.
দেশের নৌ-পথে মূর্তিমান আতঙ্কের নাম নৌযান ‘বাল্কহেড’। নৌ-পথের আতঙ্ক দশ সহস্রাধিক অবৈধ বাল্কহেডের অদক্ষ চালক আর ফিটনেসবিহীন জলযানের ধাক্কায় প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। গত দেড় বছরে এমন ২৪৬টি নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ ঝরেছে ৩৭৭ জনের, আর নিখোঁজ হয়েছেন ১০৪ জন। সরকারি হিসাবে ৪ হাজার ৭০০টি নিবন্ধিত বাল্কহেডের কথা বলা হলেও নদীতে চলছে ১১ হাজার বাল্কহেড। গত ১০ জানুয়ারি রাত সাড়ে ৯টার দিকে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ার মেঘনা নদীতে স্পিডবোট ও বাল্কহেডের সংঘর্ষে ৩জন নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন আরও কয়েকজন। অভিযোগ আছে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে রাতের বেলায় চলাচলের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে অধৈভাবে বাল্কহেড চলছে নৌ-পথে। নদীপথে বাল্কহেডের ধাক্কায় মানুষজনের মৃত্যু হলে সাধারণত অপমৃত্যু মামলা হয় এবং এই ধরনের মামলায় আইনের ফাঁক ফোকর গলে ঘাতকরা পার পেয়ে যায়। বিচারের কাঠ গড়ায় দৃষ্টান্তমূলক সাজা হয়েছে এমন নজির নেই। এমনকি হতাহতরা ক্ষতিপূরণ পর্যন্ত পাচ্ছেন না। বড় ধরনের হতাহতের ঘটনা ঘটলেই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আর আলোর মুখ দেখে না। নৌ পুলিশ সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
সারাদেশের ৫ হাজার ২২১ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীপথে মূর্তিমান আতঙ্ক বালুবাহী নৌযান-বাল্কহেড এখন মারাত্মক বেপরোয়া।
বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, মেঘনা, শীতলক্ষ্যাসহ দেশের বিভিন্ন নদীতে বেপরোয়া গতিতে চলা বাল্কহেডের ধাক্কায় প্রতিনিয়ত ডুবছে যাত্রীবাহী নৌযান, প্রাণ হারাচ্ছে অসংখ্য মানুষ। আর এসব অবৈধ বাল্কহেড চলছে দক্ষ মাস্টারের পরিবর্তে অদক্ষ সুকানি দিয়ে। নেই ফিটনেসের বালাই। এমনকি চালকরাও প্রশিক্ষণ না থাকার কথা স্বীকার করেন।
গত ১০ জানুয়ারি রাত সাড়ে ৯টার দিকে উপজেলার মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ার কালিপুরা ঘাটের অদূরে মেঘনা নদীতে স্পিডবোট ও বাল্কহেডের সংঘর্ষে দুইজন নিহত হয়েছেন। এতে আহত হয়েছেন আরও কয়েকজন। নৌপুলিশ ও স্থানীয়রা জানায়, গতকাল শুক্রবার রাত আনুমানিক ৯টার দিকে একটি বিকট শব্দ হয়। পরে তারা জানতে পারেন নোঙ্গর করে রাখা বাল্কহেডের সঙ্গে স্পিডবোটের সংঘর্ষ হয়েছে। পরে এই ঘটনায় দুই ততধিক হতাহতকে বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
গজারিয়ার নৌপুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক (এসআই) নাঈম হোসেন বলেছেন, নদীতে নোঙর করে রাখা বাল্কহেডের সঙ্গে রাতের অন্ধকারে দ্রুতগতির স্পিডবোটের সংঘর্ষ হয়। এতে শুক্রবার রাতেই দুজন মারা যান। শনিবার সকালে ঘটনাস্থলে থেকে আরও একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এখনো অনেকে নিখোঁজ রয়েছেন। উদ্ধার কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
গজারিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনোয়ার আলম আজাদ দুর্ঘটনার কথা নিশ্চিত করে বলেছেন, দুর্ঘটনায় আরও লোক নিখোঁজ বা মারা গেছেন বলে শোনা গেলেও এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তিনি আরও বলেন, শোনা যাচ্ছে, হতাহতদের মধ্যে মেঘনায় অবৈধ বালু উত্তোলন এবং নৌপথে দস্যুতার সঙ্গে জড়িতরাও রয়েছে। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা পালিয়ে গেছে।
