তাবলীগ জামাতের ৫৮ তম বিশ্ব ইজতেমা আজ শুক্রবার সকাল থেকে।আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক প্রস্তুতিতে টঙ্গী তুরাগ নদীর তীরে শুরু হয়েছে বিশ্ব ইজতেমা। আজ শুক্রবার ইজতেমা ময়দানে উপমহাদেশের বৃহত্তম জুমা নামাজ অনুষ্ঠিত হবে। জুমা নামাজে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসল্লী অংশগ্রহণ করবেন বলে আশা করছেন আয়োজকরা। ঢাকার জিরো পয়েন্ট থেকে ২২ কিলোমিটার উত্তরে টঙ্গী তুরাগ নদীর পূর্ব তীরে এই বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন।
সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে হামলা সংঘর্ষে ৪ মুসল্লী নিহত ও শতাধিক আহতের ঘটনার ভয় আর শংকা কাটিয়ে তবলীগ অনুসারী মুসল্লীরা ইজতেমায় দলে দলে যোগ দিতে শুরু করেছেন। আল্লাহর সন্তুষ্টি,দুনিয়া ও আখেরাতে শান্তি লাভের আশায় মানুষ দুনিয়াবির সমস্ত লোভলালসা ত্যাগ করে ছুটে আসছেন আল্লাহ রাসুলের দেখানো পথে চলতে। ইসলামের দ্বীনি শিক্ষায় হাতে কলমে শিক্ষা নিয়ে পূতপবিত্র জীবন গড়তে।
আলেমওলেমা মাশায়েখ তথা শুরায়ে নেজামের জোবায়ের পন্থীদের নেতৃত্বে ৩১ জানুয়ারি থেকে ৫ জানুয়ারি ৩দিন ৩দিন করে দুই ধাপে একটানা ৬ দিন প্রথম পর্বের বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে। শুরায়ে নেজামের মিডিয়া সমন্বয়ক হাবিবুল্লাহ রায়হান জনকণ্ঠকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। অপরদিকে ৮ দিন বিরতি দিয়ে ১৪,১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে সাদপন্হীদের বিশ্ব ইজতেমা।
বিশ্ব ইজতেমা মাঠে শুরায়ে নেজাম সাদপন্হীদের জোড় ইজতেমা করতে না দেওয়ার ঘোষণায় ১৮ ডিসেম্বর ভোররাতে হামলা ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে ৪ মুসল্লী নিহত ও শতাধিক আহতদের ঘটনায় দুপক্ষের সাধারণ মুসল্লীদের মাঝে এখনও আতংক বিরাজ করলেও সব ভয় আতংক দূর করে দলে দলে মুসল্লীরা ইজতেমা ময়দানে ছুটে আসছেন।
সরকার ও ইজতেমার বিবদমান দুগ্রুপের সমন্বয়ে ইজতেমার তারিখ নির্ধারণ ছিল ৩১ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শুরায়ে নেজামের এবং ৭, ৮ ও ৯ ফেব্রুয়ারি সাদপন্হীরা ইজতেমার আয়োজন করবে। কিন্তু শুরায়ে নেজামের কথা হচ্ছে সাদপন্হীরা টঙ্গী ইজতেমা ময়দানে বিশ্ব ইজতেমা করার নৈতিক অধিকার হারিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ইজতেমা ময়দানে সাদপন্হীদের বিশ্ব ইজতেমা করতে না দেওয়ার ঘোষণা দেয় শুরায়ে নেজাম।
সরকার নির্ধারিত তারিখে যেন সাদপন্হীরা ইজতেমা করতে না পারে সেজন্য শুরায়ে নেজাম ৩১ জানুয়ারি থেকে একটানা ৬ দিন বিশ্ব ইজতেমা করার ঘোষণা দিলে সাদপন্হীরা ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারি তাদের বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়। এমন পাল্টাপাল্টি তারিখ নির্ধারণে সরকারের প্রশাসন সেভাবেই প্রস্তুতি গ্রহন করেছে। তারপরও কানাঘুষা হচ্ছে ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারি সাদপন্হীদের বিশ্ব ইজতেমা করতে দেবে না শুরায়ে নেজাম!
