ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১২ জানুয়ারি ২০২৫, ২৮ পৌষ ১৪৩১

৪ বছরে দুর্ঘটনায় মারা গেছে এক হাজার, আহত ও পঙ্গু দেড় হাজার

অরক্ষিত রেলক্রসিং ॥ মৃত্যুফাঁদ

শংকর কুমার দে

প্রকাশিত: ২৩:০২, ১১ জানুয়ারি ২০২৫

অরক্ষিত রেলক্রসিং ॥ মৃত্যুফাঁদ

সারাদেশে লেভেল ক্রসিংয়ে অনেক সিগন্যালবার, লাইট এবং বেল অকার্যকর, অনেক জায়গায় নেই লেভেল ক্রসিং।

সারাদেশে রেলের অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং যেন মৃত্যুফাঁদ। এর মধ্যে বিরাট সংখ্যক রেলক্রসিং অনুমোদিত। এসব রেলক্রসিংয়ের কোথাও গেট নেই। আবার নেই কোথাও গেটম্যান। রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার
বাড়ছে উদ্বেগজনকভাবে। প্রতিবছর সারাদেশের রেলক্রসিংয়ে দুই শতাধিক দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব
দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা ততধিক সংখ্যক। এর মধ্যে ৮৯ শতাংশ দুর্ঘটনার উৎস লেভেল ক্রসিং। গত প্রায় চার বছরে সারাদেশে রেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ১ হাজার মানুষ। আহত ও পঙ্গু হয়েছেন দেড় হাজারের বেশি মানুষ। গত ১৬ বছরে রেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন সহ¯্রাধিক। এর মধ্যে শুধু লেভেল ক্রসিংয়েই মৃত্যু হয়েছে ৬৫০ জনের। রেল দুর্ঘটনায় যত প্রাণহানি হয়, তার ৮৯ শতাংশই অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ের কারণে ঘটে।

রেলওয়ের লেভেল ক্রসিংগুলোর (বৈধ-অবৈধ) প্রায় ৮৪ শতাংশই অরক্ষিত। আর এসব ক্রসিংয়ে প্রায়ই ঝরছে সাধারণ মানুষের প্রাণ। অথচ এসব ক্রসিং নিরাপদ করার বিষয়টি কর্তৃপক্ষের অগ্রাধিকারে নেই। মানুষের মৃত্যুরোধের মতো বিষয়টিতে যে অগ্রাধিকার দেওয়া  দরকার, মনে হয় তা রেলের নীতিনির্ধারকদের মাথায় নেই। কর্তব্যে গাফিলতি, চূড়ান্ত বিচারে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে লেভেল ক্রসিংয়ের মৃত্যুগুলো সেই বিবেচনায় হত্যাকাণ্ড।

অথচ অবৈধ রেলক্রসিংয়ের কথা বাদই দিলাম, বৈধ লেভেল ক্রসিংয়ে মৃত্যুর দায় এ পর্যন্ত রেল নিয়েছে বা ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার পেয়েছে তার কোনো উদাহরণ নেই। রেল দুর্ঘটনায় কোনো মৃত্যুর দায় নেয় না রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। রেলওয়ে সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
রেলওয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারাদেশে রেলপথে মোট ক্রসিং আছে ২ হাজার ৮৫৬টি। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৬১টিরই অনুমোদন নেই। আবার ১ হাজার ৪৯৫টি বৈধ ক্রসিংয়ের মধ্যে ৬৩২টি ক্রসিংয়েই গেটম্যান নেই। এর মধ্যে মাত্র ২৪২টিতে রেলের স্থায়ী রক্ষী রয়েছে। আর ৮২০টিতে রয়েছে চুক্তিভিত্তিক রেলরক্ষী, যা মাত্র ৩১ শতাংশ।

