জুলাই-আগস্টে নিরস্ত্র ছাত্রজনতার উপর স্বৈরাচার শেখ হাসিনার নির্দেশে প্রায় দুই হাজার মানুষকে হত্যা ও পঁচিশ হাজার মানুষকে পঙ্গু করার অভিযোগে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ও দলটির নিবন্ধন বাতিলে জোরালো দাবী উঠেছে। খুনের নির্দেশদাতা হিসেবে দলটির নিষিদ্ধ নিয়ে রাজনীতিতে মতানৈক্য থাকলেও যাদের নেতৃত্বে বিপ্লব সংগঠিত হয়েছে এবং ৩৬ জুলাইয়ে যারা স্বজন হারিয়েছেন তারা কেউ আওয়ামী লীগের রাজনীতি নতুন বাংলাদেশে দেখতে চান না। জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালও। এ নিয়ে সরকারের ভেতরেও চাপ তৈরি হয়েছে। জুলাইয়ে শেখ হাসিনা উৎখাতে আন্দোলনের অগ্রভাগে থাকা শিক্ষার্থী এবং শহীদ পরিবার থেকেও আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ এবং নিবন্ধন বাতিলে হুশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি দেশে গুপ্ত হত্যা ও টার্গেট কিলিংয়ে মহাতঙ্ক শুরু হয়েছে। ছাত্রনেতাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মহল এবং গোয়েন্দা সংস্থা পক্ষ থেকেও ধারনা করা হচ্ছে এর পেছনে আওয়ামী লীগ জড়িত রয়েছে। ওয়ার্ড ভিত্তিক স্থানীয় নেতারা এসব হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে বলে অভিযোগ এসেছে। তাই রাজনৈতিক দলমত সবার ঐক্যমতে আওয়ামী লীগকে দ্রুত নিষিদ্ধ চাচ্ছে দেশের নাগরিকদের বড় অংশ। ছাত্রসমাজ, নাগরিক সমাজের অনেকেই সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে গুপ্ত হত্যার পেছনে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলেছেন।
সম্প্রতি সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে এখনো ছাত্রলীগ-যুবলীগের সন্ত্রাসীরা নানা ধরনের উসকানিমূলক প্রচারণা করছে। এ ছাড়া গণহত্যার সঙ্গে জড়িত যুবলীগ-ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের এখনো গ্রেপ্তার করা হয়নি। ফলে তারা এখনও গুপ্ত হত্যার পরিকল্পনা করছে।
এদিকে গতকাল রোববার কাকরাইল মোড়ে শুয়ে ইনকিলাব মঞ্চের নেতাকর্মীরা তিন দফা জানিয়েছেন। সেখানে বলা হয়েছে ১. গণহত্যাকারী দল আওয়ামী লীগের নিবন্ধন দ্রুত বাতিল করতে হবে। ২. সন্ত্রাসী আওয়ামী লীগের গুপ্ত হত্যা থেকে দেশপ্রেমিক ছাত্রজনতাকে বাঁচাতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে ইউনিয়ন পর্যন্ত কমিটিতে থাকা সব সন্ত্রাসীকে দ্রুত গ্রেপ্তার করতে হবে। ৩. প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব জুলাই-যোদ্ধাদের জীবনের সম্পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সংগঠনটির মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি বলেন, আমরা বর্তমান সরকারকে ৭ দিন সময় দিচ্ছি। এর মধ্যে আমাদের তিন দফা দাবি আদায়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে আগামী ২৯ ডিসেম্বর দুপুর ১টায় আমরা সচিবালয় ঘেরাও অবস্থান কর্মসূচি পালন করব।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১২ ডিসেম্বর ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির সাবেক শিক্ষার্থী তাজবির হোসেন শিহানকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে। আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের (এআইইউবি) শিক্ষার্থী মো. ওয়াজেদ সীমান্ত দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে জখম হয়ে ১৪ ডিসেম্বর ঢাকা মেডিকেলে মারা যান। ১৮ ডিসেম্বর পূর্বাচলের লেক থেকে শিক্ষার্থী সুজানা আক্তার (১৭) ও সাইনুর রশিদ কাব্য (১৬) নামে দু’জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। একই দিন চট্টগ্রামে জসিম উদ্দিন নামে আন্দোলনে যুক্ত আরেক শিক্ষার্থী হত্যার শিকার হন। এসব হত্যাকাণ্ডে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা যুক্ত রয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন।
