ছবি: সংগৃহীত।
টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে ৩১ জানুয়ারি শুক্রবার থেকে একটানা দুই ধাপে ৬ দিন ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শুরায়ে নেজাম তথা জোবায়ের পন্থীদের তাবলীগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমা শুরু হচ্ছে। বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিতে দেশবিদেশের মুসল্লীরা টঙ্গীতে আসা শুরু করেছেন। বিশ্ব ইজতেমার ইতিহাসে একটানা দীর্ঘ সময় ধরে এমন বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠান একটি বিরল ঘটনা। মুলত দুই গ্রুপের গন্ডগোলে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া দুই আখেরী মোনাজাতে শুরায়ে নেজামের একটানা ৬ দিনের বিশ্ব ইজতেমা কেমন হবে?
রাজধানী ঢাকার জিরো পয়েন্ট থেকে ২২ কিলোমিটার উত্তরে টঙ্গী তুরাগ নদীর তীরে এ বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন। সম্প্রতি ইজতেমা ময়দানে সাদপন্হীদের জোড় ইজতেমা করতে না দেওয়ার ঘোষণায় জোবায়ের-সাদ গ্রুপের সংঘর্ষে ৪ মুসল্লী নিহত ও শতাধিক আহতের ঘটনার শংকা কাটিয়ে মুসল্লীরা বুধবার বিকাল থেকেই দলে দলে ইজতেমা ময়দানে আসা শুরু করেছেন। আয়োজকেরা আশা করছেন মুসল্লীদের ভীড়ে ইজতেমা শুরুর আগের রাতেই মাঠ পূর্ন হয়ে যাবে।
দেশের অর্ধেক জেলার সাথীদের নিয়ে ৩১ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এক ধাপ, আবার ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আরেক ধাপে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে জোবায়ের পন্থীরা। দুধাপেই থাকছে ২ ও ৫ ফেব্রুয়ারি শুরায়ে নেজামের আখেরী মোনাজাত। কথা রয়েছে ৫ ফেব্রুয়ারি জোবায়ের পন্থীদের বিশ্ব ইজতেমা শেষে ৮ দিন বিরতি দিয়ে ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হবে সাদপন্হীদের ৩ দিনের বিশ্ব ইজতেমা।
ইজতেমা আয়োজন উপলক্ষে পুলিশের আইজিপি বাহারুল আলম বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে এক প্রেসব্রিফিংয়ে বলেছেন, এবারের বিশ্ব ইজতেমা আগের চাইতে আরো কড়া নিরাপত্তায় শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হবে। যেকোনো বিশৃঙ্খলা এড়াতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আগের চাইতে আরো সজাগ ও সতর্ক রয়েছে। বিশ্ব ইজতেমায় প্রায় সাত হাজার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করবে। এছাড়াও বিশ্ব ইজতেমার পক্ষ থেকে তাবলীগের কাজে নিয়োজিত প্রায় দশ হাজার স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন। শুরায়ে নেজাম ৩১ জানুয়ারি থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি দুইধাপে একটানা ৬ দিন এবং সাদপন্হীরা ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠান করবেন।
ওয়াচ টাওয়ার থেকে বাইনোকুলারের মাধ্যমে ইজতেমার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হবে। ইজতেমা ময়দানের অভ্যন্তরে প্রতিটি খিত্তায় সাদা পোশাকেের পুলিশ সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করবেন। বিবদমান দুগ্রুপই শান্তিপূর্ণভাবে ইজতেমা পালন করবেন। সম্প্রতি ইজতেমা মাঠে একাধিক খুনের ঘটনা উল্লেখ করে আইজিপি বলেন, আমরা আদম সন্তান। দুই পক্ষই আমল করেন। নিজেদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি হতে পারে, দুই পক্ষ একমত হওয়ায় আমরা আশা করি ইজতেমা সুন্দর হবে।
