.
সকল প্রকার অন্যায়, অবিচার, ঘুষ-দুর্নীতি ও দুঃশাসনের বিলোপ সাধন করে একটি মানবিক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। তিনি বলেছেন, একমাত্র কুরআনের শাসন বাংলাদেশে ইনসাফ কায়েম করতে পারে। ‘চাঁদাবাজি-দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ চলবে। যুদ্ধ কতক্ষণ? যতক্ষণ না ইনসাফ কায়েম হয়। এই ইনসাফ দিতে পারে একমাত্র আল কুরআন। এই কুরআনের শাসন দিয়ে আমরা বাংলাদেশ গড়তে চাই।
তিনি বলেন, ‘আমরা বৈষম্যহীন, দুর্নীতিমুক্ত, চাঁদাবাজমুক্ত, ন্যায়-ইনসাফের মাধ্যমেই বাংলাদেশ গড়তে চাই। এজন্য আমাদের লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। আমরা ত্যাগ অনেক করেছি, আরও ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। জীবন খুব ছোট, কাজ অনেক বড়। বিশ্রামের কোনো সময় নেই।’
দীর্ঘ ১৫ বছর পর শনিবার দুপুরে রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদ্রাসা ময়দানে জেলা ও মহানগর জামায়াত আয়োজিত বিশাল কর্মিসম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। হাজারো জনতায় টইটম্বুর ঐতিহাসিক মাদ্রাসা মাঠের সম্মেলনে জামায়াত আমির বলেন, ‘এই দেশে অনেকে শাসন করেছেন। আমাদের সন্তানরা এত এত রক্ত কেন দিল? কারণ, তারা চেয়েছে এই সমাজ থেকে সব ধরনের দুঃশাসন এবং দুর্নীতির কবর রচিত হোক।’
সারাদেশে চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্বের ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘যারা এখনো এসব করছেন, বিনয়ের সঙ্গে বলি, এগুলো বন্ধ করেন। তবে যদি আমাদের এই বিনয়ী অনুরোধ কেউ না মানে, তাহলে আমাদের যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। সন্তানরা স্লোগান দিচ্ছে- ‘আবু সাঈদ মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ। যুদ্ধ চলবে।’
তিনি বলেন, ‘রাজশাহীকে শিক্ষার ভিলেজ বলা হয়, শিক্ষার গ্রাম। আমি আশা করি, ৫ তারিখের (৫ আগস্ট) পর রাজশাহীতে কোনো চাঁদাবাজি হয় না। এখানকার মানুষ ভদ্র, বিনয়ী ও সৎ। কেউ চাঁদাবাজি এখানে করে না, ঠিক না?’ এ সময় নেতাকর্মীরা ‘চাঁদাবাজি হয়’ বলে আওয়াজ তোলেন। আমির প্রশ্ন করেন, ‘এখানেও চাঁদাবাজি হয়? এখানেও ফুটপাত দখল হয়? হাটবাজার, বালুমহাল, জলমহাল, যানবাহন স্ট্যান্ড, সবগুলোতে দখলদারি হয়?’ তখনো মাঠভরা নেতাকর্মীরা ‘হয়’ বলে আওয়াজ তোলেন।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘তাহলে আমাদের শহীদদের রক্তের প্রতি এটা কি ভালোবাসা? এই কাজ যারা করেন, বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ করি এই কাজটা ছেড়ে দেন। আমাদের শহীদরা কষ্ট পাবেন। অফিস আদালতে ঘুষ বাণিজ্য আছে, আবার মামলা বাণিজ্যও অনেকে করেন। তাদের প্রতি আমাদের আন্তরিক অনুরোধ এসব কাজ করবেন না। আমাদের শহীদদের আত্মা বড় কষ্ট পাবে। আমাদের জীবন্ত সন্তানরা যারা শহীদ হওয়ার নিয়ত করে রাস্তায় নেমেছিল, তারা কষ্ট পাবে। তাদের কষ্ট দেবেন না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আল্লাহর শক্তিতে বলীয়ান একটি জাতি গঠন করতে চাই। সে জাতি হবে সাহসী জাতি, বীরের জাতি। সে জাতি আল্লাহ ছাড়া কারও কাছে মাথানত করবে না। এটা করেনি বলেই বিগত ১৫টি বছর আলেম-ওলামাদের ওপর বিগত সরকার তা-ব চালিয়েছে। জামায়াতের দুজন আমিরসহ ১১ জন দায়িত্বশীল নেতাকে আমাদের বুক থেকে কেড়ে নিয়েছে। অন্যায়ের প্রতিবাদ যারা করেছে, তাদের গুম করেছে। অসংখ্য ভাইকে খুন করেছে। চাকরি কেড়ে নিয়েছে। ব্যবসা ছিনিয়ে নিয়েছে। কাউকে কাউকে দেশেও থাকতে দেয়নি। মানুষের কল্যাণে কাজ করার কারণে অনেকে জিন্দা শহীদ হয়ে আছে। হাত পা টুকরা-টুকরা করা হয়েছে। এই কষ্টের জীবন নিয়ে তারা বেঁচে আছেন।’