রক্ষীবিহীন ক্রসিং আছে ১ হাজার ৭৯৪টি অর্থাৎ ৬৯ শতাংশ ক্রসিংয়ে রক্ষী নেই আর অনুমোদনহীন ক্রসিং ৬২ শতাংশ। সারাদেশে রেলপথ রয়েছে ২ হাজার ৮৭৭ কিলোমিটার। এতে রেলক্রসিং আছে ২ হাজার ৫৪১টি। এর মধ্যে ২ হাজার ১৭০টিতে কোনো গেটই নেই। হিসাব অনুযায়ী গেট নেই ৮৫ শতাংশ। প্রায়শ রেলওয়ে লেভেল ক্রসিংয়ে মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় হতাহত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। কোনো কোনো দুর্ঘটনা খুবই হৃদয়বিদারক। 
সারাদেশে রেলপথগুলো কতটা অরক্ষিত ও নিরাপত্তাহীন তার এক হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনার দৃষ্টান্ত হলো গত ৭ জানুয়ারি বেলা ১২টার দিকে ফরিদপুরে রেলক্রসিংয়ে একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। ফরিদপুরের গেরদা ইউনিয়নের কাফুরা নামক স্থানে রেলক্রসিংয়ে ঢাকাগামী ট্রেনের ধাক্কায় একটি মাইক্রোবাস দুমড়ে-মুচড়ে খাদে পড়ে গেলে একই পরিবারের ৫ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। এ ছাড়া হতাহত হয়েছেন আরও ৪ জন।

মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনায় নিহতরা হলেন নারায়ণগঞ্জ শহরের ভুঁইয়াপাড়া এলাকার মরহুম হাজী কালু ভুঁইয়ার নাতিন সাজিয়া আফরিন সাজু, উম্মে মাহমুদা রিংকু, ফাহমিদা শারমীন মুন, মুনের স্বামী মামুন চৌধুরী লিটন ও নাত বৌ আতিফা রহমান ভুঁইয়া। নিহত মুন ও লিটনের শিশুকন্যা তাজরী এবং মাইক্রোবাসের চালক জিন্নাহ এ দুর্ঘটনায় আহত হন। 
ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) কামরুল হাসান মোল্যা বলেছেন, ঘটনাস্থলে ৪ জন এবং হাসপাতালে একজনের মৃত্যু হয়েছে। আমরা রেল মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলব যাতে তারা পরবর্তীতে সতর্ক হয়। আহতদের খোঁজ-খবর নেওয়া হবে।
স্থানীয়রা ও ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন, গেরদা রেলক্রসিং অরক্ষিত থাকার কারণেই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং রেলক্রসিংটি সুরক্ষিত করার দাবি জানান তারা। 
সারাদেশে রেলপথগুলোর অরক্ষিত ও নিরাপত্তাহীন আরেক হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনার দৃষ্টান্ত হলো গাজীপুরের শ্রীপুরে রেলক্রসিংয়ে যাত্রীবাহী বাসে ট্রেনের ধাক্কায় চারজন নিহত এবং কমপক্ষে বিশজন আহত হওয়ার মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি। শ্রীপুর উপজেলার মাইজপাড়া কমলাদীঘি এলাকায় সম্প্রতি এই ভয়াবহ দুর্ঘটনার সময়ে রেলক্রসিংয়ের কোনো গেটকিপার ছিল না, জ্বলেনি ট্রেন আসার কোনো বাতিও।

ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা নেত্রকোনাগামী বলাকা কমিউটার এক্সপ্রেস ট্রেনটি যাত্রীবাহী বাসকে ধাক্কা দিলে দুর্ঘটনায় মর্মান্তিক হতাহতের ঘটনাটি ঘটে। শুধু গাজীপুরের শ্রীপুরেই নয়, সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব ভয়াবহ ও মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেছে তা রেলওয়ের তদন্তেই প্রকাশ পেয়েছে রেলপথ কতটা অরক্ষিত, নিরাপত্তাহীন, ঠুনকো তার প্রমাণ। তারপর নিয়তির কাছে আমাদের হার মানতে হচ্ছে। অরক্ষিত ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটে চলেছে। অথচ এগুলো সুরক্ষিত করার যেন কোনো দৃশ্যমান তাগিদ নেই। 
রেলওয়ের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রেলওয়ের প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকার প্রকল্পে মাত্র একশ’ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয় লেভেল ক্রসিং খাতে। অবৈধ লেভেল ক্রসিং যেহেতু রেলওয়ে করেনি, তাই সেখানে কোনো দুর্ঘটনায় কারও প্রাণ গেলে তার দায় রেল কেন নেবে? অবশ্য বৈধ লেভেল ক্রসিংয়ে মৃত্যুর দায় এ পর্যন্ত রেল নিয়েছে বলে এমন উদাহরণ নেই। রেল কখনো মামলা করে বটে, কিন্তু সরকারি সংস্থা বলে বেশি দূর যেতে পারেন না।

