ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৮ মাঘ ১৪৩১

টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে কি করছেন লাখ লাখ মানুষ?

নিজস্ব সংবাদদাতা

প্রকাশিত: ২১:৫০, ৩১ জানুয়ারি ২০২৫

টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে কি করছেন লাখ লাখ মানুষ?

ছবিঃ জনকণ্ঠ

ভয় শংকা আর আতংক কাটিয়ে আল্লাহর গুনগান ও ইবাদত বন্দেগির মধ্যে দিয়ে তাবলীগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের প্রথম ধাপের প্রথম দিন শান্তিপূর্ণভাবে অতিবাহিত হয়েছে। শুক্রবার ইজতেমা ময়দানে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসল্লীর উপস্থিতিতে জুমা নামাজ অনুষ্ঠিত হয়েছে। রাজধানী ঢাকার জিরো পয়েন্ট থেকে ২২ কিলোমিটার উত্তরে টঙ্গী তুরাগ নদীর তীরে এই বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন। বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দেয়া লাখ লাখ মুসল্লী কি করে থাকেন, কেনইবা এখানে এসে থাকেন এমন প্রশ্ন অনেকের।


১টা ৫১ মিনিটে জুমা নামাজ পড়িয়েছেন শুরায়ে নেজামের জোবায়েরপন্থী নেতা কাকরাইল মসজিদের ইমাম হযরত মাওলানা জোবায়ের আহমেদ। শুরায়ে নেজামের আয়োজনে ৩ দিন করে টানা ৬ দিনের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম দিন শুক্রবার হওয়ায় ইজতেমায় যোগ দেয়া মুসল্লী ছাড়াও সাধারণ মুসল্লীরা জুমা নামাজে অংশ নিতে ইজতেমা মাঠে দলে দলে আসতে থাকেন।


তাবলীগ জামাতের বিবদমানমান দুটি গ্রুপের একটি গ্রুপ শুরায়ে নেজাম, সাদপন্হীদের ইজতেমা মাঠে জোড় ইজতেমা করতে না দেওয়ার ঘোষণায় গত ১৮ ডিসেম্বর হামলা ও সংঘর্ষে ৪ জন নিহত ও শতাধিক আহতে সাধারণ মুসল্লীদের মাঝে ভয় শংকা ও আতংক বিরাজ করছিল, নাজানি আবার দুপক্ষে মারামারির ঘটনা ঘটে। এমন ভয় শংকা উপেক্ষা করে ধর্মপ্রাণ তাবলীগ অনুসারী মুসল্লীরা যোগ দিয়েছেন টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমায়।

 


শুরায়ে নেজামের দুধাপের ইজতেমা ৩১ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রথম ধাপ এবং ৩/৪/৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় ধাপের বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে। ২ এবং ৫ ফেব্রুয়ারি প্রথম পর্বের ২ টি আখেরী মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে। ৮ দিন বিরতি দিয়ে ১৪/১৫/১৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে সাদ পন্থীদের বিশ্ব ইজতেমা। সাদ পন্থীদের আখেরী মোনাজাত ১৬ ফেব্রুয়ারী। বিশ্ব ইজতেমার ইতিহাসে এবারই প্রথম বিবদমান দুগ্রুপের ৩ টি আখেরী মোনাজাত অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ১৬ ফেব্রুয়ারি শেষ হবে এবারের বিশ্ব ইজতেমা।

সরকারি সিদ্ধান্তে পরিবর্তিত তারিখে সাদপন্হীদের বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠান করা নিয়ে এখনও সংশয়ে রয়েছেন।


