ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ৫ মাঘ ১৪৩১

এক ডিআইজির এতো সম্পদ!

প্রকাশিত: ১৮:৪৪, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫; আপডেট: ১৮:৫৩, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫

এক ডিআইজির এতো সম্পদ!

ছবি- সংগৃহীত

পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি গাজী মোজাম্মেল হক।  ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে পুলিশের একই শাখায় থেকে বিপুল সম্পদ গড়েছেন তিনি। 

কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার বড়কান্দা ইউনিয়নের হরিপুর গ্রামে মেঘনা নদীর বুকে রিসোর্ট বানিয়েছেন পুলিশের এই অতিরিক্ত ডিআইজি।

তার বর্তমান পদ অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত ডিআইজি)। রাজধানীর উপকণ্ঠে তাঁর আবাসন ব্যবসা। আছে ১২ বিঘা জমিতে বাংলোবাড়ি। মেঘনা নদীর মাঝে রিসোর্ট। রয়েছে ওষুধ কারখানাসহ বিভিন্ন এলাকায় জমি। ২৬ বছর পুলিশের চাকরি করে এত সব সম্পদের মালিক হয়েছেন গাজী মোজাম্মেল হক। 

দেশের শীর্ষ এক গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, পুলিশের এই কর্মকর্তা নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ‘আনন্দ পুলিশ হাউজিং সোসাইটি’ নামে ১ হাজার ২০০ বিঘা জমির ওপর আবাসন ব্যবসা গড়ে তুলেছেন। তাঁর স্ত্রী ফারজানা মোজাম্মেলের নামে রয়েছে ‘আনন্দ প্রপার্টিজ লিমিটেড’ নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান। ফারজানার নামে রূপগঞ্জের বিভিন্ন মৌজায় অন্তত ৮০ বিঘা জমি রয়েছে। 

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, গাজী মোজাম্মেল হক ১৯৯৮ সালে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) পদে যোগ দেন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছর তিনি পুলিশ সদর দপ্তরে ‘ডেভেলপমেন্ট’ শাখায় কর্মরত ছিলেন। অতিরিক্ত ডিআইজি হওয়ার পরও এই শাখায় ছিলেন তিনি। পুলিশের এই শাখার কাজ বাহিনীর জমিজমা দেখাশোনা করা। ১ জানুয়ারি তাঁকে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে সরিয়ে অ্যান্টিটেররিজম ইউনিটে বদলি করা হয়। 

আনন্দ পুলিশ হাউজিং সোসাইটির ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, ২০০৭ সালে এই আবাসন প্রকল্পের যাত্রা শুরু। গত ১৮ বছরে রূপগঞ্জে এই হাউজিংয়ের নামে কেনা হয়েছে প্রায় ১ হাজার ২০০ বিঘা জমি। 

একাধিক সূত্র জানায়, গাজী মোজাম্মেল ২০০৬ সাল থেকে রূপগঞ্জে জমি কেনা শুরু করেন। পরের বছর পুলিশের কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত ও কর্মরত কর্মকর্তাকে নিয়ে গঠন করেন ‘আনন্দ পুলিশ পরিবার কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি’। এরপর আনন্দ পুলিশ হাউজিং সোসাইটি নামে আবাসন ব্যবসা শুরু করেন। গাজী মোজাম্মেল প্রকল্প পরিচালক। 

পুলিশ সদর দপ্তর থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে, আনন্দ পুলিশ হাউজিং সোসাইটি নামে পুলিশের কোনো প্রকল্প নেই। 

এই আবাসন প্রকল্পের জমি বা প্লট ক্রেতাদের মধ্যে পুলিশের অনেক কর্মকর্তা বা তাঁদের আত্মীয়স্বজন রয়েছেন। টাকা দিয়েও জমি বুঝে পাননি, এমন অভিযোগও আছে। বিভিন্ন পদমর্যাদার অন্তত ১০ জন পুলিশ কর্মকর্তা গণমাধ্যমের কাছে এমন অভিযোগ করেছেন।

এই প্রকল্পের জন্য জোর করে জমি দখলের অভিযোগও রয়েছে। রূপগঞ্জের কয়েকজন ভুক্তভোগী অভিযোগ করেছেন, জোর করে তাঁদের জমি দখল করে নেওয়া হয়েছে। প্রতিবাদ করায় তাঁদের ওপর হামলা করা হয়েছে। চাঁদাবাজি ও প্রতারণার মামলা দিয়েও হয়রানি করা হয়েছে।

মিঠু সরকার নামের একজন স্থানীয় বাসিন্দা গণমাধ্যমকে বলেন, তাঁর বাবার আড়াই বিঘা জমি বালু ভরাট করে দখল করে রেখেছেন গাজী মোজাম্মেল। এর আগে বিক্রির জন্য চাপ দেওয়া হয়েছিল। প্রায় ১০ বছর ধরে ওই জমিতে চাষাবাদ করতে পারছেন না।