কম বাজেটে বেআইনি লেভেল ক্রসিং চলমান রাখাটাই যে একটা ভয়ংকর ফৌজদারি অপরাধ, সে বিষয়টি জেনেও রেল নিশ্চুপ থাকছে যা ওপেন সিক্রেট। বিশেষ করে রেলপথ ব্যবস্থাপনায় সরকারি বিভাগ ও সংস্থাগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। রেলপথে নিরাপত্তা একেবারে নামমাত্র যা উল্লেখ করার মতো নয়। রেলওয়ের তথ্যমতে, সারাদেশের ৩ হাজার ২০০ লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে প্রায় ২ হাজার লেভেল ক্রসিং অবৈধ। অবৈধ ও প্রহরীবিহীন প্রতিটি লেভেল ক্রসিং বাংলাদেশের যোগাযোগ নেটওয়ার্ক এবং সংশ্লিষ্ট জনপদগুলোর জন্য মৃত্যুফাঁদের মতো।

ট্রেন বা বাসের যাত্রী না হয়েও শুধু লেভেল ক্রসিংয়ের কাছাকাছি বসবাস বা চলাচলের জন্য যে কোনো মানুষের জীবনে যে কোনো সময়ে নেমে আসতে পারে বিভীষিকা। রেল কর্তৃপক্ষের তৈরি করা একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদন। যাতে বলা হয়েছে, ১ হাজার ৪৪২টি অনুমোদিত লেভেল ক্রসিংয়ে মাত্র ৪৬৬টির গেটে গেটম্যান রয়েছে। তাহলে বাকিগুলো কারা কীভাবে চালাচ্ছে কিংবা আদৌ সেখানে কোনো ব্যবস্থাপনা আছে কি না তা খোঁজ রাখার দায়িত্ব দেখা যায় না।

যদি লোকবল না দিতে পারার কারণ অর্থসংকট বলা হয়, তাহলে সেটা হবে মেগা উন্নয়ন প্রকল্পের দাবিদার সরকারের জন্য অগৌরবের। রেলের ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এই চরম বিশৃঙ্খলার জন্য এর সঙ্গে যুক্তদের জবাবদিহিতে বাধ্য করা দরকার। 
রেলওয়ে সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশের মৃত্যুফাঁদ অভিহিত রেলওয়ের অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংগুলোর দুর্ঘটনা রোধকল্পে কার্যকর পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। এ কারণে প্রতি বছর গড়ে ট্রেনে কাটা পড়ে ও দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে প্রায় আড়াই হাজার মানুষ। এর মধ্যে ৮৯ শতাংশই মারা যান অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ের কারণে। সম্প্রতি খোদ রাজধানীর জনাকীর্ণ এলাকা মগবাজার রেলগেট এলাকায় লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় একটি প্রাইভেটকার দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

এর আগে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার বাকশিমূল ইউনিয়নের কালিকাপুর অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সায় থাকা সাতজন নিহত হওয়ার মতো মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেছে।
রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিগত এক যুগে রেলওয়েতে ১ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। অথচ রেলওয়ের লেভেল ক্রসিংয়ের দুর্ঘটনা রোধকল্পে তেমন কোনো বড় অঙ্কের অর্থের প্রকল্প বাস্তবায়ন দেখা যায় না। রেলে এ পর্যন্ত যে বিপুল বিনিয়োগ হয়েছে এবং চলমান যে বরাদ্দ আছে এর ১ শতাংশের কম বিনিয়োগ করলেও রেলপথ নিরাপদ হয়ে যায়।

