- বকেয়া না পেলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যহত হওয়ার ইঙ্গিত বিপ্পার
- বিদ্যুৎ খাতের লুটপাটকারীদের বিরুদ্ধে তদন্তের দাবি
বকেয়া বিল নিয়ে সরকার ও বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে এক ধরনের স্থবিরাবস্থা বিরাজ করছে দীর্ঘদিন যাবত। চলমান বিদ্যুৎ পরিস্থিতির কারণে এমনিতেই জনসাধারণের ভোগান্তি অসহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। এর মধ্যে সেই স্থবিরাবস্থা যেন 'মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা' হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংশ্লিষ্টরা এর জন্য দায়ী করছেন বিগত সরকারের আমলে বিদ্যুৎ খাতে বেসরকারী কেন্দ্রগুলোতে যে লুটাপাটকে। গত ৬ মাসে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মালিকরা পিডিবির কাছে ১৬ হাজার কোটি টাকা বকেয়া হয়েছে দাবি করে বাংলাদেশ ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিপ্পা) বলছে, গরমের মওসুম শুরুর আগেই বকেয়া পরিশোধ করে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে সচল রাখতে হবে। নাহলে বড় ধরণের সংকট তৈরি হতে পারে। একই সঙ্গে বিগত সরকারের আমলে হওয়া দুর্নীতি ও লুটপাটের বিচার দাবি করেছে সংগঠনটি।
বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে বাংলাদেশ ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিপ্পা) বেসরকারী খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহের পরিস্থিতি আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে নেতৃবৃন্দ এসব কথা বলেন। সংবাদ সম্মেলনে বিদ্যুৎ খাতের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে উপস্থাপনা দেন বিপ্পার সাবেক সভাপতি ও কনফিডেন্স গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ইমরান করিম। আর উপস্থিত সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন বিপ্পার বর্তমান পেসিডেন্ট কে এম রেজাউল হাসনাত। এসময় তারা একটি যৌথ টাস্কৃফোস গঠনের দাবি জানিয়েছেন। পাশাপাশি অন্তবর্তী সরকার কর্তৃক সদ্য গঠিত ট্যারিফ পর্যালোচনা করতে কমিটি গঠনকে স্বাগত জানিয়েছেন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বিপ্পার সভাপতি বলেন, বর্তমানে বেসরকারি খাতে বকেয়ার পরিমাণ প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে ফার্নেস অয়েল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বকেয়া ১০ হাজার কোটি টাকা। আর অন্যান্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিপরীতে বকেয়া ৫/৬ হাজার কোটি টাকা। তিনি বলেন, আমাদের বিল সাধারন ৩০ দিনের মধ্যে পরিশোধের বাধ্যবাধকতা থাকলেও পিডিবি সেটা করছে না। এর ফলে আমরা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালান তেল কিনতে পারছি না। আর ফার্নেস অয়েল আমদানী করতে সর্বোচ্চ ৪৫ দিন সর্বনিন্ম ৪০ দিন সময় প্রযোজন হয়। এখন বিল পাওয়া না থেলে গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানো সম্ভব হবে না। যে কারনে আসন্ন গ্রীষ্মে ফার্নেস অযেল ভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হবে না। এর ফলে আগামী গ্রীষ্মে লোডশেডিং হতে পারে। ঘাটতি হতে পারে দুই থেতে তিন হাজার মেগাওয়াট।
গত ২০২০ সালে কোভিড মহামারী শুরুর পর থেকেই সরকারের কাছে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর দীর্ঘমেয়াদি বকেয়া শুরু হয়েছে উল্লেখ করে অনুষ্ঠানে জানান হয়, সর্বোচ্চ ৩০ দিন বিলম্বের কথা বলা আছে চুক্তিতে। কিন্তু বিপিডিবি ১২০ থেকে থেকে ১৮০ দিন এমনকি ২০০ দিন পর্যন্ত বকেয়া করে ফেলছে। বকেয়াকালীন এই সময়ের মধ্যে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নজনিত কারণে ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকার মতো লোকসান হয়েছে। ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের সুদ বাবদ লোকসান হয়েছে ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা।