শুরু থেকে আনন্দ পুলিশ হাউজিংয়ের জমি কেনাবেচার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন রূপগঞ্জের বাসিন্দা জাহের আলী। ২০১৯ সালের ১ মার্চ ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি মামলা করে জাহেরের পরিবার। আসামি করা হয় গাজী মোজাম্মেল, তাঁর স্ত্রী ও পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তাকে। অভিযোগ করা হয়, মিথ্যা মামলা দিয়ে জাহেরকে ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়ে তাঁর কাছ থেকে প্রায় ৬২ বিঘা জমি লিখে নেওয়া হয়েছে। 

ষাটোর্ধ্ব জাহের আলী গণমাধ্যমকে বলেন, রিমান্ডে থাকা অবস্থায় তাঁকে গুলি করে হত্যার হুমকি দিয়ে পাঁচটি দলিলের মাধ্যমে প্রায় ৬২ বিঘা জমি লিখে নেন মোজাম্মেল হক। পরে কারাগার থেকে বেরিয়ে তিনি সরকারের বিভিন্ন সংস্থায় গাজী মোজাম্মেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। এরপর তাঁর সঙ্গে মোজাম্মেল সমঝোতা করে ওই ৬২ বিঘা জমি ফেরত দিয়েছেন।

গাজী মোজাম্মেলের স্ত্রী ফারজানা মোজাম্মেল কাগজপত্রে আনন্দ প্রপার্টিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। কোম্পানিটি নিবন্ধিত হয় ২০১৩ সালের ১৬ জুন। নথিপত্র অনুযায়ী, আনন্দ প্রপার্টিজের ১৫ হাজার শেয়ারের মধ্যে সাড়ে ১৩ হাজারের মালিকানা ফারজানার নামে, যা মোট শেয়ারের ৯০ শতাংশ। বাকি দেড় হাজার শেয়ারের মালিক অপর দুই ব্যক্তি। যাঁরা প্রতিষ্ঠানটির কর্মচারী বলে জানা গেছে।

আনন্দ প্রপার্টিজের পক্ষে ফারজানা নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের প্রায় ৬৮ বিঘা জমি কিনেছেন। এ ছাড়া তাঁর ব্যক্তিগত নামেও জমি রয়েছে।

গাজী মোজাম্মেল হকের ভাষ্য, একটি সমবায় সমিতি করে আনন্দ পুলিশ হাউজিং চালু করা হয়। কিন্তু সমবায় সমিতির নামে জমি কেনা যায় না। তাই তাঁর স্ত্রীর নামে জমিগুলো কিনেছিলেন। পরে অধিকাংশ জমি আবার হাউজিংয়ের নামে হস্তান্তর করে দিয়েছেন। বাকি জমিগুলোও পর্যায়ক্রমে হস্তান্তর করে দেবেন।

ঢাকার ডেমরায় ফারজানা মোজাম্মেলের নামে আছে পশুপাখির ওষুধ তৈরির কারখানা ব্রিজ ফার্মাসিউটিক্যালস। ডেমরায় ওই কারখানার ফটকে থাকা নামফলকে ‘গাজী মোজাম্মেল হক’ লেখা রয়েছে। কারখানার একজন কর্মকর্তা জানান, ‘১০ বছর ধরে এই কারখানায় ওষুধ তৈরি হচ্ছে।

কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার বড়কান্দা ইউনিয়নের দক্ষিণ হরিপুর গ্রামের পাশে মেঘনা নদী। নদীর বুকে ড্রেজার বসিয়ে বালু তুলে রিসোর্ট ও মাছের খামার গড়ে তুলছেন গাজী মোজাম্মেল হক। ৮ জানুয়ারি সেখানে গিয়ে দেখা যায়, নির্মাণাধীন রিসোর্টের চারদিকে পানি। দেখতে দ্বীপের মতো। নৌকা দিয়ে যেতে হয় সেখানে। ভেতরে ঢুকে দেখা যায়, চারটি পুকুর কাটা হয়েছে। সেখান মাছ চাষ করা হচ্ছে। থাকার জন্য রয়েছে দুটি ঘর। অনুষ্ঠান করার জন্য রয়েছে দুটি বড় উন্মুক্ত মঞ্চ। কফিশপ ও খাবারের দোকান তৈরির কাজ তখনো চলছে। বাকি জায়গায় বিভিন্ন ফল ও সবজি চাষ করা হয়েছে। রিসোর্টের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শিগগির রিসোর্টটি বাণিজ্যিকভাবে চালু করার কথা রয়েছে। 

এই রিসোর্টের অদূরেই হচ্ছে পুলিশের এই কর্মকর্তার গ্রামের বাড়ি। এটা করতে গিয়ে খাসজমি দখল করার অভিযোগও রয়েছে। 

 

ভিডিও লিংক: https://www.youtube.com/watch?v=jm6Fes8c_XU

শিহাব

×