ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ৩০ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭ মাঘ ১৪৩১

সাভার গণহত্যার ৬ ঘণ্টা: ৫ আগস্টের রক্তাক্ত ইতিহাস

প্রকাশিত: ১২:১১, ৩০ জানুয়ারি ২০২৫

সাভার গণহত্যার ৬ ঘণ্টা: ৫ আগস্টের রক্তাক্ত ইতিহাস

৫ আগস্ট, দুপুর আড়াইটা। যখন শেখ হাসিনাকে বহন করা বিমান দেশের সীমানা ছাড়ছিল, তখন সাভারের রাস্তাগুলোর চিত্র ছিল ভিন্ন। মুহূর্তেই পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ছাত্র জনতার উত্তাল ঢল, লোকারণ্য মহাসড়ক, আর একদিকে পালিয়ে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে,সাভারের পরিস্থিতি তখনও ভয়াবহ ছিল।

সাভার উপজেলা শহরে ১৫ জন নিহত এবং ৩৩ জন মারাত্মকভাবে আহত হয়, আর গুলির শব্দ ছড়িয়ে পড়ে পুরো এলাকায়। নিহতদের মধ্যে ১০ জন ছাত্র, বাকি ৫ জন ছিল শ্রমজীবী মানুষ। তাদের শরীরের বিভিন্ন অংশে গুলি লেগে প্রাণ ঝরে যায়। গুলি লাগে মাথায়, গলায়, বুকে, কোমরে, এমনকি উরুতেও। এই ছিল সাভারের রক্তাক্ত ৬ ঘণ্টা,যখন প্রাণ চলে যায়, আর ইতিহাসে চিরকাল রয়ে যায় এক নিষ্ঠুর অধ্যায়।

মাথায় প্রাণঘাতী গুলি লাগে চারজনের।বুক থেকে কোমরের মধ্যে ১১ জনের ,পায়ে আটজনের আর হাতে গুলি লাগে সাত জনের।উল্লিখিত ব্যক্তিরা সহ সাত জনের একাধিক অংশে গুলি লাগে। আহতদের ১৯ জনেরই প্রাণঘাতী গুলি লাগে।

সেদিন গুলিবিদ্ধ ব্যক্তিদের আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠেছিল থানার নিকটবর্তী দুটি হাসপাতাল।উপজেলা হাসপাতাল থেকে রক্তপাত বন্ধ করে সংকটাপন্ন রোগীদের পাঠানো হয় এনাম মেডিকেল হাসপাতালে।হাসপাতালের জরুরি বিভাগ সন্ধ্যার দিকে গুলিবিদ্ধ ব্যক্তিদের চাপ আর সামলাতে পারছিল না।বাধ্য হয়ে জরুরি বিভাগের বাইরে হুইলচেয়ারে চলে চিকিৎসা। 

আহতদের কিছু আশুলিয়া এলাকায় গুলিবিদ্ধ হলেও অধিকাংশই গুলিবিদ্ধ হন সাভার উপজেলা এলাকায়।অধিকাংশই বিক্ষোভকারীরা নিজেদের ফোনে ধারণ করেছেন। তাঁরা গুলিবর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছিলেন।

মাত্র ছয় ঘণ্টায় কিভাবে ১৫জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়?

ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সাভার থানা বাসষ্ট্যান্ড সংলগ্ন গলিটি, যেখানে এক কিলোমিটার এগোলেই সাভার থানা, এবং এই গলিতেই সবচেয়ে বেশি হতাহত ঘটেছিল।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হওয়া এই মিছিল গণভবনের দিকে এগোতে থাকে সকাল ১১ টার দিকে। আশুলিয়ার বাইপাইলে দিক থেকে আসা ছাত্র জনতা যুক্ত হতে মিছিলটির গতি বাড়তে থাকে।

সাভার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সকাল থেকেই শক্ত অবস্থান নেয় পুলিশ। কোনও মিছিল যাতে ঢাকায় প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য গলিগুলোতে থেমে থেমে ছোঁড়া হয় কাঁদানে গ্যাস ৷ এমনকি প্রাণঘাতি গুলি।

সেখানে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগের কয়েকজন কেউ দেখেছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। যদিও সে সবের কোনও ফুটেজ বা ছবি জোগাড় করা সম্ভব হয়নি। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। যখন জাহাঙ্গীরনগর থেকে আসা মিছিলটি সাভার বাসস্ট্যান্ড পৌঁছায়। 

