন, তবে এই সহযোগিতা শুধু দ্বিপক্ষীয় ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। বহুপক্ষীয় ব্যবস্থার অধীনে যে সহায়তা সেটি সুইজারল্যান্ড অব্যাহত রাখবে।
এদিকে, বাংলাদেশ ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে যাবে। এর ফলে বাজার প্রবেশাধিকার, স্বল্পসুদে ঋণ, উন্নয়ন সহযোগিতার মতো বিষয়গুলো ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসবে এবং এক সময় বন্ধ হয়ে যাবে।

×