পুলিশ
সারাদেশে ক্রমবর্ধমান নানা অপরাধ বন্ধ এবং মানুষের জানমালের নিরাপত্তার জন্য বিশেষ অভিযান চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ছয় মাসের চেষ্টায়ও ভেঙে যাওয়া মনোবল এখনো ফিরে পায়নি পুলিশ। এ কারণে একের পর এক ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দখল, ডাকাতি, মবজাস্টিস, সাইবার ক্রাইম, প্রতারণাসহ নানা অপরাধ মোকাবিলায় সামর্থ্য দিয়ে চেষ্টা করেও অপরাধ দমনে তেমন ভূমিকা পালন করতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকা-ে জানমালের নিরাপত্তা নিয়ে মানুষ শঙ্কিত।
অপরাধ নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ। সামর্থ্য দিয়ে পুলিশ চেষ্টা করলেও অনেক ক্ষেত্রেই এ বাহিনীর সদস্যরা অপরাধী চক্রের কাছে অসহায় হয়ে পড়ছে। যথাযথ ন্যায়বিচারের অভাবে আইন নিজ হাতে তুলে নিচ্ছে মানুষ, ফলে মব জাস্টিস ঘটছে। তুচ্ছ ঘটনায়, সামান্য অপরাধেও মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনায় মানুষের অসহিষ্ণু হয়ে ওঠার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া, দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের জবাবদিহিতার অভাব এক্ষেত্রে অনেকাংশে দায়ী বলে মনে করেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে ক্রমবর্ধমান অপরাধের ঘটনা স্বীকার করছে অন্তর্বর্তী সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, দেশে ছিনতাই, চাঁদাবাজি হচ্ছে এবং যারা করছে তারা ধরাও পড়ছে। জামিনে ছাড়া পাওয়ার পর আবার তারা এসব করছে, এটা সত্যি কথা। আমরা চেষ্টা করছি যেভাবে হোক এটি কমিয়ে আনার জন্য। কারাগারে জরুরি সেবা হটলাইন নাম্বার ০৯৬১২ উদ্বোধনের পর সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।
শীর্ষ সন্ত্রাসীরা জামিনে মুক্তি পেয়ে আবারও সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ছে, ঢাকা শহরে ভীতিকর পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে-সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের উত্তরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জানিয়েছেন, তাদের আবার ধরে তাড়াতাড়ি আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। যেই ধরা পড়বে তাকেই আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।
পুলিশের স্বল্পতা আছে কিনা জানতে চাওয়া হলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জানান, পুলিশের স্বল্পতা নেই হয়তো কাজে আগের মতো উদ্যমটা নেই। তাদের কাজের উদ্যমটা যেন বাড়ানো যায় সেজন্য আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।
সারাদেশের অপরাধের চিত্র কেমন হতে পারে তা খোদ রাজধানীর অপরাধের চিত্র তুলে ধরা হলেই সহজেই অনুমেয়। গত এক সপ্তাহে যেসব অপরাধের ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে ইতি জুয়েলার্সের মালিক সজল রাজবংশী রাতের বেলায় দোকান বন্ধ করে মোটরসাইকেল নিয়ে বাসায় ফিরছিলেন।
পথিমধ্যে সেকশন বেড়িবাঁধ এলাকায় পৌঁছালে একাধিক মোটরসাইকেলে সাত-আটজন এসে সজলের মোটরসাইকেলের গতিরোধ করে এবং তার বাঁ পায়ের হাঁটুতে গুলি করে। পরে তারা সজলের কাঁধে থাকা স্বর্ণের ব্যাগটি ছিনিয়ে নিয়ে যায়। আহত সজলের দাবি, তার ব্যাগে ৫০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ও সাড়ে তিন লাখ টাকা ছিল। এর আগে দিবাগত রাতে রাজধানীর গুলশান-২ ইসিজি মার্কেটের সামনে মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ী আব্দুল কাদের শিকদার (৩০) ও তার মামাতো ভাই আমির হামজাকে (২৫) কুপিয়ে ৮০ লাখ টাকাসহ ডলার ও ইউরো ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে।
