ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১২ জানুয়ারি ২০২৫, ২৮ পৌষ ১৪৩১

অবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি জাতীয় নাগরিক কমিটির ॥ অর্থনীতির গতি কমার আশঙ্কা ঢাকা চেম্বারের

শতাধিক পণ্যে শুল্ক-কর বাড়ানোর কঠোর সমালোচনা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২২:৫৭, ১১ জানুয়ারি ২০২৫

শতাধিক পণ্যে শুল্ক-কর বাড়ানোর কঠোর সমালোচনা

শতাধিক পণ্যে শুল্ক-কর বাড়ানোর অধ্যাদেশ জারি

অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে শতাধিক পণ্যে শুল্ক-কর বাড়ানোর অধ্যাদেশ জারির কঠোর সমালোচনা করে জাতীয় নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে- অবিলম্বে এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে হবে। এছাড়া এই মুহূর্তে টিসিবির ট্রাকসেল চালু করার দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। অন্যদিকে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) পক্ষ থেকেও দ্রুত ভ্যাট সংক্রান্ত অধ্যাদেশ প্রত্যাহারের দাবি করা হয়েছে।

ডিসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ভ্যাট বাড়ানোর এই সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী। এর ফলে অর্থনীতির গতি কমে যাবে। এ ছাড়া অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারী এবং সাধারণ মানুষও সরকারের এই সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করে জানিয়েছে, এতে জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বেড়ে যাবে। মূল্যস্ফীতি বেড়ে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এতে কর্মসংস্থানের জায়গা আরও সংকুচিত হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
শনিবার দুপুরে রাজধানীর বাংলামোটরে নিজেদের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য আলাউদ্দিন মোহাম্মদ, সহ-মুখপাত্র মুশফিক উস সালেহীন প্রমুখ। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বিকল্প হিসেবে কয়েকটি প্রস্তাবও তুলে ধরেছে জাতীয় নাগরিক কমিটি।

সম্প্রতি সরকার রাজস্ব আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর জন্য দুটি অধ্যাদেশ জারি করেছে। এর ফলে মূল্যস্ফীতি ও ব্যবসায়ের খরচ বাড়বে, যা সাধারণ মানুষের জীবনমানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সরকার তার রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য করের আওতা বাড়াবে, এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু কর বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারকে স্মরণ রাখতে হবে যে, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান যাতে নেমে না যায় এবং তাদের ভোগান্তি যাতে না বাড়ে।

লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, বিগত অবৈধ সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি ও বিদেশে অর্থ পাচারের কারণে দেশের অর্থনীতির অবস্থা খুবই ভঙ্গুর ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে। এ অবস্থায় বিগত অবৈধ সরকার আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে চার দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণসহায়তা গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। যেকোনো দেশের জন্য আইএমএফের ঋণ হলো ঋণপ্রাপ্তির সর্বশেষ আশ্রয়। এই কঠিন ঋণের শর্ত হিসেবে কয়েকটি ধাপে ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্তের অংশ হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকার সম্প্রতি এ অধ্যাদেশগুলো জারি করেছে।

কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সৃষ্ট সরকারের কাছে প্রশ্নে অবৈধ সরকারের ঋণের এই শর্ত বর্তমান সরকার পুনর্বিবেচনার জন্য আইএমএফকে আহ্বান জানিয়েছে কি? তা স্পষ্ট নয়। গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সৃষ্ট সরকার একটি অবৈধ সরকারের চুক্তির ধারাবাহিকতা বজায় রেখে জনগণের দুর্ভোগ বাড়াতে পারে না।
নাগরিক কমিটির প্রস্তাবে বলা হয়, সরকার করের আওতা বাড়াতে পারে, যা সরাসরি সাধারণ মানুষের জীবনমানের ক্ষতি করবে না। প্রত্যক্ষ কর বাড়ানো সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জিং, কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সরকারকে অবশ্যই সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে। বিদ্যমান করের কাঠামোয় যে সীমাহীন দুর্নীতি হয়, তা বন্ধ করার উদ্যোগ নিলে রাজস্ব আয় বাড়বে বলে মনে করেন তারা।

প্রস্তাবের মধ্যে আরও রয়েছে, বিগত সরকার ১৫ বছরে বিদেশে ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার করেছে বলে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে শ্বেতপত্রে উঠে এসেছে। সেগুলো দেশে ফেরত আনার জন্য সরকারকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। গত ১৫ বছরে দেশের ব্যাংকগুলোকে দেউলিয়া করে ৯২ হাজার কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে এবং খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই লাখ কোটি টাকার বেশি।