সরকার, শুরায়ে নেজাম ও সাদপন্হীদের সমন্বয়ে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে সিদ্ধান্ত ছিল ৩১ জানুয়ারি থেকে ১/২ জানুয়ারি মাঝে ৪ দিন বিরতি দিয়ে ৭/৮/৯ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ইজতেমা করার। কিন্তু গত ১৮ ডিসেম্বর সাদপন্হীদের জোড় ইজতেমা করতে দেয়া হবে না এমন ঘোষণায় বিশ্ব ইজতেমা মাঠে জোড় ইজতেমা চলাকালে হামলা সংঘর্ষে ৪ জন নিহত ও শতাধিক আহতে শুরায়ে নেজাম ঘোষণা দেয় সাদপন্হীরা টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানে বিশ্ব ইজতেমা করার নৈতিক অধিকার হারিয়েছে। সাদপন্হীদের বিশ্ব ইজতেমা করতে দেয়া হবে না।

বিশ্ব ইজতেমা বিশ্লেষকরা বলছেন, শুরায়ে নেজাম তথা জোবায়ের পন্থীরা টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা মাঠে সাদপন্হীদের বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠান করতে দেবেনা মোটামুটি এমন সিদ্ধান্তে এক প্রকার জোড় করেই একটানা ৬ দিনের বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠানের তারিখ ঘোষণা করে শুরায়ে নেজাম বা জোবায়ের পন্থীরা। সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সংশ্লিষ্ট সেবাদান কর্তৃপক্ষও ওইভাবে বিশ্ব ইজতেমা আয়োজনে এগিয়ে আসেন।


বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিতে এসে শুক্রবার বিকাল পর্যন্ত ৩ মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। এঁরা হলেন, খুলনা জেলার ডুমুরিয়া থানার ডুমুরিয়া বাজার গ্রামের লোকমান হোসেন গাজীর ছেলে আব্দুল কুদ্দুস গাজী (৬০), ঠাকুরগাঁও জেলার মৃত আব্দুলের ছেলে আমিরুল ইসলাম (৪৬) ও শেরপুর জেলার শ্রীবরদী থানার রানী শিমুল গ্রামের মৃত সবদুল্লার ছেলে সাবেদ আলী (৭০)। তাদের সবার জানাজা ইজতেমা ময়দানে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এঁরা বার্ধক্যজনিত কারনে ও হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। বিশ্ব ইজতেমার শুরায়ে নেজামের মিডিয়া সমন্বয়ক হাবিবুল্লাহ রায়হান, আব্দুল কুদ্দুস গাজীর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন। অপর দুই জনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন টঙ্গী হাসপাতালে স্থাপিত সিভিল সার্জন এর কন্ট্রোল রুমের দায়িত্বে থাকা সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক বেলায়েত হোসেন।


ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক শরফউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ইজতেমা মাঠে প্রেসব্রিফিংয়ে বলেন, গাজীপুর সিটি করপোরেশন কর্মকর্তা কর্মচারীরা মুসল্লীদের সেবায় সার্বক্ষণিক নিয়োজিত রয়েছে।

গাজীপুর মহানগর পুলিশের পুলিশ কমিশনার ডক্টর নাজমুল করিম খান ইজতেমা ময়দানে আলাদা প্রেসব্রিফিংয়ে বলেছেন, শান্তিপূর্ণভাবে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠানে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বয়ে সকল প্রস্তুতি রয়েছে। কোন ধরনের নাশকতার শংকা নেই।


বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দেয়া লাখ লাখ মুসল্লী কি করে থাকেন, কেনইবা এখানে এসে থাকেন এমন প্রশ্ন অনেকের। এমন প্রশ্নের খোঁজ জানতে বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার রাত পর্যন্ত ইজতেমা ময়দানে অবস্থান করে যে সব ব্যাপার দেখেছি তাহলো, ১০/১৫/২০ জনের সমন্বয়ে একেকটি তাবলীগ জামাত অনুসারী মুসল্লীর দল জামাতে দলবদ্ধ হয়ে এক বর্গ কিলোমিটারের বিশাল ময়দানের যার যার খিত্তা নাম্বারে তাবু বা প্যান্ডেলের নিচে অবস্থান নিয়েছেন।