সম্প্রতি মুন্সীগঞ্জে পদ্মার শাখা নদীতে বালুবাহী বাল্কহেডের ধাক্কায় অন্তত ৪০ যাত্রী নিয়ে একটি ট্রলার ডুবে যায়। এতে বেশ কয়েজনের প্রাণহানি ঘটে। এর আগে কিশোরগঞ্জ ফেরিঘাটের অদূরে মেঘনা নদীতে বাল্কহেডের ধাক্কায় একটি পর্যটকবাহী ট্রলার ডুবে যায়। এতেও ঝরে কয়েকজনের প্রাণ। শুধু এ দুটি ঘটনায় নয় সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির দাবি অনুযায়ী, গত দেড় বছরে এমন ২৪৬টি নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেছে। এ সব দুর্ঘটনায় প্রাণ ঝরেছে ৩৭৭ জনের, আর নিখোঁজ হয়েছেন ১০৪ জন।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বরাত দিয়ে জাতীয় কমিটি বলছে, নিবন্ধিত নৌযানের সংখ্যা ১৫ হাজার হলেও সারাদেশে বিভিন্ন ধরনের অন্তত ৮৫ হাজার নৌযান রয়েছে। অর্থাৎ প্রায় ৭০ হাজার নৌযানই নিবন্ধনহীন। অবৈধ এসব নৌযানের মধ্যে অন্তত ছয় হাজার রয়েছে বাল্কহেড। অন্যদিকে নিবন্ধিত ১৫ হাজার নৌযানের মধ্যে নিয়মিত বার্ষিক সার্ভে (ফিটনেস পরীক্ষা) করা হয় মাত্র আট হাজারের। নিয়ন্ত্রক সংস্থা নৌপরিবহন অধিদপ্তর ও বিআইডব্ল্উিটিএর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জ্ঞাতসারে অবশিষ্ট সাত হাজার ত্রুটিপূর্ণ নৌযান অবাধে চলাচল করছে। কর্তৃপক্ষ সেগুলোর বিরুদ্ধে অদৃশ্য কারণে ব্যবস্থা না নেওয়ায় অহরহ দুর্ঘটনা ঘটছে।
অবৈধ ও আইন অমান্যকারী নৌযান চলাচলের সুযোগ দেওয়ায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও নৌযান মালিককে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার দাবি জানিয়ে জাতীয় কমিটি বলছে, এসব নৌযান চলছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), নৌ-পরিবহন অধিদপ্তর, নৌ-পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করে। এসব সংস্থার প্রভাবশালীদের নিয়ে ঘটিত হয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। বিপজ্জনক এসব বাল্কহেডকে নিয়ন্ত্রণে নানান মহল থেকে চাপ এলে রাতে বাল্কহেড না চালানোর নির্দেশ দেয় সংশ্লিষ্ট বিভাগ। এতেও বন্ধ নেই দুর্ঘটনা। নৌ পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতারা বাল্কহেডের বেপরোয়া গতিসহ অদক্ষ চালক দিয়ে বাল্কহেড পরিচালনার নানান অভিযোগ করলেও বিআইডব্লিউটিএর সংশ্লিষ্ট বিভাগ বিষয়টি একেবারেই আমলে নিচ্ছে না বলে অভিযোগ তাদের। তাদের ভাষ্য, এসব দুর্ঘটনার দুয়েকটি তদন্ত কমিটি হলেও অধিকাংশের যথাযথ বিচার হয়নি।
লঞ্চ মালিক-শ্রমিকদের অভিযোগ, নদীপথে চলাচল করা অবৈধ নৌযানগুলো দুর্ঘটনায় পড়লে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দায় এড়াতে একটি সাধারণ আখ্যা দিয়ে। আর সেটি হচ্ছে, যান চলাচলে অনুমোদন ছিল না ।
নৌপরিবহন দপ্তরের একটি সূত্র জানিয়েছে, বালুবাহী নৌযানের পর্যাপ্ত নিরাপত্তাবাতি থাকে না। বালু পরিপূর্ণ অবস্থায় এসব নৌযানের শুধু সামনের কিছু অংশ ও পেছনের অংশ পানির ওপরে থাকে। তাই বাল্কহেডের সঙ্গে যাত্রীবাহী নৌযানের ধাক্কা লাগার ঘটনা ঘটে প্রায়ই।
