তদন্ত কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে বিগত দেড় দশকের আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে গুম ও হত্যার ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। এতে গুমের পর নির্যাতনের বিভীষিকাময় বর্ণনা এবং হত্যার পর লাশ গুম করার পদ্ধতির বিবরণ উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাধারণত সাদা পোশাকে ভুক্তভোগীদের তুলে নেয়া হতো এবং নিজেদের পরিচয় গোপন করার জন্য এক সংস্থা আরেক সংস্থার নাম ব্যবহার করতো বলেও অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে। গুমের পর বেশিরভাগ ভুক্তভোগীকে হত্যা করা হতো। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাথায় গুলি করে হত্যা এবং লাশ নদীতে ফেলা হতো। বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদীতে সিমেন্টের বস্তায় বেঁধে লাশ ফেলার জন্য পোস্তগোলা ও কাঞ্চন ব্রিজ ব্যবহার করা হতো।কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, অনেক সময় লাশ রেললাইনে রেখে ট্রেনে কাটা যাওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হতো।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, গুম, হত্যা ও লাশ নিশ্চিহ্ন করার প্রক্রিয়াগুলো সমন্বিতভাবে পরিচালিত হতো। এতে বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে সমন্বয়ের বিষয়টি স্পষ্ট হয়। এই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত এবং দায়ীদের বিচারের আওতায় আনতে বড় পরিসরের পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে।
আটক করার পর ভুক্তভোগীদের সাধারণত গোপন অন্ধকার কক্ষে রাখা হতো এবং সেখানেই তাদের ওপর নানা ধরনের নির্যাতন চালানো হতো বলে অভিযোগ করেছে কমিশন।
এমন কয়েকজন ভুক্তভোগীর সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে কমিশন বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে এমন আটটি গোপন কারাগারের সন্ধান পাওয়ার কথা জানিয়েছে। যেগুলো ডিজিএফআই, র্যাব, কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) পরিচালনা করতো।
প্রতিবেদনে কয়েকটি মর্মান্তিক ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে। এক ঘটনায় ধানমন্ডি এলাকা থেকে এক তরুণকে ধরে নিয়ে কোনো সংজ্ঞাহীন ওষুধ ছাড়াই তার ঠোঁট সেলাই করে দেওয়া হয়। অন্য এক ঘটনায় এক ব্যক্তিকে আটক করে তার যৌনাঙ্গ ও কানে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়। আরেক ঘটনায়, নদীতে লাফিয়ে পালানোর চেষ্টা করা এক ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়।
গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি), সিটিটিসি, র্যাব ও ডিজিএফআই-এর গোপন বন্দিশালায় নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র প্রকাশ পেয়েছে। এসব বন্দিশালায় নির্যাতনের জন্য বিশেষ যন্ত্র ব্যবহার করা হতো। কমিশন জানিয়েছে, গোপন বন্দিশালার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য চূড়ান্ত প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হবে।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, নির্যাতন, হত্যা এবং লাশ গুমের ক্ষেত্রে বাহিনীগুলোর মধ্যে সমন্বিত পরিকল্পনা কাজ করতো। এই ঘটনায় সামগ্রিক তদন্তের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘গুম কমিশনের প্রতিবেদন লোমহর্ষক। মানুষ মানুষের প্রতি কী পরিমাণ নৃশংস হতে পারে, এতে আছে তার বিবরণ। অবিশ্বাস্য বর্ণনা!
কমিশনের প্রতিবেদনে এসব ঘটনার নৃশংসতা ও গভীরতাকে বিবেচনায় নিয়ে ভবিষ্যতে গুম, নির্যাতন ও হত্যার এমন ‘সংস্কৃতি’ রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশে গুমের ঘটনায় ভারতের সম্পৃক্ততা খুঁজে পেয়েছে তদন্ত কমিশন। দুই দেশের মধ্যে বন্দি বিনিময়ের কার্যক্রম এবং আটক ব্যক্তিদের সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য তুলে ধরতে গিয়ে কমিশন তাদের প্রতিবেদনে জানায়, ‘বাংলাদেশে গুমের ঘটনায় ভারতের সম্পৃক্ততা জনসমক্ষে একটি আলোচিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
নাহিদা