সেনাপ্রধান দুপুর ২ টায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন, সে খবর তখন মিছিলের ছড়িয়ে যায়।মিছিলটি ঢাকার দিকে এগোতে চাইলে পুলিশের তীব্র বাধার মুখে পড়ে। কাঁদানে গ্যাস,ছোঁড়া গুলিতে রণক্ষেত্র গোটা সাভার বাসস্ট্যান্ড স্ট্যান্ড।

শতাধিক পুলিশ অংশ নিয়েছিল এই আক্রমণে ।বেশিরভাগই সাভার থানার। বাকিরা এসেছিলেন আশপাশের থানাগুলি থেকে ।কাঁদানে গ্যাসেও আন্দোলনকারীরা পিছু হটেননি। তাদের আটকাতে এবার প্রাণঘাতী গুলিবর্ষণ শুরু করে পুলিশ। 

ঢাকা আরিচা মহাসড়কের বিভাজক কম করে হলেও চার ফুট উঁচু একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির বুক পর্যন্ত। তাই ধারণা করা হয়, কাইয়ুমের পেটে গুলি লাগে সেটি ছোড়া হয় সামনের কোন উঁচু ভবন থেকে ।কাইয়ুমের উল্টোপাশেই বহুতল সিটি সেন্টার ভবন। 

চোরাগোপ্তা হামলায় প্রায় ২০ মিনিট ধরে গোলাগুলি চলে। কিন্তু কে বা কারা গুলি করেছেন তা কোনও ভাবে শনাক্ত করা যায়নি। সেসময় পুলিশ অবস্থান করছিলপাকিজা ইউরোপে রাস্তার পশ্চিম পাশে ।

অসংখ্য বিক্ষোভকারীকে নিউ মার্কেট এলাকায় রেখে পুলিশের গুলির মুখে এগিয়ে যায় ৮-১০ জন কিশোর।ততক্ষণে গুলি করতে করতে পুলিশ থানা বা স্ট্যান্ডে পিছিয়ে যায়।

হাসপাতালের পেছনের ভবন থেকে গুলি হয়েছে সন্দেহে সেখানে ভাংচুর করে বিক্ষুব্ধরা। নিউ মার্কেট থেকে থানা বাসষ্ট্যান্ড প্রায় এক কিলোমিটারের ব্যবধানে প্রাণঘাতী বুলেটে মারাত্মক আহত অন্তত ১৮, আর নিহত আট জন। 

সাভারে সংঘর্ষ চললেও রাজধানীর পরিস্থিতি তখন ভিন্ন।কোথাও কোনও বাধা নেই।গণভবনে হাজারো জনতা।বিজয়ের খবর পুলিশের কানেও পৌঁছেছে।তাই তাঁরা থানার দিকে পিছু হটতে থাকে। তখন ছাত্র জনতার একটি অংশ চলে যায় ঢাকার দিকে।আর একটি অংশ শহরে পুলিশের গুলিবর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।এগিয়ে যায় সাভার থানার দিকে।

এনাম মেডিকেল হাসপাতাল পার হতেই আবার চোরাগোপ্তা গুলি।বিক্ষুব্ধ কেউ কেউ পাশের একটি বহুতল ভবনে হামলা চালান। ভাঙচুর করা হয় নীচতলায় একটি রেস্তোঁরা। যদিও হামলাকারীর সন্ধান মেলেনি।

তখনও থানার দিক থেকে গুলিবিদ্ধ ব্যক্তিকে আনতে দেখা যায়।মুক্তির মোড় থেকে কিছুটা এগোতেই ছোট্ট চৌরাস্তার মোড়।মোড়ে একপাশে উপজেলা হাসপাতাল।চৌরাস্তার কয়েক গজ দূরেই সাভার থানা এখানকার রাস্তাগুলো বেশ সরু। এই সময়টায় বিক্ষোভকারী আর পুলিশ মুখোমুখি অবস্থানে চলে আসে।

প্রায় ২০ মিনিট পর বিক্ষোভকারীরা চৌরাস্তার মোড় দখল করে নিল।বাড়তে থাকে ছাত্র জনতার সংখ্যা।থানার মসজিদের ছাদ থেকে হঠাৎ কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। পরে থানা থেকে বেরিয়ে আসে পুলিশ। কিছুক্ষণ পর শুরু হয় প্রাণঘাতী গুলিবর্ষণ।

থানার ঠিক উল্টোদিকে হাসপাতালের সীমানায় দীর্ঘক্ষণ পড়েছিলেন গুলিতে নিহত এক ব্যক্তি।তচৌরাস্তায় গুলিবিদ্ধ স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থী সাফওয়ান আখতার সদ্য। সেখানে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত শ্রমিক আল আমিন ।বুকের বাঁ পাশে গুলি লাগে পিঠের ডান পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়।