নিজের জানমাল খরচ করে নিজ অর্থ ব্যয়ে এসব মুসল্লীরা ইজতেমায় যোগ দিয়েছেন দেশ বিদেশের নানা জায়গা থেকে। দেখা গেলো বৃহস্পতিবার বাদ মাগরিব দেশবিদেশের শীর্ষ মুরুব্বিদের বয়ান শেষে এশা নামাজ পর কেউ খেতে বসেছেন আবার কেউ করছেন কোরান তেলওয়াত, কেউবা নফল নামাজে দাড়িয়েছেন। পিনপতন নীরবতায় গভীর রাতের শেষ দিকে লাখো মানুষ যখন ঘুমে তখন হাজারো মানুষ তাহাজ্জুদ নামাজে দাড়িয়ে। আবার কেউ আল্লাহর দরবারে হাত উঁচু করে গুনাহ মাফে চোখের পানি ফেলছেন। আবার কেউবা আল্লাহর কাছে দুনিয়া আখেরাতে সুখশান্তি চেয়ে দুহাত তুলে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন।


এমন দৃশ্য দেখে নিজেও এমন আমল করতে নিজেকে নিয়োজিত করে ফেলি আল্লাহকে রাজি খুশি করতে নানা আমল আদায়ে। এভাবে চলছিল শুক্রবার ফজর নামাজেের আযান দেওয়ার আগ পর্যন্ত লাখো মুসল্লীর এমন এবাদত বন্দেগিতে মশগুল থেকে। শুক্রবার ফজর নামাজ শেষে আবার শুরু হয় দেশবিদেশের মুরুব্বিদের বয়ান। বয়ানে তাবলীগের ছয় উছুল নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। মুরুব্বিরা তাদের বয়ানে বলেন, নিজের খেয়ে পড়ে নিজের জানমাল ব্যয় করার নাম তাবলীগ। 


মুসল্লীরা মুরুব্বিদের বয়ান মনোযোগ দিয়ে শুনে সে অনুযায়ী জীবনকে চালানোর দৃড় পদক্ষেপ নিচ্ছেন। এর মাঝে তালিমও চললো নিজেদের খন্ড খন্ড জামাত বন্দি সাথীদের নিয়ে। জুমা নামাজের অপেক্ষা শেষে জুমা নামাজ আদায় করে খাওয়া দাওয়ার সময়েই শুরু হলো মুরুব্বিদের ইসলামি বয়ান। কি করে জীবনকে শান্তিময় করা যায়। পরের হক নষ্ট না করা। বয়ানে ছিলনা কোন রাজনৈতিক একটি বক্তব্যও।


এভাবে বাদ আছর বাদ মাগরিব বয়ানে বয়ানে মুসল্লীদের চাঙা করে রাখছিলেন শীর্ষ মুরুব্বিরা।বয়ানে মশগুল থেকে ইবাদত বন্দেগিতে রাত দিন ২৪ ঘন্টা ব্যস্ত রাখছেন মুসল্লীরা। মুরুব্বিরা তাদের বয়ানে বলছেন, মনকে আল্লাহর দিকে একাগ্র করার জন্য এবং আমাদের ওপর আল্লাহর যেই হক আছে তা শেখার জন্য আল্লাহর রাস্তায় বের হতে হবে।


আল্লাহ বান্দাকে দেওয়ার জন্য সারাক্ষণ বসে আছেন, বান্দা চাওয়ার মতো চাইতে পারলে আল্লাহ দিতে কার্পণ্য করেন না কখনো। সুতরাং আমল করে ধনসম্পদ হায়াত রিজিক দুনিয়া ও আখেরাতে সুখশান্তির জন্য আমল ও মেহনত করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিজের জন্য চাইতে হবে আর তাতেই সারা পৃথিবীর মানুষের ঘরে ঘরে শান্তি চলে আসবে।

নূরুল ইসলাম  /জাফরান

×