শফিকুর রহমান বলেন, ‘যারা রক্ত দিয়ে আজকের এই পরিবেশ দিয়ে গেছে, আমরা তাদের প্রতি ঋণী এবং কৃতজ্ঞ। এই ঋণের দায় আমাদের আজীবন শোধ করতে হবে। কতজন আদম সন্তানকে দুনিয়া থেকে বিদায় করা হয়েছে সঠিক হিসাব কেউ দিতে পারবে না। আন্দোলনের শেষ দিনগুলোতে ইন্টারনেট বন্ধ রেখে, সবকিছু অন্ধকারে রেখে অনেক লাশ গুম করা হয়েছে। স্তূপে স্তূপে লাশ। ট্রাকের ওপর ছুড়ে মারা হয়েছে। তার পর পেট্রোল ঢেলে আগুন দিয়ে লাশগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা তাদের ঋণ কোনোদিন শোধ করতে পারব না।’ এমন সাহসী সন্তান থাকলে বাংলাদেশকে নিয়ে আর ষড়যন্ত্র করে লাভ নেই মন্তব্য করে জামায়াত আমির বলেন, ‘সাংবাদিক বন্ধুরা প্রশ্ন করেছে- আপনাদের দলের কতজন শহীদ হয়েছে। আমরা বলেছি, যারা শহীদ হয়েছে আমরা তাদের দলের মানুষ। তাদেরকে কোনো দলীয় পরিচয়ে আমরা তাদের সংকীর্ণ স্থানে নামাতে চায় না। তারা জাতীয় সম্পদ। তাদের আমরা মাথার ওপরে তুলে রাখতে চাই। এক হাত চলে গেছে, আরেক হাত নিয়ে যুদ্ধ করতে চায়। এমন সাহসী মানুষ থাকলে এই জাতির ওপর কোনো ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন হবে না।’
কর্মিসম্মেলনে বিশেষ অতিথি ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ও রাজশাহী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মুজিবুর রহমান। সভাপতিত্ব করেন রাজশাহী মহানগর জামায়াতের আমির ড. মো. কেরামত আলী। আর সমাবেশ পরিচালনা করেন রাজশাহী মহানগরের সেক্রেটারি ইমাজ উদ্দিন ম-ল।
সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে আরও বক্তব্য দেন, কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সেক্রেটারি অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য নুরুল ইসলাম বুলবুল, মোবারক হোসাইন, রাজশাহী অঞ্চল পরিচালক অধ্যক্ষ মো. সাহাবুদ্দিন প্রমুখ।
রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদ্রাসা ময়দানে জামায়াতের এই কর্মিসম্মেলনে সকাল থেকেই নেতাকর্মীদের ঢল নামে। এর আগে শনিবার সকাল সোয়া ৯টায় কর্মিসম্মেলনের উদ্বোধন ঘোষণা করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রাজশাহীর শহীদ সাকিব আনজুমের বাবা সাইদুল হক। মঞ্চে বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন।
তিনি বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারকে বিদায় করতে গিয়ে আমার কলিজার টুকরা সাকিব শহীদ হয়েছে। আমি একজন গর্বিত পিতা। আমার সাকিবের মতো হাজারো ছাত্র-জনতা যে স্বপ্ন নিয়ে দেশের জন্য জীবন দিয়েছে, সেই স্বপ্ন পূরণ করতে হবে। এক্ষেত্রে কোনোভাবেই ব্যর্থ হওয়া যাবে না।
এ দিকে কর্মিসম্মেলন শেষে বেলা আড়াইটায় মাদ্রাসা মাঠ সংলগ্ন নাইস কমিউনিটি সেন্টারে মহিলা কর্মিসম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হন ডা. শফিকুর রহমান। বিকেলে তিনি চিকিৎসকদের নিয়ে সমাবেশ করেন। মাগরিবের পর রাজশাহী চেম্বার ভবনে ব্যবসায়ী সমাবেশ করেন।
জামায়াতের মিডিয়া ও প্রচার সম্পাদক আশরাফুল আলম ইমন বলেন, রাজশাহীর সবগুলো কর্মসূচি সুশৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। তিনি বলেন, রাজশাহীতে এর আগে সর্বশেষ বড় সমাবেশ হয়েছিল ২০১০ সালে।