আগামী গ্রীষ্ম মওসুমে তেল ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালাতে এখনই জ্বালানির এলসি চালু করা প্রয়োজন উল্লেখ করে ইমরান বলেন, আজকে এলসি চালু করলে ৪৫ দিন পর সেই তেল কেন্দ্রে পৌঁছাবে। বকেয়া টাকা হাতে না ফেলে প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে এলসি চালু করা সম্ভব নয়।
বর্তমানে ৯ হাজার মেগাওয়াট থেকে ১০ হাজার মেগাওয়াটের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে যেখানে তরল জ্বালানি থেকে মাত্র ৪০০ মেগাওয়াট থেকে ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যু আসছে। তবে গরমের মওসুম শুরু হলে এই খাত থেকে অন্তত ৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের যোগান দিতে হবে।
অনুষ্ঠানে জানান হয়, এবার গরমের মওসুম আগাম বা মার্চ মাসেই শুরু হতে পারে। সেকারণে তরল জ্বালানিভিত্তিক কেন্দ্রগুলো সচল করতে এখনই উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যেই গত ডিসেম্বর থেকে তিনবার সরকারের সঙ্গে বৈঠক করে এই উদ্বেগের কথা জানিয়েছি।
এসময় বেসরকারী খাতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের লুটপাটের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে কে এম রেজাউল হাসনাত বলেন, সবাইকে এক ধরণের ভাবা ঠিক হবে না। কেউ কেউ করে থাকতে পারে। আমরা অবশ্যই লুটপাটের যে অভিযোগ উঠেছে, তা নিয়ে সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানাচ্ছি। এসময় ভারতের আদানী গ্রুপ থেকে বিদ্যুৎ কেনার নিয়ে অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আদানীর বিদ্যুতের উপর কোন ট্যাক্স-ভ্যাট নেই। তেলের উপর ১৫ শতঅংশের বেশি ট্যাক্স-ভ্যাট রয়েছে। আদানীর ট্যাক্স না থাকার পরেও ইউনিট প্রতি দাম পড়ছে ১৭ টাকা ২০ পয়সা আর তেলের ভ্যাট-ট্যাক্স দিয়েও ইউনিট প্রতি খরচ হয় ১৭ টাকা ০৬ পয়সা। তেলের ট্যাক্স বাদ দিলে খরচ আরও কমে আসবে। তিনি বলেন, আদানীর চুক্তির করার আগে তৎকালীন সরকার সরকার সুকৌশলে ফানের্স অয়েল ভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর চাইতে কম বলে প্রচারণা চালায়। এটা নিয়ে আমরা বহুবার সরকারের বিভিন্ন ফেরামে বলেছি।
সম্প্রতি বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ কেন্দ্রেগুলোর ট্যারিফ পর্যালোচনায় গঠিত কমিটি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে বিপ্পা সভাপতি বলেন, এটা করা হবে আমরা আগে থেকেই জানি। এটা নিয়ে আমাদের কোন আপত্তি নেই। আমরাও চাই পর্যালোচনা হোক। সরকার প্রতিটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে আলাদা আলাদাভাবে পর্যালোচনা করবে।
বিপ্পার সাবেক সভাপতি ও কনফিডেন্স গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ইমরান করিম তার উপস্থাপনায় উল্লেখ করেন, চলতি বছর পিক আওয়ারে সর্বোচ্চ চাহিদা হবে ১৭ হাজার দুইশ মেগাওয়াট। আর বছরে ৬ শতাংশ চাহিদা প্রবৃদ্ধি ধরা হলে চাহিদা হবে ১৮ হাজার ২৩২ মেগাওয়াট। সর্বোচ্চ পিক আওয়ারে (বিকাল চারটা থেকে রাত ১০টা) নবায়নযোগ্য কেন্দ্রগুলো থেকে কোন বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে না। ফলে চাহিদা মেটাতে হলে ফার্নেস অয়েল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানোর কোন বিকল্প নেই। কারণ গ্যাস সংকট বিদ্যামান। পাশাপাশি কয়লা ভিত্তিক কেন্দ্রগুলো পুর্ণ সক্ষমতার উৎপাদন করতে পারে না।
তিনি বলেন, ২০২২ সালের শেষ থেকে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে বেসরকারী বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। এছাড়া পিডিবির বিদ্যুতের বিল দেরিতে দেয়ার কারণে ব্যাংকের ঋণের সুদ বাবদ দিতে হয়েছে তিন হাজার ২শ কোটি টাকা। এটাও লোকসান। বেসরকারী খাতের অনেক, কোম্পানীর মূলধন এখন ঋণাত্নক হয়ে গেছে। ব্যাংকও বিশ্বাস করতে চাইছে না। এজন্য আমরা সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছি একটি যৌথ টাস্কফোর্স গঠন করতে।
তিনি বলেন, বিষয়গুলো নিয়ে সরকারের থেকে এখনই উদ্যোগ না নিলে সামনে সেচ মৌসুমে কৃষিতে সমস্যা হবে। এতে করে খাদ্র উৎপাদনে প্রভাব পড়বে। কারণ গেল বছর বন্যার কারণে খাদ্য উৎপাদন কমেছে। এবার সেচের জন্য পুনরায় খাদ্য উৎপাদন কমলে দেশের খাদ্যের ঘাটতি তৈরি হবে পারে।
স্বপ্না/ রাজু