এগুলো আদায়ের উদ্যোগ নিতে হবে। বিদ্যমান অর্থঋণ আদালত (২০০৩) সরকারকে দ্রুত ট্রাইব্যুনাল গঠন করার যাবতীয় আইনি সুযোগ দিয়েছে। সরকার এ সুযোগ ব্যবহার করে দ্রুত একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করে খেলাপি অর্থ আদায় ও অনাদায়ে তাদের সম্পত্তি ক্রোক করতে পারে।
ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী ॥ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মাঝপথে এসে শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক ও করপোরেট কর বাড়িয়েছে সরকার। অংশীদারদের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করে ভ্যাট বৃদ্ধির এ সিদ্ধান্তকে আত্মঘাতী বলে মনে করছে ডিসিসিআই। শনিবার রাজধানীর মতিঝিলে সমসাময়িক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন ডিসিসিআই সভাপতি তাসকীন আহমেদ। এ সময় ঢাকা চেম্বারের ঊর্ধ্বতন সহসভাপতি রাজিব এইচ চৌধুরীসহ সংগঠনটির নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ জানান, বর্তমানে উচ্চ মূল্যস্ফীতি রয়েছে, ডলারের দাম বেশি। গণঅভ্যুত্থানের পর বিনিয়োগে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। ঋণের সুদহারও অনেক বেশি। এমন পরিস্থিতিতে ভ্যাট বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত অর্থনীতির গতি কমিয়ে দেবে। এতে চাপে পড়বে আপামর জনগণ। তাসকীন আহমেদ বলেন, সরকারের এমন পদক্ষেপের সঙ্গে আমরা একমত নই। বেসরকারি খাতে একসঙ্গে এতগুলো জায়গায় ভ্যাট বৃদ্ধির এই সিদ্ধান্ত আত্মঘাতীমূলক। এ বিষয়ে অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করবেন বলে জানান ডিসিসিআই সভাপতি।
সরকার নীতির ধারাবাহিকতা ঠিক না রাখায় ব্যবসায়ের চ্যালেঞ্জ বেড়ে যায় বলে জানান ঢাকা চেম্বারের সভাপতি। তিনি বলেন, নীতির ধারাবাহিকতা ঠিক না রাখার সর্বশেষ উদাহরণ হলো গত সপ্তাহের এই ভ্যাট বৃদ্ধির ঘটনা। মোটরসাইকেল ও ইলেক্ট্রনিকস খাতের কিছু পণ্যে আয়কর ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছে। এটি ব্যবসায়ীদের শুধু বিপদে  ফেলবে না, একই সঙ্গে দেশের ভাবমূর্তিকেও খারাপ করছে।

আয়কর বাড়ানোয় আগামী তিন মাসের মধ্যে মোটরসাইকেলের দাম ১০-১৫ শতাংশ বাড়তে পারে বলে জানান তিনি। মানুষকে কষ্ট দিয়ে এভাবে ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত না নিয়ে সরকারকে অন্য উপায় খোঁজার পরামর্শ দেন তাসকীন আহমেদ। তিনি বলেন, সরকারি ব্যয় ২০ শতাংশ কমানো গেলে সেখান থেকে এক বছরে ৫০ হাজার কোটি টাকার মতো সাশ্রয় করা সম্ভব। সুতরাং সরকারি ব্যয় কমান। কর-ভ্যাট বাড়িয়ে আমাদের আর নাভিশ্বাস বের করবেন না।

দেশে রাজনীতি ও অর্থনীতির গতিপথ আলাদা থাকা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন ডিসিসিআই সভাপতি। তিনি বলেন, দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ব্যবসায়ের পরিস্থিতি আরও খারাপ করেছে। বর্তমানে অনেক সংস্কারের কথা শুনছি, সামনে নির্বাচনের আলোচনাও রয়েছে। তবে আমরা মনে করি, অর্থনীতি ও রাজনীতি একই পথে যেন না চলে। রাজনীতি রাজনীতির মতো করে চলুক, সেটি যেন অর্থনৈতিক কর্মকা-কে প্রভাবিত না করে। 
ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের উদ্বেগ ॥ শতাধিক পণ্যে শুল্ক-কর বাড়ানোর অধ্যাদেশ জারি হওয়ায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের মাঝে। তারা বলছেন, পুঁজির ঘাটতি, ডলারের উচ্চমূল্য, সুদের উচ্চহার, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটসহ নানা সীমাবদ্ধতায় অনেক দিন ধরেই দেশের শিল্প-কারখানার চাকা গতি হারিয়েছে। কঠিন সময় পার করছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। এর মধ্যে জুলাই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পরিবেশ অনেকটাই অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে।