প্রেস ব্রিফিংয়ে অতিরিক্ত আইজিপি আকরাম হোসেন, গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ডঃ নাজমুল করিম খান, অতিরিক্ত ডিআইজি জাহিদুল ইসলাম ভূইয়া, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার জাহিদুল হাসান, তাহেরুল হক চৌহান, গাজীপুরের পুলিশ সুপার চৌধুরী জাবের সাদেক, টঙ্গী পূর্ব পশ্চিম থানার ওসি ইস্কান্দার হাবিবুর রহমান, ফরিদুল ইসলাম, প্রকৌশলী মাহফুজ হান্নান, গাজীপুর মহানগর বিএনপি'র সাধারণ সম্পাদক এম মনজুরুল করিম রনি, সরকার জাবেদ আহমেদ সুমন, শাহাবুদ্দিন ও বেনজির খানসহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।
সাদপন্হী মিডিয়া মুখপত্র মোহাম্মদ সায়েম জনকণ্ঠকে বলেছেন, টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে আর কোন দিন সাদপন্হীরা বিশ্ব ইজতেমা করবে না এমন একটি শর্তের কপি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে ছড়ানো হয়েছে। এটি একটি দূর্ভিসন্ধি মূলক প্রচারণা, ঠাহা মিথ্যা তথ্য । এমন কোন শর্তে সাদপন্হীরা ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ইজতেমা করার কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি বলে জানাচ্ছেন, সাদপন্হীদের বাংলাদেশের আমির ওয়াসেফুল ইসলাম। শর্ত ছাড়াই নির্ধারিত তারিখে তাদের বিশ্ব ইজতেমার অনুষ্ঠান হবে।
এদিকে বিবদমান শুরায়ে নেজাম ও সাদপন্হীদের নানা বিশ্লেষণ বলছে, সরকার, শুরায়ে নেজাম ও সাদপন্হীদের ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা দুপর্বে অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত হলেও বিবদমান দুটি গ্রুপ যে যার মতো করে বিশ্ব ইজতেমার তারিখ ঘোষণা করায় স্হানীয় প্রশাসন বিপাকে পড়ে। দুপক্ষের ঘোষিত তারিখ মাথায় রেখে প্রশাসনও সেভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রস্তুতি নিয়েছে।
লাখ লাখ মানুষের আয়োজনের এ বিশাল ইজতেমা নিয়ে চলছে ছেলে খেলার মতো অবস্থা। এসবের জন্য একপক্ষ আরেক পক্ষকে দায়ি করে সাংবাদিকদের কাছে নানা কথা তুলে ধরছেন। সাদপন্হীরা বলছেন, সরকার ও জোবায়েরপন্থীরা মিলে ন্যায় হকের পরিবর্তে তাদের উপর জুলুম চালাচ্ছে। সরকারি প্রজ্ঞাপনে ঘোষণা ছিল জোবায়েরপন্থীরা ৩১ জানুয়ারি থেকে ১, ও ২ ফেব্রুয়ারি আর ৭, ৮ ও ৯ ফেব্রুয়ারি সাদপন্হীদের বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠান করার।
কিন্তু জোবায়ের পন্থীরা সাদপন্হীদের বিশ্ব ইজতেমা করতে না দিতে তারা দুপর্বের ইজতেমা নিজেদের মধ্যে দুভাগে ভাগ করে অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সাদপন্হীরা তাদের বিশ্ব ইজতেমা ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্লেষকরা বলছেন, যেহেতু ইজতেমা ময়দানে জোবায়েরপন্থীরা সাদপন্হীদের বিশ্ব ইজতেমা করতে দেবে না তাই যে কোন অজুহাতে সাদপন্হীদের ঘোষিত ১৪, ১৫, ও ১৬ তারিখের ইজতেমা অনুষ্ঠান করতে না দিতে ঠেক দেবে শুরায়ে নেজাম বা জোবায়েরপন্থীরা। বিশ্লেষকরা আরো বলছেন, এমনও হতে পারে শুরায়ে নেজাম ইজতেমা শেষে মাঠের দখল ছেড়ে না গেলে অনিশ্চয়তায় পড়বে সাদপন্হীদের বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠানের!
