ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭ মাঘ ১৪৩১

সিজিএস সংলাপে ড. বদিউল আলম মজুমদার

নির্বাচন কমিশন নির্বাহী বিভাগের আজ্ঞাবহ একটি প্রতিষ্ঠান

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ১৯:২৭, ৩০ জানুয়ারি ২০২৫; আপডেট: ১৯:৩০, ৩০ জানুয়ারি ২০২৫

নির্বাচন কমিশন নির্বাহী বিভাগের আজ্ঞাবহ একটি প্রতিষ্ঠান

ছবি : সংগৃহীত

নির্বাচন কমিশনকে নির্বাহী বিভাগের আজ্ঞাবহ একটি প্রতিষ্ঠান বলে মন্তব্য করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক এবং নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার।

তিনি বলেছেন, আমরা সংসদে ১০০টি আসন সংরক্ষিত নারীদের জন্য বরাদ্দ করার প্রস্তাবনা দিয়েছি। যেন নারীরা বৈষম্যের স্বীকার না হয়। নারীরা যদি রাজনীতিতে সক্রিয় থাকে তাহলে বৈষম্য কমে আসবে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে যেভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তা ত্রুটিপূর্ণ। এই জন্যই নিয়মকানুন ও সংস্কার দরকার ও নতুন আইনের খসড়া দরকার। নির্বাচন কমিশন স্বাধীন হওয়ার কথা কিন্তু আমার কাছে মনে হয় এটি নির্বাহী বিভাগের আজ্ঞাবহ একটি প্রতিষ্ঠান। 

বৃহস্পতিবার রাজধানীর বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল এন্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংলাপে এসব কথা বলেন তিনি। সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস)-এর অন্তবর্তীকালীন সরকারের সংস্কারের অগ্রাধিকার ক্ষেত্রগুলো নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজন “গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য সংলাপ || সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান প্রসঙ্গ” শীর্ষক সংলাপে ড. বদিউল আলম মজুমদার আরও বলেন, গনতান্ত্রিক পুনর্গঠন করতে হলে নিয়োগ পদ্ধতি বদলাতে হবে, আইন কানুন পরিবর্তন করতে হবে। যারা অন্যায় করেছে তাদেরকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। আমাদের বর্তমান সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যমত্যে পৌছাতে পারবে। নির্বাচন সংক্রান্ত আইনগুলো অধ্যাদেশ আকারে জারি করে কার্যক্রম শুরু করা যায় তত দ্রুত নির্বাচন হবে।

সংলাপে আলোচকের মধ্যে আরও উপস্থিত ছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ, সাবেক কূটনৈতিক, এম্বাসেডর এম শফিউল্লাহ, অর্থনীতিবিদ ও সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) এর চেয়ার মুনিরা খান,  উপদেষ্টা, বিএনপি চেয়ারপার্সন জহির উদ্দিন স্বপন, সাবেক জজ, কলামিস্ট ও আইনি পরামর্শদাতা ইকতেদার আহমেদ, বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিকেলস ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) সভাপতি আব্দুল হক, গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক, অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির ফ্যাকাল্টি মেম্বার ড. জাহেদ উর রহমান, ইষ্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক, পারভেজ করিম আব্বাসী, সিনিয়র সাংবাদিক মাসুদ কামাল, সিনিয়র সাংবাদিক আবু সাঈদ খান; এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু, গণ সংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, জৈষ্ঠ সাংবাদিক এমএ আজিজ, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য কে এস মং, ছাত্রপ্রতিনিধি মুনমুন মাহজাবিন এবং মুহাম্মদ খালিদ খান। সংলাপটি পরিচালনা করেন সিজিএস-এর নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান।

সংলাপের শুরুতে জিল্লুর রহমান বলেন, সংস্কার শব্দটি ঘৃণিত শব্দে পরিণত হয়েছে। সংস্কার জরুরি। সংস্কার চলমান প্রক্রিয়া। বাংলাদেশ গত ৫৩ বছরে প্রতিষ্ঠানকে ঠিক করতে পারিনি। আমাদের আগে নজর দিতে হবে সঠিক ব্যবস্থা করার। নেতা ভুল করতে পারে কিন্তু সিস্টেম ঠিক থাকলে শোধরাবার সুযোগ থাকে।