প্রথম পর্বের প্রথম ধাপে ৪২ জেলা ও দ্বিতীয় ধাপে ২২ জেলার মুসল্লীরা অংশ নিবেন এই ইজতেমায়।
ইজতেমা সূত্র বলছে, প্রথম পর্বের ইজতেমা অনুষ্ঠান শেষে ৮ দিন বিরতি দিয়ে ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে সাদপন্হীদের বিশ্ব ইজতেমা। দুই গ্রুপের দুই পর্বে ২, ৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারি থাকছে ৩ টি আখেরী মোনাজাত। তাবলীগ জামাতের ইতিহাসে এবারই প্রথম দুই পর্বের ৩ টি আখেরী মোনাজাত অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে। সাধারণ মুসল্লী ও তাবলীগ অনুসারী মুসল্লীরাও সেভাবে আয়োজনে অংশ নিতে প্রস্তুতি গ্রহন করছেন।
এদিকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিতে ৪২ দেশের ৮৫০ জন বিদেশি মেহমান বিদেশি কামরায় এসে পৌঁছেছেন বলে স্হানীয় গোয়েন্দা সংস্থা জানিয়েছে। ৪২ দেশের মধ্যে আফগানিস্থান, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইথিওপিয়া, ভারত, ওমান, সৌদিআরব, ইয়েমেন, কিরগিস্থান, দক্ষিণ আফ্রিকা, থাইল্যান্ড, পাকিস্থান, ফ্রান্স, জাপান, মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য, আলজেরিয়া, মিশর, সিঙ্গাপুর, জর্ডান উল্লেখযোগ্য।
বিদেশি মেহমানদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন ইজতেমার শীর্ষ মুরুব্বিরা। বিদেশি মেহমানদের আবাসস্থল ঘিরে বিশেষ নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিদেশি কামরার পাশে পুলিশ র্যাবসহ সব বাহিনীর উপ-নিয়ন্ত্রণ কক্ষ স্থাপন করা হয়েছে। বিশ্ব ইজতেমায় বিদেশি মেহমানদের থাকা খাওয়া, যাতায়াত ও ভ্রমণের ওপর নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে। টঙ্গী পশ্চিম থানার ওসি ইস্কান্দার হাবিবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, বিদেশি মেহমানদের জন্য বিশেষ নিরাপত্তা দিতে পুলিশের বিশেষ টিম কড়া নজরদারিতে রয়েছে।
শুরায়ে নেজামের মিডিয়া সমন্বয়ক হাবিবুল্লাহ রায়হান জানান, বৃহস্পতিবার বাদ মাগরিব ভারতের মাওলানা ইব্রাহিম দেওলার আম বয়ানের মাধ্যমে বয়ান শুরু হলেও ইজতেমার আনুষ্ঠানিকতা আজ শুক্রবার বাদ ফজর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে। শুক্রবার বাদ ফজর বয়ান করবেন পাকিস্তানের মাওলানা জিয়াউল হক। সকাল ১০টা থেকে বিভিন্ন খিত্তায় খিত্তায় তালিমের আমল হবে। জুমার নামাজে ইমামতি করবেন মাওলানা জুবায়ের।
বৃহস্পতিবার বিকালে ইজতেমা ময়দান সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, শুরায়ে নেজামের তাবলীগ অনুসারী মুসল্লীরা দলে দলে জামাতবদ্ধ হয়ে দেশের নানা স্হান থেকে ইজতেমা ময়দানে আসছেন। জামাতবন্ধী মুসল্লীরা মাঠের নানা জায়গায় প্যান্ডেলের নিচে অবস্থান নিচ্ছেন। নিজের জানমাল খরচ করে তাবলীগ অনুসারী মুসল্লীরা ইজতেমা করে থাকেন। তাবলীগের ৬ উছুল নিয়ে বৃহস্পতিবার মাগরিবের পর থেকে বয়ান শুরু হয়েছে এবং তা দুই ধাপে চলবে ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
আগত মুসল্লিদের সুষ্ঠুভাবে বয়ান শোনার জন্য পুরো মাঠে শব্দ প্রতিধ্বনি রোধক প্রায় ২১২টি বিশেষ ছাতা মাইক, ৩০০টি ইউনিসেফ শব্দ প্রতিরোধক মাইকসহ ৫০০ মাইক স্থাপন করা হয়েছে। ইজতেমা ময়দানে মুসল্লিদের অবাধ পারাপার নিশ্চিতে তুরাগ নদীতে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সদস্যরা ৫টি ও বিআইডব্লিউটিএ ১টি ভাসমান সেতু নির্মাণ করেছেন। এছাড়াও আন্তর্জাতিক নিবাসে মেহমানদের রান্নাসহ আভ্যন্তরীণ মুসল্লিদের জন্য আশপাশের এলাকায় স্থাপিত বিভিন্ন হোটেল রেস্তোরায় বিশেষ নজর রাখবে স্হানীয় প্রশাসন।
শুরায়ে নেজামের মিডিয়া সমন্বয়ক হাবিবুল্লাহ রায়হান জনকণ্ঠকে জানান, পুরো বাংলাদেশকে দুই ভাগে বিভক্ত করে কে কোন ধাপে অংশগ্রহণ করবেন তা ইতিমধ্যে জেলার শীর্ষ মুরব্বিদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রথম ধাপে অংশগ্রহণ করা জেলা ও থানা গুলো হচ্ছে, গাজীপুর, টঙ্গী, ধামরাই, গাইবান্ধা, মিরপুর, কাকরাইল, নাটোর, মৌলভীবাজার, রাজশাহী, দোহার, ডেমরা, কাকরাইল, নড়াইল, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, নবাবগঞ্জ, নীলফামারী, দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল, ভোলা, চুয়াডাংগা, কুষ্টিয়া, যশোর, মাগুরা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, নেত্রকোনা, শেরপুর, ফরিদপুর, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, বি-বাড়িয়া, খুলনা, পটুয়াখালী, কুমিল্লা, ঝিনাইদহ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পিরোজপুর, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড় ও রাজবাড়ী জেলা। এই ধাপে ঢাকার একাংশসহ মোট ৪১টি জেলা অংশগ্রহণ করছে।