তদুপরি আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর যোগ হয় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি। যার প্রভাব পড়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে, নেমে আসে স্থবিরতা। সেই পরিস্থিতি এখনো কাটিয়ে ওঠা যায়নি। এখনো ব্যবসায়ীদের মধ্যে ফিরে আসেনি স্বস্তি। উপরন্তু অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে এসে শতাধিক পণ্য-সেবার ওপর ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানোয় নতুন করে চাপ তৈরি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

তারা বলছেন, এভাবে মরা ব্যবসা-বাণিজ্যে একের পর এক খাঁড়ার ঘা পড়তে থাকলে শিল্পের বিকাশ স্থবির হয়ে পড়বে, বাধাগ্রস্ত হবে কর্মসংস্থান। দীর্ঘমেযাদে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া ব্যবসার পরিবেশ তৈরি হবে না। দেশের মানুষ এখনো জানে না রাজনীতি কোন পথে যাচ্ছে।

বিনিয়োগকারীরা এখন নির্বাচিত সরকারের অপেক্ষায় আছেন। নির্বাচন যখনই হোক না কেন, তার একটি নির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা থাকা দরকার। এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ানো ঠিক হয়নি। এতে করে শিল্পখাতের উৎপাদন ও রপ্তানি কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এরইমধ্যে অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে আবার শতাধিক পণ্যে শুল্ক-কর বাড়ানো হয়েছে। এ ব্যাপারে অংশীজনদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করা হয়নি।

তিনি বলেন, ভ্যাট ও করারোপের ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়বে। মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেলে আরেকদফা বাড়বে জিনিসপত্রের দাম। তিনি বলেন, ডলারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে খরচ বেড়েছে। এখন বাড়তি শুল্ককর গুনতে হবে। এ অবস্থায় গার্মেন্টস ও প্লাস্টিকসহ কোনো উৎপাদনমুখী শিল্পকারখানা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, শুল্ক-কর সংক্রান্ত অধ্যাদেশ দ্রুত প্রত্যাহার ও গ্যাসের দাম কমাতে হবে।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী বলেন, যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, সেগুলোর ফলে উৎপাদন খাতের টিকে থাকা আরও কঠিন হবে। এখন প্রয়োজন শিল্পের বিকাশ, যাতে কর্মসংস্থান বাড়ে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক না কাটলে সংকট আরও ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ব্যবসায়ে গতি আনতে ব্যবসাবান্ধব নীতি ও পরিবেশ প্রয়োজন, যাতে সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলে। 
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ব্যবসায় স্থিতিশীলতার জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দরকার। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না আসলে পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে না। বিশ্বব্যাংক ঢাকা আবাসিক মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা আছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আপাতত পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। স্থবিরতা এখনো চলমান, তাই এখনই ভালো কিছু আশা করা যাচ্ছে না। এখনো বিভিন্ন দাবি নিয়ে আন্দোলন চলে, তা দুর্ভোগ বাড়িয়ে দেয়।
তিনি আরও বলেন, ভ্যাট, ট্যাক্স ও গ্যাসের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ আরও বাড়বে। নতুন করে শুল্ক-কর বাড়ায় প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে রয়েছে রেস্তোরাঁ ও হোটেল-রিসোর্ট খাত। বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান বলেন, বর্ধিত ভ্যাট ও আগের সম্পূরক শুল্ক (এসডি) ১০ শতাংশ যোগ করা হলে ভোক্তাদের মোট ২৫ শতাংশ কর দিতে হবে।

গুলশান ও বনানীর মানুষেরা এই ভ্যাট দিতে পারেন, কিন্তু সাধারণ মানুষের পক্ষে এটা দেওয়া সম্ভব নয়, বিষয়টি অবাস্তব। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে এমনিতেই রেস্তোরাঁ ব্যবসা ৩০  থেকে ৪০ শতাংশ কমে গেছে। এ অবস্থায় ভ্যাট বাড়লে পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে। এদিকে, ভ্যাট হার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়াবে আরেক দফা। এই ব্যয় বা মূল্যস্ফীতি কমাতে নেওয়া মুদ্রানীতির বাস্তবায়ন সফল হচ্ছে না বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও শ্বেতপত্র কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