এদিকে তাবলীগ জামাতের এমন পরিস্থিতিতে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মুসল্লী ও গাজীপুর সিটির নাগরিকরা। তারা বলছেন, আমরা মারামারি কাটাকাটি রেষারেষি হামলা সংঘর্ষ রক্তারক্তির বিশ্ব ইজতেমা চাই না। ইজতেমা শুরুর আগে পরে দীর্ঘ সময় ধরে লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতির ভীড়ে পুরো টঙ্গী অচল হয়ে পড়ে। সকল যোগাযোগ কাঠামো ভেঙে পড়ে। স্কুল কলেজ কর্মস্থলে যাতায়াতে চরম দুর্ভোগ দেখা দেয়। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থেমে যায়। তাই টঙ্গীর নাগরিকরা আগের মতো মিলমিশের এক পর্বের একবারই বিশ্ব ইজতেমার দাবি করেছেন। উল্লেখ করা যেতে পারে, গত ১৮ ডিসেম্বর ইজতেমা ময়দানে হামলা সংঘর্ষের ঘটনায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সাদপন্হীদের একজন সাথী মিজানুর রহমান (৪২) মারা যাওয়ার খবর দিয়েছেন সাদ মুখপাত্র মোহাম্মদ সায়েম। ওই সংঘর্ষের ঘটনায় এ পর্যন্ত ৪ জন নিহত ও শতাধিক আহতের ঘটনায় দুইজনকে বেলাল হোসেন ও মিজানুর রহমান সাদপন্হীদের সাথী বলে দাবি করা হয়েছে।
শুরায়ে নেজাম বা জোবায়েরপন্থীদের সাফ কথা বিশ্ব ইজতেমায় গত ১৮ ডিসেম্বর জোড় ইজতেমা চলাকালে হামলায় হতাহতে বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে ইজতেমা অনুষ্ঠান করার অধিকার হারিয়েছে সাদপন্হীরা। সাদপন্হীরা কোনভাবেই বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে ইজতেমা করার অধিকার রাখে না। শুরায়ে নেজামের গ্রুপরা হচ্ছেন, মসজিদ মাদ্রাসার আলেমওলেমা ইমাম মুয়াজ্জিন মাশায়েখ মাদ্রাসা ছাত্র ও সাধারণ মুসল্লী। মাওলানা মামুনুল হকের ইজতেমা ময়দানে এসে শুরায়ে নেজামের পক্ষে বক্তব্য দিয়ে হেফাজত ইসলামকেও যুক্ত করেছেন শুরায়ে নেজাম বা জোবায়ের পন্থীদের সাথে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে এক বর্গ কিলোমিটারের বিশ্ব ইজতেমা ময়দানের উত্তর পশ্চিম কোণে বিদেশি মেহমানদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ময়দানের পশ্চিম পাশে নির্মাণ করা হয়েছে বয়ান মঞ্চ। সরকারিভাবে টয়লেট গোসলখানা ও খাবার পানির ব্যবস্হা করা হয়েছে মাঠের চারপাশে। পুরো মাঠ জুড়ে শব্দ প্রতিরোধক মাইক লাগানো হয়েছে। মাঠের পূর্ব দিকের তিন ভাগের এক ভাগ জায়গায় বাঁশের খুঁটি লাগানো হলেও সামিয়ানা বা চটের ছাউনি টানানো হয়নি এখনো।
শুরায়ে নেজামের আয়োজক কমিটির মিডিয়া সমন্বয়ক হাবিবুল্লাহ রায়হান জনকণ্ঠকে বলেছেন, যে অংশটুকুতে চট টানানো হয়নি সে অংশে তবলীগের সাথীরা ত্রিপল, তাবু বা সামিয়ানা সাথে করে নিয়ে এসে টানিয়ে নেবেন এমনসব তথ্য সাথীদের আগেভাগে জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
মুসল্লীদের তুরাগ নদী পারাপারে ময়দানের পশ্চিম পাশে কামারপাড়া ব্রিজ থেকে টঙ্গী ব্রিজ পর্যন্ত তুরাগ নদীতে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সদস্যরা পাঁচটি ভাসমান সেতু নির্মাণ করেছেন। এছাড়াও ফেরিঘাটের জেটি দিয়ে অপর একটি পন্টুন সেতু তৈরি করেছে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে ময়দানের চারপাশে পুলিশ ও র্যাবের পক্ষ থেকে নির্মাণ করা হয়েছে ওয়াচ টাওয়ার।
পুরো ইজতেমা ময়দানকে ৩৩৫টি সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়েছে। ইজতেমায় এবার ড্রোন দিয়ে পর্যবেক্ষণ করার ব্যবস্হা নেয়া হয়েছে। এছাড়া র্যাবের হেলিকপ্টার আকাশপথে টহল এবং নৌপুলিশের সদস্যরা তুরাগ নদীতে স্পিড বোট দিয়ে টহল দেবেন।
ইজতেমা ময়দানের আশপাশে বিশটি চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। ওয়াচ টাওয়ার থেকে বাইনোকুলার এর মাধ্যমে গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হবে। ইজতেমা ময়দানের অভ্যন্তরে প্রতিটি খিত্তায় সাদা পোশাকে পুলিশ সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করবেন। টঙ্গী টেশিস মাঠে পুলিশের কন্ট্রোল রুম এবং মন্নু টেক্সটাইল কম্পাউন্ডে র্যাবের কন্ট্রোল রুম স্হাপন করা হয়েছে। বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ বিতরণে মন্নু টেক্সটাইল কম্পাউন্ডে থাকছে দেশের নানা স্হান থেকে আসা নানা স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। বিবদমান তাবলীগ জামাতের একপক্ষের শুরায়ে নেজামের একটানা ৬ দিনের বিশ্ব ইজতেমা দুই আখেরী মোনাজাতে কেমন হবে তা দেখার অপেক্ষায় আছে পুরোদেশবাসী।
নুসরাত