বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাস যেন অনিয়ম আর গণতন্ত্রহীনতার এক দীর্ঘ গল্প। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত যতগুলো নির্বাচন হয়েছে সবগুলো নির্বাচনই ছিল বিতর্কিত।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে অনুষ্ঠিত ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনও বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল না।বারোটি নির্বাচনের মধ্যে নির্দলীয় নির্বাচন হয়েছে চারটি, যা কিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং নির্দলীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে হয়েছিলো।
এসব নির্বাচনের পরে আওয়ামীলীগ ৬ বার, বিএনপি ৪ বার এবং জাতীয় পার্টি ২ বার সরকার গঠন করেছিলো। সব নির্বাচনের পরে অভিযোগ ছিল ভোট কারচুপি ,জালিয়াতি এবং অনিয়মের।
১৯৭৩ সালের দেশব্যাপী আওয়ামী লীগের বিপুল জনপ্রিয়তা ছিল। সে সময় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ওই নির্বাচনে ১৯৭৩ নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায় মোট ৩০০ আসনের ২৯৩ টি আসনে জয় লাভ করেছিলো আওয়ামী লীগ।ওই নির্বাচনের পরে বিরোধী দল অভিযোগ তুলেছিল ভোট কারচুপির।এই সংসদের মেয়াদ ছিল দুই বছর ছয় মাস।এরপর ১৯৭৯ সালের জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে জাতীয় সংসদের মেয়াদ ছিল তিন বছর।
তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৬ সালে।নির্বাচনে ১৫৩ টি আসন পেয়ে জয়লাভ করে জাতীয় পার্টি ।‘৮৬ সালের এই নির্বাচন বয়কট করেছিল বিএনপি।তবে আওয়ামী লীগ বিরোধী দল হিসেবে সংসদে অংশগ্রহণ করেছিল।এই সংসদের মেয়াদ ছিল ১৭ মাস।
এরপর ১৯৮৮ সালে অনুষ্ঠিত হয় চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।নির্বাচনে আওয়ামীলীগ সহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন বর্জন করেছিল।এই নির্বাচন ছিল অনেক বিতর্কিত,কেননা বড় রাজনৈতিক দলগুলো অংশগ্রহণ করেনি।৫১ টি আসন পেয়ে জাতীয় পার্টি এ নির্বাচন জয় লাভ করেছিল এবং সংসদের মেয়াদ ছিল দুই বছর।
পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম নির্বাচন যা কিনা নির্দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। নির্বাচনের বড় দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির সহ ৭৫ টি দল অংশগ্রহণ করেছিল। এই নির্বাচনে ১৪০টি আসন পেয়ে জয়লাভ করেছিল বিএনপি।এই সংসদের মেয়াদ ছিল চার বছর আট মাস।
বাংলাদেশে দুটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৬ সালে।প্রথমটি ছিল বিএনপির একক নির্বাচন। সব রাজনৈতিক দল এই নির্বাচন বর্জন করেছিলো। সংসদে আনুষ্ঠানিক কোন বিরোধী দল ছিল না।একটিমাত্র আসন পেয়ে বিরোধী নেতার চেয়ারে বসেছিলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি,ফ্রিডম পার্টির সৈয়দ ফারুক রহমান।অবিশ্বাস্য হলেও সত্য,এই সংসদের মেয়াদ ছিল মাত্র ১১ দিন!
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৬ সালের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে জোরালো লড়াই হয়েছিলো এই ৯৬ এর নির্বাচনে।বিজয়ী দল ছিল আওয়ামী লীগ,প্রাপ্ত আসন ছিল ১৪৬ টি।বিএনপি পেয়েছিল ১১৬ টি,জাতীয় পার্টি ৩২ টি দল এবং সতন্ত্র থেকে ৬টি আসন পেয়েছিল। এই সংসদের মেয়াদ ছিল পাঁচ বছর। মেয়াদ শেষ করে নির্দলীয় সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিল আওয়ামীলীগ।
এরপর অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০০১ সালে।নির্বাচনে বিএনপি পেয়েছিলো ১৯৩ টি আসন। মাত্র ৬২টা আসন পেয়েছিল আওয়ামী লীগ। আওয়ামিলীগ এ নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেয়নি। বিএনপি সরকার গঠন করলে আওয়ামী লীগ সংসদে যোগ দিতেও আপত্তি জানিয়েছিল। তারপর এক সময় আওয়ামী লীগ সংসদে বিরোধী দল হিসেবে যোগ দেয়। এই সংসদের মেয়াদও ছিল পাঁচ বছর।
২০০৭ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে জনগনের তীব্র আন্দোলনের মুখে রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে সেনাবাহিনী। দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৩০ আসনে জয় লাভ করেন।বিএনপি পায় মাত্র ৩০টি আসন,জাতীয় পার্টি পায় ২৭ টি আসন অন্যান্য দল ও স্বতন্ত্র দল মিলে পেয়েছিল ২৮ টি আসন ।
নির্বাচন পূর্ব সহিংসতার দিক দিয়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোটের আগের দিন পর্যন্ত নিহত হয়েছিল ১২৩ জন।
২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশের ইতিহাসে আরও একটি সাজানো একতরফা নির্বাচন।নির্বাচনে বিএনপির সহ আরো কয়েকটি দল একত্রিত হয়ে জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট গঠন করে।এই ঐক্য ফ্রন্ট আওয়ামী লীগের বিপক্ষে নির্বাচন করেছিল। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একাই ২৫৮ টি আসন পেয়েছে বলে ঘোষণা করে। এই নির্বাচনে চূড়ান্ত পর্যায়ের অনিয়ম হয়েছিল বিবিসি সহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কাছেও ধরা পড়েছিলো ভোটের আগের রাতেই ব্যালট পেপার ভর্তি বাক্স।
জনগণের কাছে এই নির্বাচন রাতের নির্বাচন হিসেবে পরিচিতি পায়। এরপর দ্বাদশ জাতীয় সংসদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০২৪ সালে। এই একতরফা নির্বাচনের প্রস্তুতি দেখে তা বয়কট করে বিএনপি জামাত সহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলো। প্রতিপক্ষবিহীন নির্বাচনকে জমজমাট করতে অভিনব কৌশলের পথ উপায় অবলম্বন করে আওয়ামী লীগ। এই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি এবং যা সহ স্বতন্ত্র পার্টি দেরকে মাঠে নামানো হয়।
শেখ হাসিনা নিজেই এসব দলের প্রার্থীদেরকে ডামি প্রার্থী হিসেবে উল্লেখ করেন। এতে দেখানো হয় যে,এই নির্বাচনে ২৯৮ টি আসনের মধ্য ২২৩ টি আসন পেয়ে জয় লাভ করে আওয়ামী লীগ। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ছিলেন ৬১ টি আসনের বিজয়ী। বিরোধী দল জাতীয় পার্টি পায় মাত্র ১১ টি আসন। এই নির্বাচনকে দেশ এবং দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক মহল ডামি নির্বাচন হিসেবে আখ্যা দিয়েছিল।
আফরোজা