.
এবার শীতেও কমেনি ডেঙ্গুর সংক্রমণ। অন্যান্য বছর এই সময়ে ডেঙ্গুর সংক্রমণ থাকে নি¤œমুখী। কিন্তু এবার বিপরীত চিত্র। শীত শুরুর সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গুর সংক্রমণও। শুধু নভেম্বরেই আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৩০ হাজারের বেশি। ডিসেম্বরের ২০ তারিখ পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৮ হাজারের ঘর। মোট আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ।
এর কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৃষ্টি না থাকলেও বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকা-ের কারণে নির্মাণকাজের পানি জমে থাকছে। বাসা-বাড়িতেও বিভিন্ন কারণে জমছে পানি। আর যেখানেই জমানো পানি থাকছে সেখানেই জন্ম হচ্ছে এডিসের লার্ভা। আর তাই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না ডেঙ্গুর সংক্রমণ। তাই নিজ দায়িত্বে জমানো পানি পরিষ্কার করার তাগিদ দিয়েছেন তারা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টারের ডেঙ্গুবিষয়ক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চলতি বছরের ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ৯৯ হাজার ৮৮৮ জন এবং চলতি বছরে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ৫৫৮ জনের। ডিসেম্বর মাসের ১ তারিখ থেকে ২০ তারিখ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন আট হাজার ৪১৯ জন যার মধ্যে ৭০ জন মারা গেছেন।
ডিসেম্বরের হাড় কাঁপানো শীতেও কেন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ ও অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার জনকণ্ঠকে বলেন, আমি আগেই বলেছিলাম চলতি বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরেও ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশ ব্যাপক থাকবে। আমরা প্রতিদিন এডিস মশার ঘনত্ব নিয়ে কাজ করি। আমরা দেখছি এখনো এডিস মশার ঘনত্ব কমেনি। এত সচেতনতা তৈরির পরও সাধারণ মানুষ জমানো পানি পরিষ্কার করছেন না। ফলে এডিস মশা প্রজননের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ পেয়েই যাচ্ছে। আমরা এক পরীক্ষায় দেখেছি যেখানে জমানো পানি পাওয়া যাচ্ছে সেখানেই মিলছে এডিসের লার্ভার।
তিনি বলেন, এডিস মশার ঘনত্ব যখন ২০ এর ওপরে থাকে, তখন ধরে নেওয়া হয় এডিস মশা বাড়বে। এর পাশাপাশি কোনো জায়গায় যদি ডেঙ্গু রোগী থাকে তাহলে এডিস মশা জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে। বর্তমানে আমাদের এডিস মশাও আছে আবার রোগীও আছে, দুটা বিষয় যখন একসঙ্গে থাকে তখন ডেঙ্গু বাড়বে এবং সেটা থাকবে। এ কারণেই আমরা আগেই বলেছিলাম এবার নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে ডেঙ্গু বেশ ভালো আকারে থাকবে। চলতি বছরের নভেম্বরে আমরা ডেঙ্গুর যে ভয়াবহ চিত্র দেখলাম এর আগে বাংলাদেশে তা কখনই হয়নি। ডিসেম্বরেও এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে।
ড. কবিরুল বলেন, ডেঙ্গু একটি মশাবাহিত প্রতিরোধযোগ্য রোগ। তবে এর জন্য মশার প্রজনন যেন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত উড়ন্ত মশাগুলোকে মারার ব্যবস্থা করতে হবে এবং কেউ যদি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়, তাকে পরীক্ষার মাধ্যমে ডেঙ্গু নিশ্চিত হলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের অনেকগুলো ব্যবস্থার কথা আমি বলেছিলাম। কিন্তু এখন না শুধু কখনোই আমাদের কথা কেউ শোনেনি। সরকার পরিবর্তনেরও মশা নিধন