এসময় ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ তার বক্তব্যে বলেন, আমরা স্ব-বিরোধীতায় সংকোচিত হচ্ছি। স্ব-বিরোধীতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সংবিধানের আওতায় জনগণের সব জানার অধিকার আছে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ নিয়মতান্ত্রিক হতে হবে। রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করতে হবে। ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

এম্বাসেডর এম শফিউল্লাহ বলেন, বিগত বছরে আমরা দেখেছি যে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে নিয়োগ দিয়ে থাকে। রাষ্ট্রপতিকে জনগণ নিয়োগ দিবে। তাহলে রাষ্ট্রপতিকে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হবে। বর্তমানে কোন দলের ম্যান্ডেট নেই। সঠিক ও সুষ্ঠু নির্বাচন আমাদের দরকার বিশ্বে পরিচিতি পেতে।

ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করলে গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে। জুলাই-আগস্ট আন্দোলন হয়েছে অর্থনীতির জন্য, চাকরীর জন্য। সংস্কার করে পরে ক্ষমতা হস্তান্তর করা সম্ভব নয়। তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়ে মানুষের মধ্যে স্বস্তি আনতে হবে। আমাদের বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিবেশ নেই। বছরের পর বছর অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো নষ্ট করে দিয়েছে। এত সংস্কার করার পর নির্বাচিত সরকার যদি তা না মেনে নেয় তাহলে জনগণ আবার অসহায় হয়ে পরবে। আমদের তথ্যের অভাব রয়েছে। বিভিন্ন চুক্তির তথ্য আমরা জানিনা। বর্তমান সরকার যদি উন্নতি না দেখাতে পারে তাহলে তাদেরকে ব্যর্থতা নিয়ে চলে যেতে হবে।

মুনিরা খান বলেন, নির্বাচন কমিশন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে মানিবাধিকার, দুর্নীতি দমন ও আইনের শাসন নিয়ে আরও আলোচনা দরকার। আমাদের কমিশনগুলোর ভিশনগুলো স্বচ্ছ হতে হবে জনগণের কাছে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে আরও আলোচনা করতে হবে।

জহির উদ্দিন স্বপন বলেন, গণতান্ত্রিক পুনর্গঠন বা সামগ্রিক পুনর্গঠন এর ক্ষমতা যদি আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দিয়ে থাকি সে ওই ক্ষমতা কে যথাযথ চর্চা করতে পারছে কি না অথবা তার কাছে এটি কি এর স্পষ্ট এই সরকারের টার্মস অফ রেফারেন্স কতটুকু। এই বিষয়গুলো পরিষ্কার না হলে কিন্তু অনেক আলোচনায় পন্ড হয়ে যেতে পারে।

ইকতেদার আহমেদ বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন ও নির্বাচন কমিশন গঠন করার সময় সার্চ কমিটি তৈরি করা হয় যা করে উচ্চ আদালত। উচ্চ আদালত দিয়ে সার্চ কমিটি করার কোন নিয়ম নেই।

অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, আমাদের মন মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। অনেক আগে থেকেই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় নিয়োগ হয়ে এসেছে আমাদের দেশে। জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন তৈরি করা উচিত। দ্রুততম সময়ে যেই সংস্কার করা জরুরি তা করা দরকার।

ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান বলেন, বাংলাদেশে ওয়েস্ট মিনিস্টার সিস্টেমে চলেনা। এখানে জয়ীরা সব নিয়ে নেয়। বাংলাদেশে তিনটি বডির মধ্যে সেপারেশন অফ পাওয়ার আনা খুব জরুরি। সংস্কার রাতারাতি সম্ভব নয়। সংবিধান সংস্কার কমিশনের রিপোর্টে পার্লামেন্ট কেন্দ্রিক করার প্রস্তাব এসেছে। এর  সঙ্গে আমি একমত। আইন সভায় সংবিধান সংস্কারে নারী আসন রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। এই নারী আসনে তারাই আসে যেসব পুরুষ আসন পায়না। নারী আসনে নির্বাচনের মাধ্যমে আসতে হবে। সেন্সিটিভ বিষয়ে প্রয়োজনে গণভোট নিতে হবে। জুডিশিয়ারিকে আলাদা করতে হবে।

ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, গত ১৫-১৬ বছরে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের ক্যাডার বলে যারা পরিচিত তারা অনেকেই এই প্রতিষ্ঠানটিতে (পাবলিক সার্ভিস কমিশন) নিয়োজিত হয়েছেন। এই দৃষ্টি ভঙ্গি কি অবশ্যই মায়োপিক। এবং এই দৃষ্টি ভঙ্গির লিগ্যাসি শুধুমাত্র পাবলিক সার্ভিস কমিশনে নয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মধ্যেও পরোক্ষভাবে দেখতে পাচ্ছি। সেজন্য একটি কমিশন করে স্টেট উইথিন অ্যাক্টরসদের মধ্যে এই ব্যত্যয়গুলো তুলে ধরা দরকার। এই ট্রেডিশন থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
ড. জাহেদ উর রহমান বলেন, আমরা শেখ হাসিনার পতন চেয়েছি। তার পতনের পর আমরা কিছু আশা চাপিয়ে দিয়েছি। কমিশন কাজ করার জন্য ইচ্ছা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সংস্কার জনগণের ভিতরে থাকলে কোন রাজনৈতিক দল সেই সংস্কার বাদ বা বিরোধী হতে পারবে না।

মাসুদ কামাল বলেন, পরিবর্তন হতে হবে মনস্তাত্ত্বিক জগতে। আইন যারা বানায় তারাই যদি আইন ভাঙ্গে তাহলে সঠিকভাবে আইনের প্রয়োগ হয়না। সরকার শপথ নেওয়ার সময় বলে সংবিধান মেনে চলবে কিন্তু ১০ মিনিট পরেই বলে যে সে সংবিধান মানেনা।

আবু সাঈদ খান বলেন, রাজনীতি ঠিক না হলে কোন কমিশনই ঠিক হবে না। কালো আইনগুলো বাদ দিয়ে সংবিধানকে মুক্ত করতে হবে। সংবিধানের অগণতান্ত্রিক বিধানগুলো বাদ দিতে হবে। সব অন্তর্বর্তীকালীন সরকার করতে পারবে না এর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলতে হবে।

জোনায়েদ সাকি বলেন, প্রস্তাবনা যা তৈরি হয়েছে কিছুর  সঙ্গে আমরা একমত আবার কিছুর  সঙ্গে একমত না। নির্বাচন লাগবে সংস্কার করার জন্য। বাংলাদেশে এখন সিস্টেম তৈরি করতে হবে, রাষ্ট্রে পরিবর্তন আনতে হবে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জনগণের জন্য তৈরি করা। 

সাংবাদিক সোহরাব হাসান বলেন, মানুষ পরিবর্তন না হলে প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন হবে না। প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন না হলে মানুষ পরিবর্তন হবে না। শেখ হাসিনা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বাঁধা দিয়েছে তাই তার পতন হয়েছে। সরকার ও বিরোধীদলের মধ্যে ঐক্যমত থাকতে হবে।

প্রসঙ্গত, সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) বাংলাদেশভিত্তিক একটি থিঙ্কট্যাঙ্ক যা সুশাসন, দুর্নীতি, মানবাধিকার, গণতন্ত্র এবং উন্নয়নের বিষয়ে গবেষণা ও মিডিয়া স্টাডি পরিচালনা করে। দ্রুতপরিবর্তনশীল জাতীয় ও বৈশ্বিক পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ্য হলো শিক্ষাগত সম্প্রদায়, সরকার, বেসরকারিখাত, সুশীল সমাজ এবং উন্নয়ন অংশীদারদের মধ্যে শাসনের মান উন্নত করা, বাংলাদেশের নিরাপত্তার চাহিদা পূরণ করা, দারিদ্র্য নিরসনের জন্য উপলব্ধসম্পদের দক্ষ ও বিচক্ষণ ব্যবহার করার শর্ত তৈরি করা, মানব সম্পদ উন্নয়ন এবং বর্ধিত গণতন্ত্রীকরণ, অংশগ্রহণ এবং টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে রাজনৈতিক ও সামাজিক শৃঙ্খলার স্থিতিশীলতা।
 

স্বপ্না চক্রবর্তী /মো.মহিউদ্দিন

×