জ্বালানি তেল সরবরাহকারীদের সঙ্গে নতুন করে দর কষাকষি
জ্বালানি তেল সরবরাহকারীদের সঙ্গে নতুন করে দর কষাকষির কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রিমিয়াম কমানো সম্ভব হয়েছে। এতে জ্বালানি তেল আমদানিতে আগামী ছয় মাসে সরকারের ব্যয় সাশ্রয় হবে প্রায় আটশ কোটি টাকা।
জানা গেছে, দেশে বছরে প্রায় ৭০ লাখ টনের মতো পেট্রোলিয়াম জ্বালানির চাহিদা রয়েছে। দেশের চাহিদা পূরণের জন্য পরিশোধিত ও অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে বিপিসি। এর মধ্যে ১৫ লাখ টন ক্রুড (অপরিশোধিত) অয়েল আমদানির পর ইস্টার্ন রিফাইনারির মাধ্যমে পরিশোধন করে বাজারে সরবরাহ করে।
অন্যদিকে জ্বালানি উৎপাদন ও সরবরাহকারী বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান থেকে জিটুজি এবং আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে পরিশোধিত জ্বালানি আমদানি করে বিপিসি।
বিপিসির তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিপিসি ৫০ লাখ ৬৩ হাজার ৯০৫ মেট্রিক টন পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম জ্বালানি পণ্য আমদানি করে। এর মধ্যে ৩৫ লাখ ৩৫ হাজার ৩০৭ মেট্রিক টন ডিজেল, দুই লাখ ৫৯ হাজার ৭৯০ টন অকটেন, পাঁচ লাখ ৯২ হাজার ৯৬৫ টন জেট এ-১, ছয় লাখ ৬০ হাজার ৮৫৭ টন ফার্নেস অয়েল এবং ১৪ হাজার ৯৮৬ টন মেরিন ফুয়েল। পাশাপাশি একই অর্থবছরে ১৩ লাখ সাত হাজার ৬৬৮ টন ক্রুড অয়েল আমদানি করে বিপিসি।
জানা যায়, জিটুজির ভিত্তিতে পরিশোধিত জ্বালানি আমদানির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নির্ধারিত দরের পাঁচদিনের গড় হিসাবে মূল্য নির্ধারণ করা হয়। সেক্ষেত্রে আমদানি করা জ্বালানি সরবরাহকারীর পয়েন্ট থেকে লোড হওয়ার সময়ের দুইদিন আগে এবং দুইদিন পরের দিন হিসাব করা হয়। আবার এসব জ্বালানি সরবরাহ করে তেলের দামের সঙ্গে ব্যারেলপ্রতি নির্ধারিত প্রিমিয়াম পান সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান।
২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পরিশোধিত ডিজেলের ক্ষেত্রে ব্যারেলপ্রতি আট ডলার ৭৫ সেন্ট প্রিমিয়াম নির্ধারণ করা ছিল। তবে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসের (’২৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন) জন্য পরিশোধিত ডিজেলের ক্ষেত্রে প্রিমিয়াম নির্ধারণ করা হয়েছে পাঁচ ডলার ১১ সেন্ট।
পাশাপাশি উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে নির্ধারিত সরবরাহকারীদের কাছ থেকেও আগের চেয়ে কম দামে পেট্রোলিয়াম জ্বালানি সংগ্রহ করতে যাচ্ছে বিপিসি। এতে শুধু প্রিমিয়াম খাতে নতুন বছরের প্রথম ছয় মাসে ৭৯৯ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে বলে জানিয়েছেন বিপিসির কর্মকর্তারা।