মিরপুর সিটি কলোনি এলাকায় মোবাইল ছিনতাইয়ের ঘটনার প্রতিবাদ করায় মো. মিলন (২২) নামের এক পোশাক শ্রমিককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ঢাকার বিজয়নগর পানির ট্যাংকের কাছে সাজু মোল্লা নামে এক প্রাইভেটকার চালক ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছেন।
মেরুল বাড্ডার আনন্দনগরে টিপু মিয়া নামে এক প্রাইভেটকার চালককে ছুরিকাঘাত করে ২৮ হাজার টাকা এবং একটি মোবাইল ফোন নিয়ে গেছে ছিনতাইকারীরা। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনে অছিম পরিবহনের একটি বাসে যাত্রীবেশে ১০-১২ জন দুর্র্বৃত্ত যাত্রীর মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়েছে।
মুক্তিপণ আদায় ও চাঁদার জন্য প্রকাশ্যে কোপানোর মতো ঘটনা মানুষের মধ্যে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। এর সঙ্গে আগে থেকেই রয়েছে ছিনতাই আতঙ্ক। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন এলাকায় ব্যবসায়ীদের হুমকি দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। পুলিশ বলছে, অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন ঘটনায় পেশাদার অপরাধীদের পাশাপাশি শীর্ষ সন্ত্রাসীদের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোড এলাকায় বিপণিবিতান মাল্টিপ্যান সেন্টারের সামনে ব্যবসায়ী এহতেশামুল হককে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে জখম করে ৮-১০ দুর্বৃত্ত। এ ঘটনায় সন্ত্রাসী ‘ইমন গ্রুপ’ জড়িত বলে জানতে পেরেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে পেশাদার অপরাধীরা তৎপর হয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) এসআইভিএসের (সাসপেক্ট আইডেন্টিফিকেশন অ্যান্ড ভেরিফিকেশন সিস্টেম) তথ্যানুযায়ী, রাজধানীর ৫০ থানা এলাকায় ছিনতাই ও ডাকাতিতে জড়িত প্রায় তিন হাজার ২০০ জন। জানা গেছে, পরিসংখ্যানের চেয়ে বাস্তবে ছিনতাই-ডাকাতিতে জড়িত অপরাধীর সংখ্যা আরও বেশি। প্রতিদিন নতুন নতুন মুখ ছিনতাইয়ে যুক্ত হচ্ছে।
ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন, প্রকাশ্য দিনের বেলায়ও ছিনতাই, চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটছে। রাতের ঢাকায় ছিনতাই প্রতিরোধে পুলিশের সক্রিয়তা কম। টহল পুলিশের দেখাও মেলে না। আবার ছিনতাই হওয়া অর্থ ও মালামাল উদ্ধারের নজিরও কম। ফলে ছিনতাইয়ের ঘটনা বাড়ছে।
ডিএমপির একাধিক সূত্র বলছে, গত ৫ আগস্টের পর অপহরণ, চাঁদাবাজি, ছিনতাই ও ডাকাতির মতো যেসব অপরাধ এখন বেশি ঘটছে, এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই পেশাদার অপরাধী। শুধু রাজধানী নয়, দেশের বিভিন্ন এলাকাতেও পেশাদার অপরাধীরা সক্রিয়। পেশাদার অপরাধী ও শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তৎপরতা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের বিভিন্ন বৈঠকেও আলোচনা হচ্ছে। ২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২৩ জন শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকা প্রকাশ করে।
তাদের অনেকে এখন সক্রিয় হয়ে উঠেছে। গণ-অভ্যুত্থানে বিতর্কিত ভূমিকার কারণে পুলিশের মনোবল ও তৎপরতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। কারাগার থেকে অপরাধীরা ঢালাওভাবে বের হচ্ছে। যৌথ বাহিনীর জোরালো উদ্যম নেই। অনেক ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে গড়িমসি করছেন অনেক পুলিশ সদস্য। এসব কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে, যা জনজীবনে উদ্বেগ তৈরি করছে বলে মনে করেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) রেজাউল করিম মল্লিক গনমাধ্যমে বলেছেন, সাধ্য অনুযায়ী অপরাধ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি আমরা। সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্যও আমাদের বিশেষায়িত টিম কাজ করে যাচ্ছে। নিয়মিত প্যাট্রোলিং করা হচ্ছে সাইবার জগৎ।