কিন্তু রেলের কর্মকর্তাদের এসব প্রকল্পের দিকে মনোযোগ নেই। যে কারণে একটি দুর্ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই আরও একটি দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে ছোট একটি সতর্কীকরণ নোটিস টাঙিয়ে কর্তৃপক্ষ দায় সারে। কিন্তু একবারও ভাবে না এটি ক্রসিং নামের মৃত্যুফাঁদ। যখনই দুর্ঘটনা ঘটে তখন দায়ী ব্যক্তিকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ঢাকঢোল পিটিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু তদন্ত কমিটির রিপোর্টের সুপারিশ অনুযায়ী কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। 
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে রেলপথ আছে ২ হাজার ৯৫৫ কিলোমিটার। রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগের হিসাবে, পূর্ব ও পশ্চিম রেলের দুই অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি অবৈধ লেভেল ক্রসিং সৃষ্টি করেছে এলজিইডি। এলজিইডির কারণে সৃষ্ট অবৈধ ক্রসিংয়ের সংখ্যা ৪৪২টি। ইউনিয়ন পরিষদ নির্মাণ করেছে ৩৬৩টি, পৌরসভা ৭৯টি, সিটি করপোরেশন ৩৪টি, জেলা পরিষদ ১৩টি ও সওজ ১১টি। ৩৩টি লেভেল ক্রসিং নির্মাণ করা হয়েছে স্থানীয় পর্যায়ে। এ ছাড়া রেললাইনে বাজারও বসছে।

ট্রেন চলাচলের সংখ্যা হিসাবে লেভেল ক্রসিংয়ে এক থেকে চারজন গেটকিপার থাকেন। আট ঘণ্টার শিফট হিসাবে ক্রসিংয়ের ৩ থেকে ১২ জন গেটকিপার প্রয়োজন। ঢাকা শহরে কিংবা জনবহুল এলাকায় থাকার কথা ১২ জন, আছেন ছয়জন করে। রেলের পূর্বাঞ্চলের ৩৪৩টি বৈধ ক্রসিংয়ের ১৮৯টিতে একজন গেটকিপারও নেই। পশ্চিমাঞ্চলের ৯৭৮টির মধ্যে ৭৫৭টিতে গেটকিপার নেই।

রেল কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, নতুন রেললাইন তৈরি করে প্রথম ট্রেন চালানোর ১০ বছরের মধ্যে এর ওপর দিয়ে কোনো সড়ক গেলে তা সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব রেলের। এরপর কোনো সড়ক নির্মাণ হলে তা আগে রেল কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। সড়কের কারণে তৈরি রেলক্রসিংয়ে পথরোধক ও পাহারাদার দিয়ে তা সুরক্ষণ করার দায়িত্ব সড়ক নির্মাণকারী সংস্থার। রেলের স্থায়ী ক্রসিংয়ের সবই পর্যায়ক্রমে সুরক্ষিত করা হলেও অন্যান্য সংস্থার কারণে সৃষ্ট ক্রসিংয়ে উড়াল সড়ক কিংবা পাহারাদার বসানোর অনুরোধ জানিয়ে বহুবার চিঠি দিয়েও আশানুরূপ সাড়া মেলেনি।

এই রেলপথের ওপর দিয়ে কোথাও কোথাও সড়ক চলে গেছে। রেল আর সড়কের এই সংযোগস্থলকেই লেভেল ক্রসিং বলা হয়। এগুলোকে বৈধ-অবৈধ, পাহারাদার আছে (ম্যানড), পাহারাদার নেই (আনম্যানড)-এভাবে শ্রেণিবিন্যাস করে রেল কর্তৃপক্ষ। যেসব ক্রসিংয়ে পাহারাদার আছেন, সেগুলোতে লোহার প্রতিবন্ধক থাকে। পাহারাদার ট্রেন আসার সংকেত পেয়ে প্রতিবন্ধক নামিয়ে অন্য যানবাহনের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করেন।