লঞ্চমালিক সমিতির মহাসচিব সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারী বলেছেন, সর্ষের মধ্যেই ভূত আছে। বাল্কহেড চলাচল মনিটর করার দায়িত্ব যাদের, তাদের ম্যানেজ করেই রাতে অবৈধভাবে চলছে বাল্কহেড। রাতে যাত্রীবাহী নৌযান আমরা খুব কষ্টে চালাই। কারণ নদীতে বাল্কহেড এক ভয়ঙ্কর যানের নাম। তিনি অভিযোগ করে বলেন, যাত্রীবাহী নৌযানে দুর্ঘটনা ঘটেছে শুধু বাল্কহেডের কারণে। তিনি বলেন, এই বিপুলসংখ্যক অবৈধ নৌযান বন্ধ করার জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম এবং নৌপুলিশ ও কোস্টগার্ডের টহল জোরদার করা দরকার।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ বিআইডব্লিউটিএর সাবেক চেয়ারম্যান কমোডর আরিফ আহমেদ মোস্তফা জানিয়েছেন, রাতে বালুবাহী নৌযান চলাচল না করার নির্দেশনা আছে। নৌপথে নিরাপত্তার জন্য নৌ-পুলিশ এবং কোস্টগার্ড কাজ করে, কিন্তু আমাদের নিজস্ব জনবল নেই। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে পদক্ষেপ নিতে হবে ।
নৌ-পরিবহন অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ২০২২ সালে ৩৬টি নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে আছে যাত্রীবাহী নৌযান ১০টি, মালবাহী নৌযান ১৭টি এবং অন্যান্য নৌযান ছিল ৯টি। তবে দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, ২০২২ সালে সারাদেশে ছোট-বড় নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৯৭টি। এতে নিহত হয়েছেন ৩১৯ জন, আহত হয়েছেন ৭৩ জন এবং নিখোঁজ রয়েছেন ৯২ জন। এ ছাড়া ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ১৬ জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪৯টি। এতে নিহত হয়েছেন ৫৮ জন, আহত হয়েছেন ৭ জন এবং এখনো নিখোঁজ আছেন ১২ জন। সে হিসাবে বিগত দেড় বছরে ২৪৬টি নৌ-দুর্ঘটনায় ৩৭৭ জন নিহত হয়েছেন। এতে ৮০ জন আহত এবং ১০৪ জন নিখোঁজ রয়েছেন। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বলছে, বিআইডব্লিউটিএ, নৌ-পরিবহন অধিদপ্তর, নৌ-পুলিশ এবং নৌযান মালিকদের অবহেলার কারণে নৌপথ নিরাপদ হয়নি। এর জন্য সংশ্লিষ্ট সবাই দায়ী।
বিআইডব্লিউটিএ সূত্র বলছেন, অবৈধ বালু ব্যবসায়ীদের কারণেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না অনুমোদনহীন এসব বাল্কহেড। এ ছাড়া সংস্থার কেউ অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে অনুমোদনহীন বাল্কহেড চালাতে সহায়তা করলে প্রমাণসাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন কর্তৃপক্ষ।
অবৈধভাবে বালু ব্যবসায়ীরা নদীর যেখান থেকে বালু উত্তোলন করছেন, বালু উত্তোলন ব্যবস্থাপনা জেলা প্রশাসকরা দিয়ে থাকেন, সেখানে স্থানীয় পর্যায়ে নজরদারিরও প্রয়োজন আছে। বিআইডব্লিউটিএ কর্মচারী হোক আর পুলিশের কর্মচারী হোক তাদের বিরুদ্ধে হোক কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষের দাবি।
নৌপরিবহন অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, বাল্কহেডের ফিটনেস ও চালকদের লাইসেন্স প্রদানকারী একমাত্র সংস্থা নৌপরিবহন অধিদপ্তর। কৌশলগত ও কারিগরিসহ সংশ্নিষ্ট সবার মধ্যে সমস্যা রয়েছে। এর মধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছে। সেখানে শতাধিক মামলা করা হয়েছে। রাতের আঁধারে নদীতে বালুবাহী বাল্কহেড চলাচল নিষিদ্ধ করে বিজ্ঞপ্তি জারি হলেও মানা হচ্ছে না বেশির ভাগ নদীতে।