রাজধানীর মতিঝিলে এনসিটিবি ভবনের সামনে অবস্থান নেওয়া পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ‘স্টুডেন্ট ফর সভরেন্টি’ সংগঠনের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ
পাঠ্যবইয়ে আদিবাসী শব্দযুক্ত গ্রাফিতি দেওয়ায় এবং পরবর্তীতে সেটি মুছে ফেলায় পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি পালন করেছে শিক্ষার্থীদের দুটি সংগঠন। কর্মসূচি চলাকালে উভয়পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় ‘সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতা’ সংগঠনের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে। তবে ‘স্টুডেন্ট ফর সভরেন্টি’ নামে যে সংগঠনের বিরুদ্ধে অভিযোগের তীর, তারা বলেছেন, দুই পক্ষের শিক্ষার্থীই আহত হয়েছেন। বুধবার দুপুরে মতিঝিলে এ ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে ‘সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতা ব্যানারের সাত শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। অন্যদিকে স্টুডেন্ট ফর সভরেন্টি ব্যানারের চার শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হয়ে ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এরপর সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলন ডাকে স্টুডেন্ট ফর সভরেন্টি। তবে পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নানা মহলে সমালোচনা হচ্ছে।
‘স্টুডেন্ট ফর সভরেন্টি’ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ইয়াকুব মজুমদার জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের সংগঠনের নেতৃবৃন্দ যখন এনসিটিবি ভবনের ভেতরে ছিল, তখন পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা নানাভাবে উস্কানি দিচ্ছিল। সে সময় তারা বিভিন্ন উদ্দীপক স্লোগান দিতে থাকে। এতে একপর্যায়ে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। তখন দুপক্ষের শিক্ষার্থীই আহত হয়েছেন।
আপনাদের শিক্ষার্থী সংখ্যা বেশি হওয়ায় তারা বেশি আহত হয়েছে কী- এমন প্রশ্নে ইয়াকুব বলেন, এখন তারা আমাদের উগ্রবাদী সংগঠন বলছে। অথচ যেদিন এনসিটিবি এই গ্রাফিতি বাতিল করেছে, সেদিন রাতেই তারা দেওয়ালে ব্যঙ্গচিত্রসহ নানা কর্মসূচি করেছে। হিসেব অনুযায়ী, পরদিনই তাদের এনসিটিবি যাওয়ার কথা, তারা সেটি করেনি। আবার আমাদের যদি মারামারি করার ইচ্ছা থাকত, তবে আমরা রাজু ভাস্কর্যে যেতাম। কিন্তু সেটিও আমরা করিনি।
এ বিষয়ে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (ঢাবি শাখা) সভাপতি অংকন চাকমা জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের ওপর হামলার ঘটনাটি ছিল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কারণ, তারা কেন জাতীয় পতাকা মোটা লাঠির সঙ্গে নিয়ে যাবেন। যা দিয়ে আমাদের রক্তাক্ত করেছে। তারা আওয়ামী আমলের পলিসি নিয়েছে। যে কারণে এভাবে হামলা করেছে। আমরা কর্মসূচি দেওয়ার পরও তারা কেন পাল্টা কর্মসূচি দিল? তাদের মধ্যে ন্যূনতম গণতান্ত্রিক মানসিকতা থাকলে সেটি তারা করত না। অথচ পুলিশের কোলের মধ্যে থেকে আমাদের শিক্ষার্থীদের ওপর ঢিল ছুড়েছে। কারণ তারা চেয়েছে আমরা যেন এনসিটিবি ভবনে যেতে না পারি। কারও সঙ্গে কথা বলতে না পারি। সেই জায়গায় তারা সফল।
পরবর্তী কর্মসূচির বিষয়ে অংকন বলেন, হামলার ঘটনার পরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ করা হয়েছে। সন্ধ্যা সাতটায় মশাল মিছিল করা হবে।
