উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল
বছরখানেক সময় পেলে সংস্কার কাজগুলো করে যাবেন বলে জানিয়েছেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। সোমবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত এক সংলাপে তিনি এ কথা জানান।
আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘বছরখানেক সময় পেলে সংস্কার কাজগুলো করে যাব। ঐকমত্য থাকলে পরবর্তী রাজনৈতিক সরকার সহজে এই সংস্কারগুলো বদলাতে বা বাতিল করতে পারবে না। আমাদের জন্য সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই। জাতীয় ঐকমত্যের প্রশ্নে সংস্কার বাস্তবায়নে মৌখিক সম্মতি দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও সংস্কার কমিশনের প্রধান।’
সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস-)এর চেয়ারম্যান মুনিরা খানের সভাপতিত্বে ও নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমানের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট নিতাই রায় চৌধুরী, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সাবেক জেলা জজ এসএম বদরুল ইসলাম, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আতাউর রহমান ঢালী, ব্লাস্টের নির্বাহী পরিচালক ব্যারিস্টার সারা হোসেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. বোরহান উদ্দিন খান, সাবেক সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী, সাবেক জেলা জজ ইকতেদার আহমেদ, খান ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট রোকসানা খন্দকার, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার এম সরোয়ার হোসেন, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও রাজনীতিবিদ মোশারফ আহমেদ ঠাকুর, অধিকারকর্মী দিদারুল আলম, জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য মোল্লা মহাম্মদ ফারুক আহসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র ও অধিকার কর্মী রাফিদ আজাদ সৌমিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র ও অধিকার কর্মী ফাহিন রহমান অংকিতা।
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ‘বাংলাদেশের উচ্চতর বিচার বিভাগকে এমন সব ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যা কাজে লাগিয়ে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী সরকারকে ক্ষমতায় রাখা হয়েছিল এবং তাদের কর্তৃত্ব সুসংহত করতে ব্যবহার করা হয়েছে। তখন অনেকে দোষী প্রমাণিত না হয়েও দীর্ঘ সময়ের জন্য আটক ছিলেন এবং জামিনের আবেদনগুলো প্রায়ই প্রত্যাখ্যান করা হতো।
আইন উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘দেশে যদি প্রতি পাঁচ বছর পর পর সুষ্ঠু নির্বাচন হতো এবং নির্বাচিত দল সরকার গঠন করত, তাহলে ক্ষমতাসীন দল বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে এতটা স্বৈরাচারী আচরণ করতে পারত না। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার ভিত্তিতে উচ্চ আদালতে বিচার বিভাগীয় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনটি সংস্কার প্রস্তাবের ভিত্তিতে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হবে।