দ্বিতীয় ধাপে অংশগ্রহণ করবেন, যাত্রাবাড়ী, কেরানীগঞ্জ, মোহাম্মদপুর, মুন্সীগঞ্জ, জামালপুর, মানিকগঞ্জ, জয়পুরহাট, সিলেট, সিরাজগঞ্জ, মেহেরপুর, টাংগাইল, পাবনা, নরসিংদী, সাভার, কিশোরগঞ্জ, কক্সবাজার, নোয়াখালী, গোপালগঞ্জ, ঝালকাঠি, বরগুনা, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, নওগাঁ, বান্দরবন জেলা।
এই ধাপে ঢাকার একাংশসহ ২২টি জেলা অংশগ্রহণ করবে।
হাবিবুল্লাহ রায়হান আরো জানান, পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে ওনারা যথেষ্ট আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছেন। ইতিমধ্যে পুলিশ বাহিনী নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন ওয়াচ টাওয়ার তৈরি করেছেন এবং সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছেন। ওনাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, যে কোন ধরনের নাশকতা এড়াতে সিভিল ড্রেসে ইজতেমার ভেতর বাইরের বিভিন্ন খিত্তায় তারা মুসল্লী বেশে অবস্থান করবেন।
বিদেশী মেহমানদের যাতে তাদের ফুড পয়জনিং না হয় সে জন্য নেয়া হয়েছে বিশেষ ব্যবস্হা। ইজতেমার আয়োজক তাবলীগ জামাতের স্বেচ্ছাসেবীদের প্রস্তুতি ছাড়াও গাজীপুর সিটি করপোরেশন, ডেসকো, তিতাস, ওয়াসা, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, ফায়ার সার্ভিসসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সেবাদানকারী সংস্থাগুলো ইজতেমা উপলক্ষ্যে তাদের প্রয়োজনীয় সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন। বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা ও ওষুধ বিতরণ করে নানা ওষুধ কোম্পানি ও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। মুসল্লিদের সার্বক্ষণিক সেবাদানে ফায়ার সার্ভিসের ‘হেজমেক’ টিমও এ বছর দায়িত্ব পালন করবে।
এদিকে নিরাপত্তার লক্ষ্যে ইজতেমার ময়দানসহ আশপাশের এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার থেকেই দুই পর্বের ইজতেমায় পুলিশ, র্যাব, কিউআরটি, আনসারসহ সাদা পোশাকধারী বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যসহ ৭ হাজার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে ইজতেমা ময়দানের আশপাশ ও পুরো টঙ্গী জুড়ে।
ইজতেমা মাঠের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ৩ শতাধিক ক্লোজসার্কিট ক্যামেরা স্থাপনের করা হয়েছে। ১৭টি প্রবেশ পথসহ চারপাশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বসানো হয়েছে ক্লোজসার্কিট ক্যামেরা। এছাড়াও থাকছে মেটাল ডিটেক্টর, বাইনোকুলার, নাইটভিশন গগ্ল্স, পুলিশ ও র্যাবের স্ট্রাইকিং ফোর্স, বোম ডিসপোজাল ইউনিট, এন্টি টেরোরিজম ইউনিট, সোয়াদ টিম, ড্রোন ভিউ, নৌ টহল, হেলিকপ্টার টহল, মুসলিল্লদের খিত্তাওয়ারী মোটরসাইকেল টহল।
প্রতিটি খিত্তায় বিশেষ টুপি পরিহিত ও সাদা পোশাকধারী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মুসল্লী বেশে অবস্থান করবেন। এছাড়াও র্যাব ও পুলিশের ১৬ ওয়াচ টাওয়ার, চেক পোস্ট, হেলিকপ্টার উঠানামার জন্য হ্যালিপ্যাড ব্যবস্থা করা হয়েছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা মনিটরিংয়ের জন্য একটি প্রধান কন্ট্রোল রুম ও সাব কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও ইজতেমা মাঠসহ আশপাশের কোথায় কি হচ্ছে প্রত্যক্ষ করার জন্য ল্যাপটপ ও কম্পিউটারের স্ক্রিনে সার্বক্ষণিক নজর রাখবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
লাখ লাখ মানুষ পাগলের মতো ছুটছেন টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমা ময়দানের দিকে। সারাক্ষণ ইবাদত বন্দেগিতে কাটাবেন আল্লাহর পাগল এসব মানুষেরা। আল্লাহর কাছে তাদের একটাই চাওয়া-পাওয়া দুনিয়া ও আখেরাতে ইজতেমায়ী আমল করে সুখশান্তির জীবন গড়া এবং আল্লাহর কাছে গুনাহ মাফে ফরিয়াদ করতে বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিচ্ছেন হাজার লাখো মানুষ।
আফরোজা