সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান
বেশ আড়ম্বর করেই সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বিগত সরকারের আমলে অনুমোদন পায় উৎপাদনের অংশীদার চুক্তি (পিএসসি)। শুরু থেকেই বলা হয়েছিল এই পিএসসি এতই আকর্ষণীয় যে বিশ্বের বড় বড় কোম্পানিগুলো দরপত্র জমা দিতে আগ্রহী। কিন্তু সরকার বদলের পরিপ্রেক্ষিতে দফায় দফায় সময় বাড়ালেও একটি আবেদনও জমা পড়েনি।
বিশ্বের বাঘা বাঘা ১৭ কোম্পানি ডাটা এবং অন্তত ৭টি কোম্পানি মূল প্যাকেজ কিনলেও শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত আগ্রহ প্রকাশ করেনি একটি কোম্পানিও। আর এর অন্যতম কারণ হিসেবে কোম্পানিগুলো জানিয়েছে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতাকে। একই সঙ্গে গভীর সমুদ্র থেকে স্থলভাগ পর্যন্ত পাইপলাইনের হুইলিং চার্জ, ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ড (ডব্লিউপিপিএফ) এবং ডাটার উচ্চমূল্যও।
কোনো কোনো ডাটা প্যাকেজের দাম ধরা হয়েছে মিলিয়ন ডলারের মতো। যা অন্য দেশে ফ্রিতে পাওয়া যায়। কোম্পানিগুলোর এই অনীহার কারণে দেশীয় সমুদ্রসীমায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম স্থবির হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
২০২৩ সালে মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদন পায় সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য উৎপাদনের অংশীদার চুক্তিটি (পিএসসি)। বছরের শেষের দিকেই দরপত্র আহ্বানের পরিকল্পনাও নেয় জ্বালানি বিভাগ। যুক্তরাষ্ট্রের এক্সন মোবিল, শেভরনসহ বেশ কয়েকটি বাঘা বাঘা কোম্পানি আগ্রহও প্রকাশ করে। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনসহ বেশ কিছু বাস্তবতায় ওই বছর দরপত্র কার্যক্রম বন্ধ থাকে।
পরবর্তীতে গত বছরের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর আবারও দরপত্র আহ্বানের তোড়জোড় শুরু করে তৎকালীন সরকার। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে আগ্রহী করে তোলার জন্যই আকর্ষণীয় করা হয় পিএসসি। আগের পিএসসিগুলোতে গ্যাসের দর স্থির করে দেওয়া হলেও এবার ব্রেন্ট ক্রুডের দরের সঙ্গে মিল করে দেওয়া হয়। প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম ধরা হয়েছে ব্রেন্ট ক্রুডের ১০ শতাংশ দরের সমান।
যা আগের পিএসসিতে যথাক্রমে অগভীর ও গভীর সমুদ্রে ৫.৬ ডলার ও ৭.২৫ ডলার স্থির দর ছিল। দামের পাশাপাশি বাংলাদেশের শেয়ারের অনুপাতও নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মডেল পিএসসি-২০১৯ অনুযায়ী গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে বাংলাদেশের অনুপাত বৃদ্ধি পেতে থাকবে। আর কমতে থাকবে বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ার।
গভীর সমুদ্রে ৩৫ থেকে ৬০ শতাংশ এবং অগভীর সমুদ্রে বাংলাদেশের হিস্যা ৪০ থেকে ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত ওঠানামা করবে। কিন্তু তারপরও কোনো আগ্রহী প্রতিষ্ঠান না পাওয়াটা চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কেনো কোনো কোম্পানি আবেদন জমা দেয়নি এটি অনুসন্ধান করে বের করতে পেট্রোবাংলা একটি কমিটিও তৈরি করেছে।
ওই কমিটির তত্ত্বাবধানে পেট্রোবাংলা কোম্পানিগুলোর কাছে দরপত্র জমা না দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে সম্প্রতি একাধিক কারণ জানিয়েছে বহুজাতিক তেল কোম্পানিগুলো (আইওসি)। কারণ হিসেবে তারা জানিয়েছে, গভীর সমুদ্র থেকে স্থলভাগ পর্যন্ত পাইপলাইনের হুইলিং চার্জ, ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ড (ডব্লিউপিপিএফ), ডাটার উচ্চমূল্য, পাশাপাশি দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা অন্যতম।
কোম্পানিগুলো জানায়, বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী ডব্লিউপিপিএফের জন্য নির্ধারিত পরিমাণ অর্থ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বিশাল বিনিয়োগ তার মুনাফাও বিশাল হওয়ার কথা, ওই ফান্ড নিয়ে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো কেউ কেউ আপত্তি তুলেছে। বহুজাতিক কোম্পানি শেভরনের সঙ্গে তার কর্মীদের বিবাদ বিদ্যমান।
এ বিষয়ে কারণ অনুসন্ধান কমিটির প্রধান পরিচালক (পিএসসি) আলতাফ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা প্রত্যেকটি কোম্পানিকে মেইল করে তাদের মন্তব্য জানতে চেয়েছি। একাধিক কোম্পানির উত্তর পেয়েছি। তাদের কাছে আরও বিস্তারিত জানানোর অনুরোধ করা হয়েছে।
বিশ্বের বড় বড় কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে দরপত্র পাওয়ার আশায় গত বছরের ১০ মার্চ থেকে শুরু হয় ‘রোড-শো’ও। ২৬ টি ব্লকে জ্বালানি অনুসন্ধানে বিশ্বের অন্তত: ৫৫টি কোম্পানিকে দরপত্রে অংশগ্রহণের জন্য আহ্বান জানানোর লক্ষ্যে কাজ শুরু করে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)।
কিন্তু ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরপরই কার্যক্রমে পুনরায় স্থবিরতা এলেও অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আবারও শুরু করে দরপত্র গ্রহণের কার্যক্রম। এ সময় অন্তত ১৭টি কোম্পানি ডাটা কেনার পাশাপাশি মূল প্যাকেজ কিনে ৭টি কোম্পানি। কিন্তু সময় পেরিয়ে গেলেও কোনো কোম্পানি আবেদন জমা দেয়নি।
দেশের উত্তরোত্তর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা মেটাতে গভীর ও অগভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের লক্ষ্যে প্রণীত খসড়া ‘বাংলাদেশ অফশোর মডেল প্রোডাকশন শেয়ারিং কন্টাক (পিএসসি) ২০২৩’ অনুমোদন দেওয়া হয়। সমুদ্রসীমা বিজয়ের পর এক দশক ধরে ব্যর্থতার বৃত্তেই ঘুরপাক খাচ্ছিল বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ। চারটি বিদেশী কোম্পানি কাজ শুরু করলেও তিনটি ছেড়ে গেছে বঙ্গোপসাগর। গত ১০ বছরে নতুন করে কোনো দরপত্র আহ্বান করা হয়নি।
পিএসসির চূড়ান্ত খসড়া অনুমোদন পায় গত বছরের ৭ জুলাই। এর পরপরই এক্সন মোবিলসহ আরও ১০টি ছোট-বড় কোম্পানি অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে। কিন্তু আকর্ষণীয় পিএসসি থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের সমুদ্রভাগে কোনো বিদেশী কোম্পানি তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমে কেনো আবেদন জমা দেয়নি।