বাড়তে পারে বিদ্যুতের দাম
নতুন শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়াতে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের কাছে প্রস্তাব দিয়েছে পেট্রোবাংলা। প্রায় দেড়গুণ দাম বাড়ানোর এ প্রস্তাবকে আত্মঘাতী বলে সিদ্ধান্ত বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। এরই মধ্যে আভাস পাওয়া গেছে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর জন্যও চলছে প্রক্রিয়া। আর এর কারণ বিদ্যুৎ খাতে বেসরকারি প্রকল্পে ‘বাস্তবায়ন চুক্তি বা ইম্পপ্লিমেন্ট এগ্রিমেন্ট (আইএ)’ বাতিল করা। যা ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে।
সম্প্রতি ১০ সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য আহ্বান করা দরপত্রে এটি বাতিল করা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর ফলে বিদ্যুৎ খাতে সব ধরনের বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হবে। বিশেষ এই খাতে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। পাশাপাশি বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বাড়ার সঙ্গে গ্রাহক পর্যায়ে দামও বাড়বে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) লোকসান বেড়ে যাওয়ারও শঙ্কা রয়েছে।
বিদ্যুৎ প্রকল্পে ‘বাস্তবায়ন চুক্তি বা ইম্পপ্লিমেন্ট এগ্রিমেন্ট (আইএ)’ হচ্ছে বিনিয়োগের ঝুঁকি মোকাবিলা করার জন্য রাষ্ট্রের সার্বভৌম গ্যারান্টির মতো। এটি মূলত বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির (পিপিএ) সম্পূরক চুক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আইএ থাকার কারণে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের নিশ্চয়তা পায়। আর বাস্তবায়নকারী কোম্পানি স্বল্প সুদে ঋণসহ দাতা সংস্থা থেকে বিভিন্ন সুবিধা পেয়ে থাকে।
এই কারণে উৎপাদন খরচ কম হয়। দামও কম থাকে। ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা, অ্যাঙ্গোলা, সেনেগালের মতো দেশগুলোর বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির (পিপিএ) সম্পূরক চুক্তি হিসেবে আইএ করার বিধান রয়েছে। বাংলাদেশে এ যাবৎ বেসরকারি খাতে যত বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে, সবগুলোতেই আইএ ছিল।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইএ বাতিল হওয়ার কারণে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) বাধাগ্রস্ত হবে এবং বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। কারণ বিনিয়োগকে তারা ঝুঁকিপূর্ণ মনে করবে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোও সক্ষমতা বিবেচনায় ঋণ সহায়তা দেবে না। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে বাস্তবায়নকারী কোম্পানির ব্যয় বেড়ে যাবে। এই বাড়তি ব্যয় উৎপাদন খরচের সঙ্গে যোগ হয়ে গ্রাহকের কাঁধে পড়বে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) গেল বছরের ৫ ডিসেম্বর আইএ বিধান ছাড়া ৩২৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার ১২টি নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করে। পরে চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি পাঁচশ’ মেগাওয়াট সক্ষমতার আরও ১০টি সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পের দরপত্র আহ্বান করে। দরপত্র অনুযায়ী, প্রকল্প বাস্তবায়ন ও চালু হওয়ার পর সরকার ২০ বছরের জন্য একটি নির্দিষ্ট দামে বিদ্যুৎ কিনতে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি (পিপিএ) স্বাক্ষর করবে।
গ্যাস-বিদ্যুতে সরকারের পর পর এমন সিদ্ধান্তে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এই খাতের বেসরকারি উদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারী এবং বিশেষজ্ঞরা। গত ৭ জানুয়ারি বিদ্যুৎ সচিবের সঙ্গে এক বৈঠকে উদ্যোক্তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেন। আইএ বাতিল করায় অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ খাতে নেওয়া প্রকল্পগুলোর জন্য ডাকা দরপত্রে দেশী-বিদেশী কোম্পানি-বিনিয়োগকারী অংশ কমে যাওয়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন বেসরকারি উদ্যোক্তারা।
একই দিন বাংলাদেশ ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার অ্যাসোসিয়েশনের (বিপা) সভাপতি কেএম রেজাউল হাসনাত বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিক উদ্বেগ প্রকাশ করে বিদ্যুৎ সচিবকে একটি চিঠিও দেন। এ বিষয়ে কেএম রেজাউল হাসনাত জনকণ্ঠকে বলেন, যেহেতু আইএ বিধান থাকার কারণে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা দেশে বিনিয়োগে উৎসাহী ছিলেন তাই এই বিধান বাতিল হওয়ার কারণে এটি নিরুৎসাহিত হবে স্বাভাবিক। দেশীয় বিনিয়োগকারীদেরও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই আমরা এটি বহাল রাখার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছি। সরকার নিশ্চয়ই বিষয়টি বিবেচনায় নেবেন।
তবে বিশেষ কোনো কারণে এটি বাতিল করা হয়নি জানিয়ে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)-এর চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিম জনকণ্ঠকে বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির বিশেষ আইনটি বাতিল করা হয়েছে তার ফলেই আইএও বাতিল হয়েছে। তবে যেসব কোম্পানি ইতোমধ্যে বিনিয়োগ করে ফেলেছে, তারা তো উৎপাদন করছেই। নতুন করে কেউ যদি বিনিয়োগ করতে চায় তাদেরও আমরা উৎসাহিত করব।
খাত সংশ্লিষ্টরা বিশেষজ্ঞরা বলেন, আইএ বিধান বাদ দেওয়ার কারণে দরপত্রে অংশ নেওয়ার সময়ই বিনিয়োগকারীদের ব্যয় বেশি দেখাবে। ফলে যে ে কোম্পানিই কাজ পাক না কেন, দাম বেশি হবেই। এর ফলে বিপাকে পড়বে পিডিবি। বেমি দাম দিয়ে বিদ্যুৎ কিনে কম দামে বিক্রি করতে হবে। এতে লোকসান বাড়বে, ভর্তুকিও বাড়বে। পিডিবি তিন অর্থবছরে ধারাবাহিকভাবে লোকসান করে যাচ্ছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১১ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩ হাজার ২৩২ কোটি টাকা লোকসান করেছে। বর্তমানে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদকরা পিডিবির কাছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা পায়। পিডিবির আর্থিক সংকটের কারণে এই টাকা পরিশোধ করতে পারছে না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সোলার অ্যান্ড রিউনিয়েবেল এনার্জি অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট মোস্তফা আল মাহমুদ বলেন, সরকারের এই সিদ্ধান্তের কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। আর উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে স্বাভাবিকভাবে উদ্যোক্তারা দাম বাড়ানোর বিষয়ে জোর দেবেন। এতে করে শুধু বিনিয়োগকারীরা নন গ্রাহক পর্যায়েও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরাও এটিকে সরকারের আরেকটি ভুলনীতি বলে মনে করছেন। কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, বঙ্গোপসাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধানে অনেক ঘটা করে দরপত্র আহ্বান করা হয়। ৭টি কোম্পানি ডাটা কেনে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো কোম্পানি অংশ নেয়নি। এটা হয়েছে ভুল নীতির কারণে। এখন বিদ্যুৎ খাতেও সরকার একই ধরনের ভুল করছে।
মুডিস ২০২৪ সালের নভেম্বরে সর্বশেষ আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিংয়ে বাংলাদেশের আউটলুককে নেতিবাচক বলে অভিহিত করেছে। অন্যান্য আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং এজেন্সিগুলোও বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং কমিয়েছে। জাতীয় অর্থনৈতিক সামগ্রিক অবস্থা বিচেনা করে এই রেটিং করা হয। ফলে বাংলাদেশের বর্তমান সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না, এটা আন্তর্জাতিকভাবেই স্বীকৃত। এই অবস্থায় আইএ ছাড়া বিদ্যুৎ প্রকল্পে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ বা অর্থায়নকে আরও চ্যালেঞ্জিং করে তুলবে। বিনিয়োগ বা অর্থায়নের ঝুঁকি নিতে চাইবে না।
প্রসঙ্গত, নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের কথা বলে ২০২৩ সালে নির্বাহী আদেশে শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে তিনগুণ করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম বৃহৎ শিল্পে ১১ টাকা ৯৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়। ক্যাপটিভে ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়। এরপর গত বছর ক্যাপটিভে প্রতি ইউনিটে আরও ৭৫ পয়সা দাম বাড়ানো হয়। তবে দুই বছর পরও শিল্পে গ্যাস সংকট কাটেনি।
এ অবস্থায় সরবরাহ বাড়ানোর কথা বলে আবারও গ্যাসের দাম আড়াই গুণ বাড়াতে চায় সরকার। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে পেট্রোবাংলার পাঠানো প্রস্তাবনায় প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ৩০ টাকা ৭৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। যা শুধু নতুন শিল্প-কারখানার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে।
পুরাতনদের ছাড় দেওয়া হবে মূল্যে। এতে করে দেশের চলমান শিল্পোন্নয়ন থমকে যাওয়ার আশঙ্কাও করছেন ব্যবসায়ীরা। এই অবস্থার মধ্যে আইএ বিধান বাতিল হওয়ার কারণে বিদ্যুতের দাম বাড়ারও আশঙ্কা থেকে যায় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তবে এখন থেকে প্রতিযোগিতামূলক পদ্ধতি ছাড়া কারো কাজ পাওয়ার সুযোগ নেই। আর তাই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান। তিনি বলেন, পূর্বের সরকার নিজেদের নানামুখী সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে ঢালাওভাবে কাজ দিয়েছে কোম্পানিগুলোকে। আমরা এর থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। নতুন সিদ্ধান্তেও বিনিয়োগকারীরা আসবে বলেই আমরা বিশ্বাস করি। এতে উৎপাদন খরচ বাড়লেও তেমন একটা প্রভাব পড়বে না।