তিনি আরও বলেন, উচ্চতর বিচার বিভাগকে এমন সব ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে , যা কাজে লাগিয়ে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী সরকারকে ক্ষমতায় রাখা হয়েছিল। তখন দোষী প্রমাণিত না হয়েও অনেকে দীর্ঘ সময়ের জন্য আটক ছিলেন। বাংলাদেশে পাঁচ বছর পর পর সুষ্ঠু নির্বাচন হয়ে যদি সরকার গঠন হতো তাহলে ক্ষমতাসীন দল বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে এতটা স্বৈরাচারী আচরণ করতে পারত না।
ঐকমত্য শক্ত থাকলে পরবর্তী সময়ে যে কোনো রাজনৈতিক দল আসলেও যেসব বিষয়ে সংস্কার আসবে তা কেউ পরিবর্তন করতে পারবে না। তিনি আরও বলেন, উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে আইন তৈরি করা, উচ্চ আদালতের আলাদা সচিবালয় প্রতিষ্ঠা, স্থায়ী প্রসিকিউশন গঠন করা। এ ছাড়া আইনের ভুলগুলো সংশোধন করা। যত ভালো আইনই তৈরি করা হোক না কেন, সংস্কার মানার মানসিকতা না থাকলে, ভালো প্রতিষ্ঠান গড়তে না পারলে কোনো কিছুই কাজে আসবে না। বছরখানেক সময় পেলে সংস্কার কাজগুলো করে যাওয়া সম্ভব।
আসিফ নজরুল বলেন, রাষ্ট্রের যত প্রতিষ্ঠান আছে, এর মধ্যে বিচার বিভাগ নিয়ে আমি সবচেয়ে বেশি মনোকষ্টে থাকতাম, খারাপ লাগত। আপনারা খেয়াল করলে দেখবেন, রাষ্ট্রের যে বেসিক তিনটি অঙ্গ আছে, এরমধ্যে আইনসভা ও শাসন বিভাগ রাজনীতি সংশ্লিষ্ট। আইনসভায় যারা আসেন তারা রাজনীতিবিদ, আবার রাজনীতিবিদরাই মন্ত্রিসভা গঠন করেন। শুধু একটি বিভাগেই আছে যেখানে সরাসরি রাজনীতি থেকে আসার সুযোগ নেই, যদি আমরা সৎ থাকি। সেটি হচ্ছে বিচার বিভাগ।
আমাদের শাসন বিভাগে মন্ত্রিসভার বা আমলার এমন কোনো দুর্নীতি অনিয়ম দুঃশাসন নেই-যেটা উচ্চ আদালত চাইলে বিচার করতে পারবেন না। উচ্চ আদালতের হাতে অসীম ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ফান্ডামেন্টাল রাইট তো বটেই, আর্টিকেল ১০২-এর অধীনে নন ফান্ডামেন্টাল বিষয়ও তাদের অনেক প্রতিকার দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। অ্যাপিলিয়েট ডিভিশনকে কমপ্লিট জাস্টিসের নামে বহু কিছু করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমরা আশ্চর্য ও বেদনার সঙ্গে দেখেছি, উচ্চ আদালতের এই ক্ষমতা ব্যবহার করা হয়েছে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসনামলকে শক্তিশালী করার জন্য, নির্যাতন যন্ত্রকে আরও নির্মম করার জন্য, সাধারণ মানুষের অধিকার হরণ করার জন্য।
সংলাপের শুরুতে জিল্লুর রহমান বলেন, ৫৩ বছরে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক হতে পারিনি। আমরা অনেক হোঁচট খেয়েছি। কখনো সামরিক শাসন, কখনো স্বৈরশাসনের মাধ্যমে। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। ৯০-এর পরেও সংস্কারের রূপকল্প তৈরি করা হয়। ২০০৭-০৮ সালেও সংস্কারের কথা উঠেছে। এখন সংস্কার শব্দটি ঘৃণিত শব্দে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠান এখন সচল নয়। প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারেনি। বিচার বিভাগ ঠিক করে কাজ করলে আমরা একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে পেতাম।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, অর্থনীতিতে সংস্কার জরুরি। লুটপাট সংস্কৃতি বদলাতে হবে। আইন প্রয়োগে নিশ্চিত করতে হবে। সংস্কার ও নির্বাচন দুটিই লাগবে। স্বাধীনতার পর আমাদের দরকার ছিল সাংস্কৃতিক সংস্কার। সাধারণ জনগণের সঙ্গে সংলাপ করতে হবে। এটি না করলে আমরা সাধারণ জনগণ থেকে আলাদা হয়ে যাব।
বিচার পাওয়া মৌলিক অধিকার। কিন্তু এর সঙ্গে অর্থের সম্পর্ক কেন আসবে? দলীয় রাজনীতির প্রভাব ও অর্থ বিত্তের প্রভাব থেকে বিচার বিভাগকে মুক্ত হতে হবে। সমাজের ভেতর থেকে বিচার ব্যবস্থা পরিচালনা করা উচিত। স্বশাসিত সংস্থার কাঠামোর ওপর জোর দিতে হবে। স্থানীয় জনগণকে ক্ষমতায়ন করতে হবে। এটি আর্থিকভাবেও হতে হবে।
অ্যাডভোকেট নিতাই রায় চৌধুরী বলেন, আমাদের দেশের সার্বভৌমত্ব থাকে জনগণের কাছে। জনগণ নির্বাচনের মাধ্যমে এটি করে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশের এই সার্বভৌমত্ব হরণ করা হয়েছে। বিগত স্বৈরাচারী সরকারের দেশপ্রেম ছিল না। আমাদের ভূমি সংস্কার দরকার। কৃষককে ভূমি দিতে হবে। গ্রামের সালিশি আদালত জোরদার করতে হবে। আমাদের ব্যাপক অর্থনৈতিক সংস্কার করতে হবে।
নিম্ন আদালতের সংস্কার করতে হবে। তদন্তকারী সংস্থাগুলোতে ভালো লোক নিয়োগ করতে হবে। রাজনৈতিক ক্ষমতা এখন চলে গিয়েছে খারাপ ব্যবসায়ীদের কাছ, এটি এখন রাজনৈতিক দলের কাছে নেই। রাজনীতি করবে রাজনৈতিক দল। মুনিরা খান বলেন, সাধারণ নাগরিক তার অধিকার বিচার বিভাগের কাছে পাবে। যারা আইনজীবী তারা রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। সবার সুস্পষ্ট আদর্শ থাকতে হবে। এটি নাগরিকরা দেখতে চায়।
ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, বিচার বিভাগে স্বচ্ছতা থাকতে হবে। বিচারিক হয়রানির ওপর গবেষণা করা উচিত। নতুন বাংলাদেশে এখনো আমরা ঢুকতে পারিনি। আমাদের সংস্কার এখনি শুরু করতে হবে। আইনজীবীদের গ্রেপ্তার ও তাদের ওপর হাত তোলা বন্ধ করতে হবে। জুডিশিয়ারিতে যারা যাচ্ছেন, তারা তাদের দলীয় পরিচয় বাদ দিয়ে নিজেদের মতো কাজ করতে পারেন। এখানে তাদের কাজের দক্ষতা দেখতে হবে। সুপ্রিম কোর্টে নারীদের সংখ্যা কম। প্রতিবন্ধীদের সুযোগ দিতে হবে। জজদের বেতন ঠিক করতে হবে। অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের বিচার পদে দিতে হবে। সিভিল জাস্টিসের ওপর নজর দিতে হবে।
ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, সামনের বাজেটে ১০০ কোটি টাকা ও ২০০০ বিচারক নিয়োগ দেন, তাহলে দেখবেন আমাদের বিচার বিভাগ ৫০ বছর এগিয়ে যাবে। আর্টিকেল ৪৮-এ যা বলা আছে, তা রাষ্ট্রপতি ১১৬ আর্টিকেলের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া করতে পারেন না। ডিস্ট্রিক্ট কোর্টের ওয়াশরুম ভালো না বা নারী স্বাস্থ্য সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। এসবের জন্য পর্যাপ্ত বাজেট দিতে হবে। ফেয়ার ও ইম্পারশিয়াল বিচার বিভাগ থাকতে হবে। মাইগ্রেশন রিলেটেড কোনো আদালত নেই। আইনজীবীদের সুরক্ষার জন্য আইন করতে হবে। মেধাবী ছাত্রদের ২০,০০০ টাকার ভাতা দিয়ে আইন পেশায় আনতে হবে। আইনজীবীদের গায়ে হাত তোলা বন্ধ করতে হবে।
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, যতই সংস্কার করা হোক না কেন মানুষের মনস্তাত্ত্বিক সংস্কার আগে করতে হবে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ মুক্ত হতে হবে। সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বললেই আদালত অবমাননার মামলা দেওয়া যাবে না। জামিনের বিষয় সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যেন না যায়। বিদ্যমান মামলা নিষ্পত্তি করার ব্যবস্থা করতে হবে।