ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২২ জানুয়ারি ২০২৫, ৯ মাঘ ১৪৩১

এপ্রিলের আগে সব শিক্ষার্থী বই পাবে না

সবার হাতে বই যেতে দেরি

আসিফ হাসান কাজল

প্রকাশিত: ২২:২৫, ৭ জানুয়ারি ২০২৫

সবার হাতে বই যেতে দেরি

কাগজের সংকটে পাঠ্যবই ছাপার কাজ চলছে ধীরগতিতে

ছাপাখানার সক্ষমতার অভাব, কাগজের সংকটে পাঠ্যবই ছাপার কাজ চলছে ধীরগতিতে। এতে করে সব শিক্ষার্থীর হাতে বই পৌঁছাতে আরও অন্তত ১০০ দিন সময় লাগবে। ফলে এপ্রিলের আগে সব পাঠ্যবই শিক্ষার্থীর হাতে যাওয়ার সুযোগ নেই। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) বলছে, শেষ মুহূর্তে বইয়ের বিষয় পরিবর্তন ও বছরের অন্তিম পর্যায়ে পাঠ্যবইয়ের কাজ শুরু হয়েছে।

যত্রতত্র নিউজপ্রিন্টের কাগজেও বই ছাপানো হচ্ছে না। মান রক্ষা করতে একটু বিশেষ সময় লাগছে। এদিকে বছরের শেষ সময়ে বই ছাপার কাজ শুরু হওয়ায় মন খারাপ শিক্ষার্থীদের। শিক্ষাবর্ষের প্রথমদিন অধিকাংশ শিক্ষার্থীই পাঠ্যবই না পেয়ে খালি হাতে ফিরেছে। বছরের শুরুতে পাঠ কার্যক্রমেও পড়েছে প্রভাব। শিক্ষার্থী ও শিক্ষক নতুন বই না পেয়ে পিডিএফে ডাউনলোড করেছে। এপ্রিল নাগাদ পাঠ্যবই ছাপা হলে তা শিক্ষা ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করবে।
এনসিটিবির দেওয়া পরিসংখখ্যান অনুযায়ী, শনিবার পর্যন্ত মাধ্যমিকের ২ কোটি ২৪ লাখ ৮৬ হাজার বই ছাপা হয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জন্য সাত কোটি বইয়ের প্রয়োজন হলেও ছাপা হয়েছে মাত্র ৫৭ লাখ। কারিগরি শিক্ষার্থীদের বই ছাপার সংখ্যাও বেশি নয়। প্রাথমিকে ৯ কোটির বেশি বই প্রয়োজন হলেও ছাপা হয়েছে ৪ কোটি ৬৫ লাখ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৪০ কোটি বইয়ের মধ্যে ৮ কোটির কিছু বেশি পাঠ্যবই ছাপা হয়েছে। বাকি রয়েছে আরও ৩২ কোটি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক প্রেস মালিক জানান, বর্তমানে দেশের ছাপাখানাগুলোতে প্রতিদিন ৩০-৩৫ কোটি পাঠ্যবই ছাপানোর সক্ষমতা রয়েছে। যে পরিমাণ বই ছাপানো বাকি আছে, প্রতিদিন সক্ষমতা অনুযায়ী ছাপানো হলেও কাজ শেষ করতে আরও ১০০ দিন সময় লাগবে। এর মধ্যে অনেক বই আছে যেগুলো মাঠপর্যায়ে ত্রুটির কারণে ফিরে আসবে। তখন আবারও বই ছাপিয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিতে হবে।

আবার নতুন করে তৈরি হয়েছে কাগজের সংকট। মুদ্রাকরদের অভিযোগ, চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সব কাগজকল কারণ ছাড়াই টন প্রতি বইয়ের দাম ২০-৩০ হাজার পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েছে। আগে যে কাগজের দাম ছিল প্রতিটন ১ লাখ ১০ হাজার সেটি এখন এক লাখ ৪০ হাজারে ঠেকেছে। আর কাগজ স্বল্পতার কারণে ব্যবসায়ীদের কপালে চিন্তার ভাজ ফেলেছে।
এসব বিষয়ে এনসিটিবি পাঠ্যপুস্তক সদস্য প্রফেসর ড. রিয়াদ চৌধুরী জনকণ্ঠকে জানান, কাগজের সংকট নিরসনে এনসিটিবি নিজ উদ্যোগে কাগজকলগুলোকে বলছে সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে। প্রেস মালিকদের জন্য আর্থিক ঋণ দিতে ব্যাংকগুলোকে অনুরোধ করা হচ্ছে। অর্থাৎ এনসিটিবি নিজ অর্গানোগ্রামের বাইরেও কাজ করছে। কিন্তু বই যে দেরিতে যাবে এ বিয়য়ে তিনি দ্বিমত করেননি।
বছরের প্রথম দিন সব শিক্ষার্থীর হাতে পাঠ্যবই নিশ্চিত করতে একাধিক উদ্যোগের কথা জানায় এনসিটিবি। নানা রকম পরিকল্পনা করলেও অবশেষে সেটি ব্যর্থ হয়। সব পাঠ্যবই এপ্রিল নাগাদ পৌঁছানো হলে সেটি শিক্ষার্থী ও শিক্ষা ব্যবস্থায় বিপর্যয় তৈরি করতে পারে।
পাঠ্যপুস্তক বোর্ড সূত্র জানায়, এবার প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী সংখ্যা ৪ কোটি ৩৪ লাখ ৩ হাজার ২৮৩ জন। তাদের জন্য ছাপা হচ্ছে ৪০ কোটি ১৫ লাখ ৬৭ হাজার ২০২ কপি বই। প্রাথমিকের ২ কোটি ৯ লাখ ৪৪ হাজার ৪৭৯ শিক্ষার্থীর জন্য ছাপানো হচ্ছে ৯ কোটি ১৯ লাখ ৫৪ হাজার ৩৫৫টি বই।

মাধ্যমিক পর্যায়ের ২ কোটি ২৪ লাখ ৫৮ হাজার ৮০৪ শিক্ষার্থীর জন্য ছাপানো হচ্ছে ৩০ কোটি ৯৬ লাখ ১২ হাজার ৮৪৭ কপি বই। তা ছাড়া দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য সাড়ে ৮ হাজারের বেশি ব্রেইল বই ছাপা হচ্ছে। শিক্ষকদের জন্য প্রায় ৪১ লাখ সহায়িকা ছাপা হবে। তবে সর্বশেষ এনসিটিবির দাবি ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬ কোটি বই দেশজুড়ে সরবরাহ করেছে। এর মধ্যে প্রাথমিক স্তরের বইয়ের সংখ্যা বেশি।
এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান জনকণ্ঠকে জানান, প্রেস মালিকরা যদি সহযোগিতা করেন তবে জানুয়ারি মাসের মধ্যেই বই দেওয়া সম্ভব। কিন্তু তারা সহযোগিতা না করলে এটি এপ্রিলেও সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, এ বছর প্রতি টন কাগজের দর ১ লাখ ৪২ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। দ্রুত কাজ শেষ করতে আরও ২০ ভাগ টাকা অতিরিক্ত দেওয়া হচ্ছে। এতে যদি তারা ১ লাখ ৪০ হাজার টাকায় কাগজ কিনে তাতেও তারা লাভ করবে।

কিন্তু ব্যবসায়ীরা নিম্নমানের কাগজে বই ছাপতে উৎসাহী সেকারণে ধীরে কাজ করছে। অথচ এর আগের সময় তারাই প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ৪৫ শতাংশ কমে বই ছাপিয়ে দিয়েছেন। প্রেসের সক্ষমতার বিষয়ে তিনি বলেন, বড় বড় প্রেস মালিকরা জানিয়েছিলেন, তারা প্রতিদিন ১ হাজার টন কাগজের বই ছাপতে সক্ষম। আমাদের এমন কথায় জানিয়েছিলেন। এই মুহূর্তে তারা সক্ষমতার অভাব বলছেন, আসলে বিষয়টি হলো, যদি নি¤œমানের কাগজে ছাপতে দেওয়া হত তাহলে তিন মাস নয় এক মাসও বই ছাপাতে লাগত না।
দশম শ্রেণির বইয়ে অগ্রাধিকার ॥ চলতি বছরের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের দুই বছরের পরিবর্তে এক বছরের মধ্যে সিলেবাস শেষ করতে হবে। ২০২৬ সালের এসএসসি পরীক্ষা নেওয়া হবে সংশোধিত সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে। বিগত বছরগুলোতে নবম ও দশম শ্রেণিতে পুরনো শিক্ষাক্রম অনুসরণ করে শিক্ষার্থীরা এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে আসছিল। এবার এসব শিক্ষার্থী এক বছর নতুন কারিকুলাম ও দ্বিতীয় বছর পুরনো কারিকুলামে পড়বে। কিন্তু হাতে সময় কম হলেও এখনো এসব শিক্ষার্থীর হাতে বই পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়নি।
এদিকে ২০১২ সালের প্রণীত শিক্ষাক্রম অনুসরণ করে আবারও বিভাগ বিভাজনে ফিরছে। শিক্ষার্থীরা কে কোন বিভাগ নেবে সেটাও ঠিক হবে দশম শ্রেণিতেই। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) থেকে এ তথ্য জানা গেছে। বিভাগ বিভাজনের পর শিক্ষার্থীরা এক বছরের মধ্যেই নতুন শিক্ষাক্রম অনুসরণ করে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা প্রস্তুতি গ্রহণ করবে।