পাঠ্যবইয়ে আদিবাসী শব্দযুক্ত গ্রাফিতি কোন যুক্তিতে পাঠ্যবইয়ে স্থান পেয়েছে! সেটি নিয়ে এক শ্রেণির শিক্ষার্থীর মধ্যে ছিল তীব্র আপত্তি। যে কারণে গেল কয়েকদিন জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ঘেরাও করে একদল শিক্ষার্থী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সব মহলে চলে প্রতিবাদ। আপত্তির মুখে নবম-দশম বাংলা ব্যাকরণ বইয়ের গ্রাফিতি পরিবর্তন করে এনসিটিবি। মুছে দেওয়া হয় আদিবাসী শব্দযুক্তটি। এবার এর প্রতিবাদে সোচ্চার হয় ‘সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতা’ নামের সংগঠন। সবশেষ বুধবার মতিঝিলে পাল্টাপাল্টি অবস্থান সংঘর্ষে রূপ নেয়। এতে পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার গুরুতর অভিযোগও উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এহেন কর্মকান্ডে এনসিটিবি দায় এড়াতে পারে না। তারা কেনই বা যুক্ত করল, কেনই বা মুছে দিল তা নিয়ে তদন্ত হওয়া উচিত।
এনসিটিবি সূত্র বলছে, নবম-দশম শ্রেণির বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও নির্মিতি বইয়ের পেছনের প্রচ্ছদে ‘আদিবাসী’ শব্দ সংবলিত একটি চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছিল। সেখানে একটি গাছের পাঁচটি পাতায় লেখা ছিল মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ও আদিবাসী; পাশে লেখা ছিল ‘পাতা ছেঁড়া নিষেধ’। গত ১২ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী ‘স্টুডেন্ট ফর সভরেন্টি’ ব্যানারে এনসিটিবি ঘেরাও করার পর রাতে ওই বইয়ের অনলাইন সংস্করণ থেকে চিত্রকর্মটি সরিয়ে ফেলা হয়। এর প্রতিবাদে বুধবার বেলা ১১টায় পাঠ্যপুস্তক ভবন ঘেরাওয়ের ঘোষণা দেয় ‘সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতা’ নামে শিক্ষার্থীদের একটি সংগঠন। একই সময়ে ‘স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টি’ও কর্মসূচি ঘোষণা দেয়। একপর্যায়ে দুই পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে এবং এতে অন্তত ২৭ জন আহত হয়েছেন বলে দাবি করা হচ্ছে। তাদের হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। তাৎক্ষণিক তাদের নাম-পরিচয় জানা যায়নি। দুপুর একটার দিকে সেখানে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। একপর্যায়ে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের একজন সামনে এগিয়ে এলে স্টুডেন্ট ফর সভরেন্টির ব্যানারে থাকা আন্দোলনকারীরাও এগিয়ে যান। পরে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে দুপক্ষ। এ সময় সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং পরে তাদের দৈনিক বাংলা মোড়ের দিকে চলে যেতে দেখা যায়। পরে ‘স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টি’র সদস্যদের এনসিটিবি ভবনের সামনে অবস্থান নিতে দেখা যায়। ঘটনার পর স্টুডেন্ট ফর সভরেন্টি দাবি করেছে, তাদের ওপর হামলা হয়েছে। অন্যদিকে সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতা দাবি করেছে, তাদের ওপর হামলা করা হয়েছে পরিকল্পিতভাবে।
সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতার সংগঠক অলিক মৃ বলেন, ‘স্টুডেন্ট ফর সভরেন্টি’র শিক্ষার্থীরা আমাদের ওপর হামলা করেছে। এতে অন্তত ১১ জন আহত হয়েছেন। অন্যদিকে স্টুডেন্ট ফর সভরেন্টির আহ্বায়ক জিয়াউল ইসলাম বলেন, ‘আদিবাসী শিক্ষার্থীদের হামলায় স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টির ১৪ জন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। যার মধ্যে চারজনের চিকিৎসা ঢাকা মেডিক্যালে চলছে। জানতে চাইলে মতিঝিল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাইমেনুল ইসলাম বলেন, শিক্ষার্থীদের ধাওয়া খেয়ে আদিবাসী বিক্ষোভকারীরা চলে যায়। এরপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক।