ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ৪ মাঘ ১৪৩১

বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভয়ের কারণ নেই

এইচএমপি ভাইরাস নিয়ে বাড়ছে আতঙ্ক

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ২৩:৩৩, ১৭ জানুয়ারি ২০২৫

এইচএমপি ভাইরাস নিয়ে বাড়ছে আতঙ্ক

.

বিশ্বজুড়ে হিউম্যান মেটানিউমো ভাইরাসে (এইচএমপিভি) আক্রান্তের খবরে আবারও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে সাধারণ মানুষের মনে। এই আতঙ্কের মাত্রা বেড়েছে দেশে আক্রান্ত একজনের মৃত্যুর খবরে। আবারও করোনার মতো কোনো ভয়াবহতা ফিরে আসতে চলেছে কি না তা নিয়ে শঙ্কিত তারা। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ সর্দি-কাশিতেও অনেকে এইচএমপিভি পরীক্ষা করাতে চাচ্ছেন। কিন্তু সরকারিভাবে শুধু আইসিডিডিআর’বি এবং আইইডিসিআর ছাড়া আর কোথাও এই পরীক্ষার সুযোগ নেই। এখানে খরচ প্রায় পড়ছে প্রায় ৪ হাজার টাকা। আর বেসরকারি যে কয়টি হাসপাতাল রয়েছে সেগুলোতে এই পরীক্ষা করাতে দিতে হবে ১৫-২০ হাজার টাকা। তাও সীমিত কয়েকটি জায়গায় হচ্ছে এই পরীক্ষা। সরকারের পক্ষ থেকে এটিকে মারাত্মক কোনো প্রাণঘাতী রোগ হিসেবে বিবেচনা করা না হলেও শনাক্ত হওয়া একজনের একজনই মারা যাওয়ায় সাধারণ মানুষ এর পরীক্ষা সহজলভ্য করার আহ্বান জানিয়েছেন। 
চলতি বছর দেশে প্রথম এইচএমপিভিতে শনাক্ত নারী সানজিদা আক্তার গত বুধবার সন্ধ্যায় রাজধানীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। দেশে এইচএমপিভি শনাক্ত হওয়া কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর তথ্য এটিই প্রথম। তবে চিকিৎসকরা দাবি করছেন, তিনি যে এইচএমপি ভাইরাসের জন্যই মারা গেছেন, এমনটি বলা যাবে না। তারা বলছেন, ওই নারীর অন্য আরও শারীরিক জটিলতা ছিল, যার জন্য হঠাৎ করেই শারীরিক অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। ওই হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আরিফুল বাশার জনকণ্ঠকে বলেন, তিনি ক্লেবসিয়েলা নিউমোনিয়াতেও আক্রান্ত ছিলেন। এ ছাড়া তার কিডনি সমস্যা ছিল, সেই সঙ্গে তিনি অনেক মোটা ছিলেন, যে কারণে তাকে ভেন্টিলেটরে উঠানো যাচ্ছিল না। ভাইরাল নিউমোনিয়ার জন্যও সম্ভবত মারা যাননি, অনেকটা সুস্থও হয়ে গেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী জটিলতার জন্য হয়তো সমস্যা হয়েছে। 
এই একজনের মৃত্যুতে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই বলে দাবি করেছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমানও। তিনি বলেন, ওই ভদ্রমহিলা এক মাসের বেশি সময় ধরে অসুস্থ ছিলেন। তিনি বাসার আশপাশেই চিকিৎসা নেন। পরে অবস্থার অবনতি হলে হাসপাতালে ভর্তি হন। তিনি ক্লেবসিয়েলা নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হন এবং তার মাল্টি অর্গান ফেইলিউর হয়। এ ছাড়া তার অবিসিটি থাইরয়েড ডিসফাংশন ছিল। চিকিৎসার এক পর্যায়ে নিউমোনিয়া এবং মাল্টি অর্গান ফেইলার কারণে রোগীর মৃত্যুবরণ হয়। সেই সঙ্গে রোগী দুর্ভাগ্যজনকভাবে এইচএমপি ভাইরাসেও আক্রান্ত ছিলেন। এখন পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক গবেষণা অনুসারে বলা যায় এইচএমপি ভাইরাসের কারণে মৃত্যুর ঘটনা খুবই বিরল। তাই এটি নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি। স্বাস্থ্যবিধি মানারও তাগিদ দেন তিনি।
তবে মন্ত্রণালয় থেকে যতই আতঙ্কিত না হওয়ার কথা বলা হোক ডেঙ্গু-করোনার ভয়াবহতা দেখার পর সাধারণ মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে নানা জল্পনা। করোনার মতোই একই রকম উপসর্গ হওয়ায় এটি নিয়ে তৈরি হয়েছে আরও আতঙ্ক। যেহেতু এখন শীতের মৌসুম। সর্দি-কাশি হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু সর্দি-কাশি হলেই কি এইচএমপিভিতে আক্রান্ত কি না তা বোঝার জন্য পরীক্ষা করাতে চাইছেন অনেকেই। 