এর মধ্যেই ২০২৬ সালের এসএসসি পরীক্ষার জন্য প্রশ্নের ধরন সময় ও নম্বর বণ্টন করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড। সিলেবাসে থাকা বিষয়গুলো রচনামূলক অংশের ৭০ নম্বর এবং বহুনির্বাচনী অংশ ৩০ নম্বর থাকবে। ব্যবহারিক বিষয়গুলোতে তত্ত্বীয় অংশে ৭৫ ও ব্যবহারিক অংশে ২৫ নম্বর থাকবে। তত্ত্বীয় অংশে ৪০ নম্বর ও বহুনির্বাচনী অংশে ২৫ নম্বর থাকবে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান জনকণ্ঠকে জানান, খুব কম সময় এবং অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্যে আমরা কাজ শুরু করেছি। জুলাই বিপ্লবের পর শিক্ষা খাতে পূর্বের যে শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক এবং পরীক্ষা পদ্ধতি চালু ছিল শিক্ষক-অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সে সিলেবাস স্থগিত করতে হয়েছে।

সর্বশেষ যে বইগুলো পড়ানো হতো সে বইগুলোর ওপর পরিমার্জন করতে হয়েছে। ৪৪১টি বই মাত্র আড়াই মাসে পরিমার্জন করতে পেরেছি। তবে আমরা দশম শ্রেণির বইকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। আমরা আশা করছি জানুয়ারির ১০ তারিখের মধ্যে এই শ্রেণির সব শিক্ষার্থীর হাতে বই পৌঁছে দেওয়া যাবে।
যদিও এর আগে পাঠ্যবই ছাপার কাজটা যুদ্ধের মতো হয়েছে জানিয়ে ঠিক কবে নাগাদ সব বই ছাপিয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে দেওয়া যাবে, তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি দিতে অপারগতা জানিয়েছিলেন শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান বলছেন ১৫ জানুয়ারি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বলছেন ৩০ জানুয়ারির মধ্যে সব বই দেওয়া যাবে।

আমি কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনো প্রতিশ্রুতি দেবো না। পাঠ্যবই কবে ছাপা শেষ হবে, তা নিয়ে আমি কিছু বলব না। বই ছাপার প্রক্রিয়াটা সম্পর্কে কিছু কথা বলব। আমি মনে করি, পাঠ্যবই ছাপার কাজটা এবার শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের মতো হয়েছে। 
তিনি জানান, ‘শিশুদের কাছে বই যাবে, সেটা ভালো কাগজে ছাপা না হলে তো হয় না। সেজন্য উন্নতমানের ছাপা, উন্নত মানের কাগজ ও মলাটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তা ছাড়া এনসিটিবিতে আগে যারা কাজ করেছেন, তাদের অনেককে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। যাদের বসানো হয়েছে, তারা অভিজ্ঞ। কিন্তু মুদ্রণ শিল্প সমিতির যে নেতা, তাদের সঙ্গে কীভাবে বোঝাপড়াটা করতে হয়, এটা তাদের অভিজ্ঞতায় নেই।

সেটা করতে গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমাকেও এর মধ্যে ঢুকতে হয়েছে। পাঠ্যবই নিয়ে ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত দিয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, ‘গল্পের একেবারে শেষে গিয়ে ছাড়া যেমন ষড়যন্ত্রকারী কে তা বোঝা যায় না, এখানেও তেমন। সেটা সরকারের কেউ হোক, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হোক, এনসিটিবির হোক, মজুতদার হোক, সিন্ডিকেট হোক। মানে যে কেউ হতে পারে। তবে এখনই আমি কাউকে দোষারোপ করছি না। এ অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আগামী দিনে আমরা একচেটিয়া ব্যবসা কমিয়ে আনব। এটা আমাদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় হয়ে থাকবে। 
কবে নাগাদ সব শিক্ষার্থী বই পাবে জানি না- শিক্ষা উপদেষ্টা ॥ চলতি শিক্ষাবর্ষে সব শিক্ষার্থী কবে নাগাদ সব পাঠ্যবই পাবে তা জানেন না বলে জানিয়েছেন শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
মঙ্গলবার সচিবালয়ে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা এ কথা বলেন।
বিগত সময়ে মার্চের আগে পুরোপুরি বই দেওয়া হয়নি জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, আমরা (বই ছাপা) কার্যক্রম শুরু করেছি দেরিতে। আমাদের বই পরিমার্জন করতে হয়েছে। বইয়ের সিলেবাস, কারিকুলাম নতুন করে করতে হয়েছে। বইয়ের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। বিদেশে কোনো বই ছাপানো হচ্ছে না। দেশের সক্ষমতা কত সেটা এবারই প্রথম দেখা যাচ্ছে। এতে করে তো দেরি হবেই।
তিনি বলেন, এ বছরই বোঝা গেল, সব গোডাউন যেখানে আর্ট পেপারগুলো জমা ছিল, সেগুলো সব উদ্ধার করার পরও দেখা গেল যে দেশের ভিতর আপাতত কিছু ঘাটতি আছে। (আর্ট পেপার নিয়ে) বিদেশ থেকে জাহাজ রওনা হয়ে গেছে।
কবে নাগাদ সব শিক্ষার্থী বই পাবে জানতে চাইলে শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, কবে নাগাদ সবাই সব বই পাবে এটা আমি জানি না।

×