ফলে পাহারাদার ভুল না করলে যানবাহনের সঙ্গে ট্রেনের সংঘর্ষ হওয়ার সুযোগ নেই। পাহারাদার ও প্রতিবন্ধক থাকা রেলক্রসিংয়ে তাই দুর্ঘটনাও খুব কম। পাহারাদার নেই এমন ক্রসিং অরক্ষিত। তাই বিপুলসংখ্যক রেলক্রসিং অরক্ষিতই রয়ে গেছে। এ সংখ্যা দিনে দিনে আরও বাড়ছে।
রেলের উচ্চপর্যায়ের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের কারণে ট্রেন যথাযথ গতি নিয়ে চলতে পারছে না। এসব ক্রসিংয়ে ট্রেনযাত্রীসহ সাধারণ মানুষেরও প্রাণ যাচ্ছে। যেসব প্রতিষ্ঠান রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কোনো অনুমোদন না নিয়ে অবৈধ লেভেল ক্রসিং নির্মাণ করছে, দুর্ঘটনার জন্য তারাই দায়ী। আমরা উদ্যোগ নিচ্ছি কীভাবে এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। কীভাবে রেলপথকে নিরাপদ করা যায়।

এখন যেসব নতুন রেলপথ করা হচ্ছে, সেগুলোয় লেভেল ক্রসিং এড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। তা ছাড়া বৈধ যেগুলো রয়েছে, সেগুলোর মানোন্নয়ন নিশ্চিত করাসহ অবৈধ ক্রসিংগুলোর বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। রেল কর্তৃপক্ষের মধ্যে এমন একটা ধারণা জন্মেছে যে রেলক্রসিংয়ে যানবাহন চাপা পড়ে প্রাণহানির দায় তাদের নয়।

কারণ বেশিরভাগ সংস্থা সড়ক নির্মাণের সময় তাদের অনুমতি নেয়নি। অথচ রেলের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে নির্মাণ করা বৈধ রেলক্রসিংয়েরও ৬১.৫৮ শতাংশই অরক্ষিত। রেলক্রসিং পারাপারের সময় যেসব পথচারী প্রাণ হারান, সেই হিসাবও রেল কর্তৃপক্ষ প্রায়ই সংরক্ষণ করে না।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, দেশের ২ হাজার ৯৫৯ কিলোমিটার রেলপথে ২ হাজার ৮৫৬টি লেভেল ক্রসিং আছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৪৯৫টি বৈধ ও এক হাজার ৩৬১টি অবৈধ। অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের হার ৪৮ শতাংশ। পূর্বাঞ্চল রেলে মোট ১ হাজার ৩৭৭টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে, যার ৮১১টি অবৈধ। পশ্চিমাঞ্চলে আছে ১৪৭৯টি, যার ৫৫০টি অবৈধ।

৯৬১টি ক্রসিংয়ে কোনো গেটম্যান নেই। এরমধ্যে বৈধ লেভেল ক্রসিংগুলোর মধ্যে ৬৩২টিতে গেটকিপার নেই। সব মিলিয়ে দেশে ৮২ শতাংশ রেল ক্রসিংই অনিরাপদ। অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ে যেমন গেটকিপার নেই, নেই কোনো সুরক্ষা সরঞ্জামও। 
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক গণমাধ্যমে বলেছেন, সড়কের সঙ্গে রেলের কোনো সমন্বয় নেই। শুধু যে লেভেল ক্রসিং ঝুঁকিপূর্ণ তা নয়। রেললাইনের আশপাশের এলাকাও ঝুঁকিপূর্ণ। পাহারাদার ছাড়া কোনো লেভেল ক্রসিং রাখার কোনো সুযোগ নেই। রেললাইনের পাশে ৩ ফুট করে খুঁটির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। নগরায়ণের জন্য রেললাইনের প্রতি কিলোমিটারের মধ্যে একটি করে লেভেল ক্রসিং তৈরি হয়ে গেছে।
রেলওয়ের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় তিনটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে, সেখানে স্থানীয় সরকার এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে কমিটি গঠিত হয়েছে। সেই কমিটিকে রেলওয়েতে অরক্ষিত (রেল হেটবিহীন) বৈধ-অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের সংখ্যা নির্ধারণসহ বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এরপরেও দেশে অবৈধ লেভেল ক্রসিং বন্ধ হয়নি। ফলে রেল দুর্ঘটনা কমছে না।

×