রাজধানীর একটি বেসরকারি অফিসের কর্মকর্তা রূপা ইসলাম বলেন, ছোট বাচ্চাটার কয়েকদিন থেকেই জ্বর, সর্দি, কাশি। দুই দিন দেখার পর ডেঙ্গু পরীক্ষা করাই। কিন্তু নেগেটিভ আসে। পরে করোনাও টেস্ট করাই। সেটিও নেগেটিভ আসে। তাও সুস্থ না হওয়ায় ঢাকা মেডিক্যালে গিয়েছিলাম এইচএমপিভি পরীক্ষা করাতে। কিন্তু ওখানে গিয়ে শুনি এই পরীক্ষা শুধু আইসিডিডিআর’বি আর আইইডিসিআরে হয়। সেখানে গিয়ে শুনি একটি পরীক্ষা করাতে খরচ ৪ হাজার টাকা। আমার তো মাথায় হাত। সামান্য একটা ভাইরাসের পরীক্ষা করাতে যদি এত টাকা শুধু সরকারি হাসপাতালেই দিতে হয় তাহলে বেসরকারিতে কি অবস্থা?
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই এইচএমপিভির পরীক্ষা বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতাল, ইউনাইটেড হাসপাতাল, এভারকেয়ার হাসপাতালসহ কয়েকটি বড় হাসপাতালেই হয়। সেখানে একেকটি পরীক্ষার জন্য খরচ হয় ১৫-২০ হাজার টাকা।
ঠিক কি পরীক্ষার মাধ্যমে এই রোগটি শনাক্ত করা হয় যে তার মূল্য এত বেশি দিতে হবে এমন প্রশ্নের উত্তরে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, এইচএমপিভি শনাক্তের জন্য রেসপেরেটরি প্যানেল টেস্ট করতে হয়। যা আরটিপিসিআরের মাধ্যমে করা হয় কিট দিয়ে। যেহেতু আমাদের দেশে করোনা, ডেঙ্গু, হাম, রিও, নিপাহ ভাইরাসের মতো অনেকগুলো ভাইরাসের উপস্থিতি রয়েছে। এবং এইচএমপিভিকে এতটা মরণঘাতী হিসেবে বিবেচনা করা হয় না তাই এটির পরীক্ষা সহজলভ্য করার কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। আসলেই এই রোগটি মারাত্মক কিছু না। আমরা ধরেই নেই আমাদের আশপাশে এই রোগে আক্রান্ত অনেক রোগী রয়েছে। তাহলে একমাত্র শনাক্ত নারীর মৃত্যু হলো কিভাবে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমরা যতটা জানতে পেরেছি ওই নারীর ফুসফুস পুরোটাই অকার্যকর ছিল। এ ছাড়া আরও নানান ধরনের শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি। আমরা এইচএমপিভিকে মারাত্মক কোনো রোগ বলছি না ঠিক আছে কিন্তু যদি কোনো রোগী অন্য নানান শারীরিক জটিলতায় ভোগেন এক্ষেত্রে তার জন্য মারাত্মক হতেও পারে। তাই স্বাস্থ্যবিধি মানার বিকল্প নেই। 
এটি নিয়ে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থারও কোনো সতর্কবার্তা নেই উল্লেখ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর জনকণ্ঠকে বলেন, এই ভাইরাস নিয়ে বিশ্বের কোথাও কোনো রেড এলার্ট জারি করা হয়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এটি নিয়ে কোনো ধরনের নির্দেশনা দেয়নি। এটি সাধারণ সর্দি, কাশি, নাক বন্ধ হয়ে যাওয়ার লক্ষণ সংক্রান্ত একটি রোগ। এটি অন্য জ্বরের মতোই। তবে শিশু, বয়স্ক এবং যেসব ব্যক্তি ক্যান্সার বা দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভুগছেন তাদের ক্ষেত্রে কিছুটা ঝুঁকি আছে। এই ঝুঁকি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার। তবে যেহেতু করোনার সময় আমাদের একটা কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাই অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই। ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধি মানতেই হবে। তিনি বলেন, চীন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গেও আমরা আলাপ করেছি। চীন জানিয়েছে তারা এই রোগের কারণে কোনো জরুরি অবস্থা জারি করেনি। অনেক ভুল তথ্য ছড়াচ্ছে। ডব্লিউএইচও জানিয়েছে এ বিষয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। তবে আমরা এ বিষয়ে আলোচনায় বসেছি। আমরা আবারও এই রোগের প্রতিরোধ ব্যবস্থা বিষয় নিয়ে আলোচনায় বসব। তিনি বলেন, আপনারা জানেন কোনো ভাইরাসের যখন বিস্তার হতে থাকে তখন সেটার প্রতিনিয়ত মিউটেশন বা পরিবর্তন হতে থাকে। কোভিড ভাইরাসও অনেক পুরনো ভাইরাস ছিল। মিউটেশনের কারণে ভাইরাস সময় এটা ক্ষতিকর বা প্রাণঘাতী হয়ে যেতে পারে। আমাদের চেষ্টা করতে হবে যত সম্ভব এটার বিস্তার যাতে রোধ করা যায়। এই ভাইরাসে পাঁচ বছরের নিচে এবং ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে শিশু এবং বয়স্কদের জন্য বা এবং ইমিউনিটি যাদের কম্প্রোমাইজড এবং অন্যান্য রোগ ব্যাধি আছে বিশেষত অ্যাজমা তাদের জন্য বাড়তি ঝুঁকি আছে। যেহেতু এটা একটি রেস্পেটরি ভাইরাস সেহেতু এতে আক্রান্ত হলে অক্সিজেনের দরকার হতে পারে। এবং আমাদের সেই প্রস্তুতি আছে কিন্তু আমরা মনে করি না আমাদের সেগুলো দরকার হবে। যদি দরকার হয় তাহলে