কার্যক্রমে বড় একটা ধাক্কা লেগেছে। তাই সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতন হতে হবে বলে আমি মনে করি। তবে সরকারের চাইতে ডেঙ্গু প্রতিরোধে ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতনতা জরুরি বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়াতে পারলে একজনও মারা যেতো না। প্রতিদিন ডেঙ্গুতে লোক মারা যাচ্ছে। ডেঙ্গুতে কি লোক মারা যাওয়ার কথা ছিল, একদমই ছিল না। আমরা যদি সচেতনতা বাড়াতে পারতাম, যেসব জায়গায় ডেঙ্গুর লার্ভা হচ্ছে সেগুলো যদি মূলোৎপাটন করতাম তাহলে ডেঙ্গুতে একজন মানুষও মারা যেত না। কিন্তু কে কার কথা শুনছে। তিনি বলেন, আমাদের সবার দায়িত্ব আছে, আমরা সবাই মিলে যদি একসঙ্গে কাজ করি, তাহলে আমরা অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারবো। এই বিশ্বাস আমার আছে, বাঙালি অনেক বার দেখিয়েছে। বিশেষ করে আমাদের ছাত্র এবং কর্মজীবী মানুষেরা, আমরা তাদের যদি কাজে লাগাতে পারি, অনেক কিছুই করতে পারব।
সংক্রমণ কেন বেড়ে চলেছে প্রশ্নে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধের যে স্তরগুলো রয়েছে তার প্রথম ধাপ হচ্ছে এডিস মশা নির্মূল বা নিয়ন্ত্রণ। দেশব্যাপী এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত কোনো কার্যক্রম বা পরিকল্পনা শুরু থেকে এখন পর্যন্ত গ্রহণ করা হয়নি। ফলে মশা মারার যে কার্যক্রম সেটি কখনোই শুরু হয়নি। কিছু কিছু স্থানভিত্তিক মশা মারার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। কিন্তু মশা মারতে সাধারণ মানুষ স্বেচ্ছাসেবক, সরকারি বেসরকারি কর্মকর্তা, স্থানীয় পরিষদের লোকজনসহ সবাইকে যুক্ত করাও হয়নি। মানুষ তার বাড়িঘরে কীভাবে এডিস মশার প্রজনন নিয়ন্ত্রণ করবে, হাতে কলমে সেটা শেখানোর কোনো উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ, সেটাও আমরা দেখিনি। এর আগে যে ওষুধগুলো ব্যবহার হয়েছে, সেগুলো খেয়ে মশা মারা যায়নি। এই সুযোগে ডেঙ্গু সারা দেশে ছড়িয়ে গিয়েছে। সারাদেশে ডেঙ্গুর হটস্পট ম্যানেজমেন্টও দেখা যায়নি। ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন দেওয়ার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় নাই। অন্যদিকে এডিস মশার বিষয়েও কোনো গবেষণাও আমরা করছি না। আমরা দেশে ডেঙ্গুর টিকা আবিষ্কারের কোনো কার্যক্রম শুরু করি নাই। এসব কারণেই মশা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। আর তাই দিন দিন ডেঙ্গুর সংক্রমণ বেড়েই চলেছে।
তিনি বলেন, ডেঙ্গুর সাম্প্রতিক ধরণ দেখে সারাবছরই এখন ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকবে বলে মনে হয়। এখন আর ডেঙ্গু একেবারে শূন্য হয়ে যাবে না, প্রতিদিন ডেঙ্গু কেস পাওয়া যাবে। এখন থেকে আমাদের ডেঙ্গুকে বছরব্যাপী রোগ হিসেবে বিবেচনা করে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি শীতকালে যেসব জায়গায় ডেঙ্গুর প্রজনন হয়, সেই সব স্থানকে টার্গেট করে এডিস নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সাজাতে হবে।
এদিকে ডেঙ্গুর তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে রোগীদের ভীড়। মুºা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ডিএনসিসি কোভিড হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালসহ প্রায় সবগুলো সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের ভিড়ে তিল ধারণের জায়গা নেই। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সিট না পেয়ে অনেক রোগী মেঝে, বাথরুমের সামনে ফাঁকা জায়গা এমনকি সিঁড়ির সামনের খালি জায়গাতেও ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। সরেজমিনে রাজধানীর হাসপাতালগুলো ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ড রোগীতে পরিপূর্ণ। এমনকি অন্যান্য ওয়ার্ডেও রোগী ভর্তি করতে হচ্ছে।
দেশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় গত জুলাই মাসে ২০ শয্যার ডেডিকেডেট ডেঙ্গু ইউনিট গঠন করে ঢাকা মেডিকেলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালটির নতুন ভবনের চার তলায় ডেঙ্গু ওয়ার্ডে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ভেতরে ঢোকার রাস্তা থেকে শুরু করে ওয়ার্ডের ভেতর পর্যন্ত রোগীতে ভরপুর। ওয়ার্ডটিতে শুধু পুরুষ রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে, যাদের অধিকাংশই হাসপাতালের মেঝেতে শুয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এছাড়া, ডেঙ্গু আক্রান্ত নারী রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে একই ভবনের ৮ তলায় মেডিসিন বিভাগে। সেখানে অন্যা রোগীদেরও চিকিৎসা চলছে।
তুলনামুলকভাবে কম রোগী থাকলেও ডিএনসিসির কোভিড হাসপাতালেও ভিড় করছেন রোগীরা। এ কয়দিনে রোগী এত বেড়েছে যে এখানকার চিকিৎসকরা রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। ডিএনসিসি কোভিড হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা এক রোগীর স্বজন বলেন, আমার রোগীর শুরুতে টানা ৩/৪ দিন জ্বর ছিল। এর পর ইবনে সিনা মেডিক্যালে পরীক্ষা করার পর সেখানে ডেঙ্গু পজিটিভ আসে। তখন তার প্লাটিলেট ছিল এক লাখ ২২ হাজার। তার পর আরও দুই দিন বাসায় রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। পরে হঠাৎ করেই জ্বরের সঙ্গে বমি-পাতলা পায়খানা শুরু হয়। এক পর্যায়ে শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যাওয়ায় দ্রুত এখানে নিয়ে আসি। এখন আমার রোগী আগের তুলনায় অনেকটা ভালো। তিনি বলেন, নতুন করে আবার ডাক্তার পরীক্ষা দিয়েছে, পরীক্ষা করে দেখি কী অবস্থা। যদি দেখি অবস্থা ভালো, তাহলে ছুটি নিয়ে বাসায় চলে যাব।
কর্তব্যরত এক চিকিৎসকের কাছে এ বছর ডেঙ্গু রোগীদের উপসর্গ কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, অন্যান্য সময়ের মতোই এবারের উপসর্গ হলো, প্রচুর জ্বর। যা টানা ৩/৪ দিন থাকছে। এরপরই ডেঞ্জার পিরিয়ডে চলে যাচ্ছে। তখন শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দেয়, ইন্টার্নাল ব্লিডিং শুরু হয়, নারীদের ক্ষেত্রে মাসিকের রাস্তা দিয়ে ব্লিডিং হয়। সেই সঙ্গে বমি, পেট ব্যথা, পাতলা পায়খানা দেখা যায়। এসব রোগী নিয়ে পরীক্ষা করলেই ডেঙ্গু পজিটিভ আসছে। এমনকি ওই অবস্থায় অনেকের প্লাটিলেট ১০/২০ হাজারেও নেমে যায়। বছরজুড়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ অব্যাহত থাকার কারণ সম্পর্কে কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, বর্ষা মৌসুম শেষেও যেখানেই পানি জমছে, সেখানেই এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে। এমন কিছু জায়গায় এডিস মশা বংশ বিস্তার করছে, যেখানে বৃষ্টির পানি জমার কোন সম্ভাবনা নেই। এর মধ্যে রয়েছে বহুতল ভবনের পার্কিংয়ের জায়গা, নির্মাণাধীন ভবনের বেজমেন্ট, বাসাবাড়িতে জমিয়ে রাখা পানি ইত্যাদি। তারা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন এবং ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোরে কার্যক্রমের যথেষ্ট ঘাটতির ফলে শীতকালেও ডেঙ্গু সংক্রমণ এবং মৃত্যু হচ্ছে।