ছাত্র জনতা জড়ো হতে থাকে মুক্তির মোড়ে।আগের দফায় গুলিবর্ষণের পর আরও বাড়তে থাকে বিক্ষোভকারীদের সংখ্যা। তখনই আরেক দফা চোরাগোপ্তা গুলিবর্ষণ ।ভবন থেকে গুলি ছোড়া হয়েছে এমন কথা প্রেক্ষিতে ভবনটিতে প্রবেশ করে বাসায় বাসায় তল্লাশি চালানো হয়।

পুলিশের বর্বরতার শিকার ছাত্র জনতা এবার আগের চেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ। পুলিশও ছিল মরিয়া। আন্দোলনকারীরা এগোতে থাকেন। পুলিশের খুব কাছাকাছি চলেও যান ।হঠাত্ পুলিশের প্রাণঘাতী গুলিবর্ষণ। 

মুহূর্তেই ফাঁকা চৌরাস্তা ,আশপাশের গলি।রাস্তায় গুলিবিদ্ধ নিথর দেহ।পুলিশের এই গুলিবর্ষণ চলে প্রায় ২০ মিনিট ধরে।এবারের গুলিবর্ষণে চার জন নিহত হয়।

 শিক্ষার্থী মোহাম্মদ মিঠুর বুকে গুলি লেগে বেরিয়ে যায়।উরুতে লাগা গুলিতে অধিক রক্তক্ষরণে মারা যান শিক্ষার্থী তানজির খান। গোলাগুলিতে দৌড়ে পালান নিশান খানের মাথার পেছনে মেলে আঘাতের ক্ষত ।হাসপাতালে আনার পর তার মৃত্যু হয়। গুলিবিদ্ধ অনেকে দীর্ঘক্ষণ পড়ে ছিলেন রাস্তায় ।

গুলিবিদ্ধ এসব ব্যক্তিদের একে একে আনা হয় কাছের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।কিছুক্ষণ আগেও তাঁরা করেছিলেন চৌরাস্তার মোড়ে,আশেপাশে।

গুলিবর্ষণ করার পরই পালানোর পথ খুঁজতে থাকে পুলিশ। পেছনের নদী ধরে পালান কেউ কেউ ।পোশাক পাল্টে জনস্রোতে মিশে যান অনেকে।তখন দীর্ঘ সময় জুড়ে স্লোগান ভেসে আসে পুলিশের বহর থেকে, জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা ৷ এ সময়ে অধিকাংশ পুলিশ সদস্য থানা রোড ধরে বেরিয়ে যান। তখনও এই বহর থেকে চলে গুলিবর্ষণ।বহরের সামনে হেঁটে ঘুরেছিলেন দেড় শতাধিক সদস্য। 

দ্বিতীয় সারিতে কয়েকটি মোটরসাইকেল। পরের সারিতেই গাড়ির বহর সংখ্যা ১৩।স্থানীয়দের দাবি,বহরের মাইক্রোবাসে স্থানীয় আওয়ামী লীগ দলটির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের অনেকেই নিরাপত্তা দিয়ে নিয়ে যায় পুলিশ৷ যদিও তা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।মহাসড়ক থেকে ও পাশের গলিতে গুলি করে পুলিশ।আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে উপজেলা শহর জুড়ে। অবশেষে সাভার ক্যান্টনমেন্ট এলাকার দিকে চলে যায় পুলিশ।এখানকার স্বজনদের আহাজারি মিলিয়ে যাচ্ছিল বাহিরের বিজয় উল্লাসে।শুধু সাভার নয়, গোটা দেশ তখন সরকার পতনের আনন্দে মত্ত।

৫ আগস্টের সাভার গণহত্যা আমাদের ইতিহাসে এক অন্ধকার দিন। সে দিন যারা প্রাণ হারিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন তরুণ ছাত্ররা, সাধারণ মানুষ, শ্রমজীবী মানুষ, যাদের চোখে ছিল একটি স্বপ্ন-একটি উন্নত, সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ। সেই দিন, হাসিনা পালানোর পর সাভারের রাস্তায় যে রক্তের বন্যা বইয়ে গিয়েছিল, তা কেবল একটি রাজনৈতিক সংঘর্ষের ফল নয়,  ইতিহাসের এক অন্ধকার অধ্যায় হয়ে রয়ে গেছে।

সূত্র:https://tinyurl.com/22pxa8t3

 

আফরোজা

×