আমাদের কোভিডকালীন যে প্রস্তুতি ছিল সেটা আমরা পুনরায় পুনরুজ্জীবিত করব। আমরা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আমরা সবাই কোনো প্রকার সতর্কতা দিচ্ছি না কিন্তু সবাইকে পরামর্শ দিচ্ছি স্বাস্থ্য পরামর্শগুলো মেনে চলেন। হাত ধোয়া, অসুস্থ থাকলে জনসম্মুখে কম আসা এবং ঘরে থাকা। চিকিৎসকরা যখন চিকিৎসা করবেন তখন তারা যেন বিষয়টা মাথায় রাখেন। আবারও বলছি থাকা ভাইরাসের মিউটেশন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে এবং সেজন্য এটার বিস্তার রোধ করা জরুরি। অতএব আমাদের সবার সম্মিলিত চেষ্টা থাকতে হবে এটা যাতে কম ভাইরাসটা কম ছড়ায়। এটা যত কম ছড়াবে ততই এটার বিস্তার রোধ করা আমাদের জন্য সহজ হবে। দূরত্ব বজায় রাখা বিষয়ক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, আমরা এখনো দূরত্ব বা ডিসটেন্স বজায় রাখার কোনো পরামর্শ দিচ্ছি না। তবে কেউ যদি ফ্লুতে আক্রান্ত হন তিনি তিনি যেন সাধারণ মানুষের সংস্পর্শে কম আসেন। অসুস্থ হলে তিনি যেন ঘরে থাকেন। 
সংশ্লিষ্টদের মতে, বর্তমানে এইচএমপিভির চিকিৎসার জন্য কোনো নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল থেরাপি নেই এবং এইচএমপিভি প্রতিরোধ করার জন্য কোনো ভ্যাকসিন নেই। তাই রোগের উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা করা হয়।
এ ভাইরাস নিয়ে ভয়ের কিছু নেই বলা হলেও পার্শ্ববর্তী একাধিক দেশে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ায় এ নিয়ে সতর্কতাও জারি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। 
গত ১২ জানুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার (সিডিসি) একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, চীনসহ উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশে এইচএমপিভি ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব এবং ভাইরাসের তীব্রতা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে ১৪ বছরের কম বয়সী শিশু এবং ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সী ব্যক্তিদের মধ্যে এই রোগের সংক্রমণ বেশি দেখা যায়। সেই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন হাঁপানি বা ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনাবি ডিজিজ, গর্ভবর্তী নারী এবং দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য উচ্চ ঝুঁকি সৃষ্টি হতে পারে। 
পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও এই রোগের সংক্রমণ দেখা যায়। সম্প্রতি চীন ও অন্যান্য দেশে এর প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ায় বাংলাদেশ এর সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখা আবশ্যক। যার জন্য সব স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র এবং পয়েন্টস অব এন্ট্রিগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি জোরদার করা প্রয়োজন। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে এই ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে নি¤েœ বর্ণিত নির্দেশনা অনুসরণ করা এবং জনগণের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য অনুরোধ করা হলো। 
চলতি বছরের জানুয়ারির শুরুতে পূর্ব এশিয়ার দেশ চীনে প্রথম এর সংক্রমণ ধরা পড়ে। এরপর জাপানে ভাইরাসটি শনাক্ত হয়। এখন এইচএমপিভির প্রাদুর্ভাব মালয়েশিয়া ও ভারতেও ছড়িয়ে পড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) বলছে, ২০০১ সালে বিশ্বে প্রথম এই ভাইরাস শনাক্ত হয়। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হয়তো আরও অনেক যুগ আগে থেকেই এই ভাইরাসের অস্তিত্ব ছিল পৃথিবীতে। কেউ কেউ বলছেন, ১৯৫৮ সাল থেকেই রোগটা আছে বলেও যোগসূত্র পাওয়া যায়।
সিডিসি বলছে, এ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে যে কোনো বয়সী মানুষের ব্রংকাইটিস বা নিউমোনিয়ার মতো অসুখ হতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত এটি শিশু, বয়স্ক মানুষ এবং যাদের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল তাদের মধ্যেই বেশি দেখা গেছে।

×