তিনি বলেন, বাজার ব্যবস্থাপনায় নজর দেওয়া প্রয়োজন। এর আগে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণের জন্য নয়, বরং রাজস্ব বাড়ানোর উদ্দেশে বিভিন্ন পণ্যের ওপর ভ্যাট বৃদ্ধি করা হয়েছে। তিনি দাবি করেন, ৪৩টি পণ্যের ওপর ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে নিত্যপণ্যের দামে কোনো বড় প্রভাব পড়বে না। 
আইএমএফের চাপ ॥ ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আইএমএফ ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি করেছিল। সে সময় দাতা সংস্থাটি শর্ত দিয়েছিল বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকি কমাতে হবে এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মধ্যে বাস্তবসম্মত করনীতি প্রণয়নে রাজস্ব বাড়িয়ে কর-জিডিপির অনুপাত দশমিক ৫ শতাংশ বাড়াতে হবে। আওয়ামী লীগ সরকার সে শর্ত পূরণে ব্যর্থ হয়েছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও পারছে না সে শর্ত পূরণ করতে।

তাই অনেকটা বাধ্য হয়ে এবার কর-জিডিপির অনুপাত বাড়াতে সরকার একসঙ্গে শতাধিক পণ্যের শুল্ককর বাড়িয়ে দিল। আর আইএমএফের এই ফাঁদে পড়ে দেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা আরও কঠিন হয়ে গেল। কারণ যেসব পণ্যের শুল্ককর বাড়ানো হয়েছে তার অধিকাংশই সাধারণ মানুষের জীবনঘনিষ্ঠ এবং প্রতিটি পণ্যেরই দাম বেড়ে যাবে অত্যধিক। এতে কষ্ট বাড়বে তাদের।

অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, আইএমএফের ফাঁদে পড়েই আওয়ামী লীগ সরকার যেমন দেশের মানুষের কথা না ভেবে অর্থনৈতিক নীতি ঠিক করেছে, তেমনিভাবেই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও আইএমএফের কথামতো শতাধিক পণ্যের শুল্ককর বাড়িয়ে দেশের সাধারণ মানুষের জীবন কঠিন করে তুলেছে। এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ বলেন, এভাবে একসঙ্গে শতাধিক পণ্যের শুল্ককর বাড়ানো সরকারের খুবই দায়িত্বহীন কাজ হয়েছে।

শুধু দায়িত্বহীনতা নয়, এ ধরনের কাজ সরকারের বড় ভুল বলেও আমি মনে করি। এর নেতিবাচক প্রভাব সমাজের ওপর, অর্থনীতির ওপর, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ওপরে কতটা পড়বে সেটা আগে বোঝার দরকার ছিল সরকারের। 
উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার রাতে দুটি অধ্যাদেশে শতাধিক পণ্য কেনাকাটায় এবং সেবা নিতে আগের চেয়ে বাড়তি শুল্ক ও কর  দেওয়ার আদেশ জারি করে অন্তর্বর্তী সরকার। পণ্য ও  সেবায় শুল্ক, কর ও ভ্যাট বাড়ানোর অধ্যাদেশ জারির পরপরই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এ বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছে। এতে তা সঙ্গে সঙ্গেই কার্যকর হয়ে গেছে।

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, সরকার এসব পণ্যকে নিত্যপণ্য বলে স্বীকার না করলেও এগুলো জীবন-জীবিকার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এগুলোর ওপর ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ানোর প্রভাব পড়বে ভোক্তার ঘাড়ে। তার অভিযোগ, সরকার যখন শুল্ক ছাড় দেয়, তখন ভোক্তা সেই সুফল পান না। এর ফল ভোগ করে ব্যবসায়ী চক্র। অন্যদিকে ভোক্তা ভ্যাট-ট্যাক্স দিলেও ব্যবসায়ী ও এনবিআরের কর্মকর্তারা মিলে তা লুটে  নেন। অথচ কর ফাঁকির মহোৎসবের কারণে সাধারণ মানুষ বারবার বলি হচ্ছেন।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, কয়েক বছর ধরেই উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ রয়েছে। জিনিসপত্রের দামের স্তরও অনেক ওপরে উঠে গেছে। এতে সবাই হিমশিম খাচ্ছে। তাদের  প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। এখন নতুন শুল্ক-কর আরোপের ফলে এই শ্রেণির মানুষের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হবে।

×