বিপিসির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতি ছয় মাস পর পর দ্বিপক্ষীয় দরকষাকষির মাধ্যমে এ প্রিমিয়াম নির্ধারিত হয়। এসব দরকষাকষি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় সিঙ্গাপুরে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শেষবার ওই প্রিমিয়াম নির্ধারিত হয়েছিল। ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসের জন্য পরিশোধিত জ্বালানি সরবরাহের প্রিমিয়াম নির্ধারণে সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত দরকষাকষির বৈঠকে অংশ নিতে গত ৪ থেকে ৯ ডিসেম্বর সিঙ্গাপুর সফর করে জ্বালানি ও খনিজ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে চার সদস্যের প্রতিনিধিদল। ওই দলে ছিলেন বিপিসি চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসান, বিপিসির মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন অ্যান্ড কমার্শিয়াল) মনি লাল দাশ এবং উপব্যবস্থাপক শ্যামল পাল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিপিসির এক কর্মকর্তা বলেন, জিটুজি কিংবা আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে জ্বালানি সংগ্রহ করা হলেও বিগত সরকারের সময়ে সরকারি উচ্চমহলের, বিশেষ করে জ্বালানিমন্ত্রীর প্রভাব থাকত। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সেই প্রভাব কেটে গেছে।
বৈঠকে অংশ নেওয়া কর্মকর্তারা সরবরাহকারীদের সঙ্গে আলোচনা করেন। এক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছিল না। যে কারণে এবারের দরদাম ঠিক করার বৈঠক ফলপ্রসূ হয়েছে। আগে মন্ত্রীর ইশারায় দরদাম ঠিক হতো। কর্মকর্তারা মন্ত্রীর ইশারা বাস্তবায়ন করতেন।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার দেশগুলোতে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবমূর্তি বেড়েছে। এর ইতিবাচক প্রভাবও পড়েছে প্রিমিয়াম নির্ধারণের বৈঠকে। ফলে আগের চেয়ে অনেক কমেছে ‘প্রিমিয়াম রেট’। এতে সরাসরি লাভবান হয়েছে সরকার। তা ছাড়া জ্বালানির মূল্য ও প্রিমিয়াম ডলারে পরিশোধ করতে হয়। প্রিমিয়াম রেট কমার কারণে আমাদের ডলারের সাশ্রয়ও হয়েছে।
এমিরেটস ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি (ইএনওসি) ‘এমভি এঞ্জেল স্টার’ নামের জাহাজে গত ৬ ডিসেম্বর এক পার্সেলে দুই লাখ ৪৯ হাজার ৬৩৩ ব্যারেল ডিজেল সরবরাহ করে। ওই পার্সেলে (চালান) ডিজেলের গড় দাম নির্ধারিত হয় ব্যারেলপ্রতি ৮৪ ডলার ৫৯ সেন্ট। ওই চালানে ডিজেলের পরিশোধযোগ্য প্রিমিয়াম নির্ধারিত আছে ব্যারেলপ্রতি আট ডলার ৭৫ সেন্ট। এতে ওই চালানে প্রিমিয়াম আসে ২১ লাখ ৮৪ হাজার ২৮৮ ডলার ৭৫ সেন্ট।
অন্যদিকে, নতুন বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন একই পরিমাণ একটি পার্সেলে প্রিমিয়াম আসবে ১২ লাখ ৭৫ হাজার ৬২৪ ডলার ৬ সেন্ট। এতে একই পরিমাণ ডিজেল আমদানিতে বিপিসির সাশ্রয় হবে ৯ লাখ আট হাজার ৬৬৪ ডলার ১২ সেন্ট, যা বাংলাদেশী টাকায় ১০ কোটি ৯০ লাখ ৩৯ হাজার ৬৯৪ টাকা (ডলার ১২০ টাকা হিসাবে)। নতুন বছরের ছয় মাসে প্রায় সাত লাখ টন ক্রুড অয়েল এবং প্রায় ২৬ লাখ টন পরিশোধিত জ্বালানি আমদানি করা হবে বলে জানিয়েছে বিপিসি।
এ প্রসঙ্গে বিপিসির চেয়ারম্যান আমিন উল আহসান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সিঙ্গাপুরে আমাদের নেগোশিয়েট মিটিং অনুষ্ঠিত হয়েছে। এবার ২০২৫ সালের ছয় মাসের জন্য রিফাইন্ড ডিজেল আমদানিতে প্রিমিয়াম নির্ধারিত হয়েছে পাঁচ ডলার ১১ সেন্ট হিসেবে। প্রত্যেক আইটেমেই প্রিমিয়াম কমেছে। প্রিমিয়াম কমার কারণে পরবর্তী ছয় মাসে জিটুজি পর্যায়ের আমদানিতেই ৪২৯ কোটি টাকা, পাশাপাশি টেন্ডার অংশেও ৩৭০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।’