জানতে চাইলে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদি জনকন্ঠকে বলেন,আমরা বলছি, বাংলাদেশে দুই হাজার শহীদ এবং প্রায় ২৫ হাজার মানুষকে আহতে আওয়ামী লীগ জড়িত। যতক্ষণ পর্যন্ত দুই হাজার শহীদ হত্যাকাণ্ডের বিচার শেষ না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল থাকবে। যেদিন হত্যাকাণ্ডের বিচার শেষ হবে তখন যদি চব্বিশের বিজয়ের মসনদের মালিক শহীদ পরিবার এবং দেশের জনগণ মনে করে তখন তারা নিবন্ধন পেতে পারে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে পারে। তার আগে এই দলটির নিবন্ধন বাতিল থাকা উচিৎ।
নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য জয়নাল আবেদীন শিশির জনকন্ঠকে বলেন," স্বৈরাচার শেখ হাসিনা বাংলাদেশে নিকৃষ্ট ফ্যাসিজম কায়েম করেছে। দেড়যুগের বেশী সময় এ দেশের তরুণ সমাজ ভোট দিতে পারেনি। যে তরুণরা হাসিনার উপর ক্ষুব্ধ ছিলো তিনি তাদের জুলাইয়ে পাখির মতো গুলি করে খুন করার নির্দেশ দিয়েছেন। তার নির্দেশে প্রায় দুই হাজার মানুষ শহীদ হয়েছেন। আহত হয়ে পঙ্গুত্ব জীবণ লড়াই করছেন প্রায় ২৫ হাজার তিনি আরও বলেন, ছাত্রজনতার আন্দোলনে হাসিনা পালিয়ে গেলেও তার অনুগতরা এখনো দেশে রয়ে গেছেন। বাংলাদেশের মাটিতে তাদের রাজনীতি করার অধিকার নেই। স্বৈরাচার হাসিনার অনুগতরা প্রথমে নামে বেনামে বিভিন্ন কর্মসূচী দিয়ে
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেছেন, আওয়ামী পুনর্বাসনের জন্য যারা উদ্যোগ নেবে, তাদেরকে ইতিহাস গণশত্রু হিসেবে চিহ্নিত করবে।"জুলাই অভ্যুত্থানের স্পিরিটকে যারা ধারণ করে,... তারা ২৪ পরবর্তী বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের বিচার নিশ্চিত করার দাবি ছাড়া আওয়ামী লীগ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আর কোনো দ্বিতীয় বক্তব্য দিতে পারে না।
বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা বলেছেন, আওয়ামী লীগ পুনর্বাসন করতে হলে আমাদের লাশের উপর দিয়ে করতে হবে। যতদিন এই দলটির ছাত্রজনতার হত্যাকাণ্ডের বিচার না হবে ততদিন এই দলটির রাজনীতি করার অধিকার দেওয়া উচিৎ হবে না। যারা তাদের পুনর্বাসন করতে চেষ্টা করবে তাদের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন করা হবে বলেও জানান তিনি।
অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, আওয়ামী লীগ ফ্যাসিজম ও গণহত্যার সঙ্গে জড়িত। তার বিচার কার্যক্রম এখনও চলছে। দল হিসেবে তাদের রাজনীতি করার অধিকার নেই।সব রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হলেই আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হবে।’
মিরপুরে নিহত শহীদ মো. সিফাতের পিতা কামাল হাওয়ালাদার জনকন্ঠকে বলেন, আমার ছেলেকে মিরপুরের আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা নির্দয়ভাবে গুলি করে খুন করেছে। আমি যখন আমার সন্তানের লাশ হাতে নিই তখন আমার সন্তানের মাথার মগজ আমার হাতের মধ্যে পড়ে যায়। যে আওয়ামী লীগ আমার ছেলেকে এভাবে নির্দয়ভাবে খুন করেছে আমি তাদের বিচার দেখতে চাই। আমি চাই তারা যেন এই দেশে আর রাজনীতি করতে না পারে, নির্বাচন করতে না পারে। এই আওমী লীগ যদি আবার রাজনীতি করার সুযোগ পায় , ভোতে যায় তাহলে আমার সন্তানদের আত্মা শান্তি পাবে না।
ফুয়াদ