বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় এক হাতে ক্রিকেট খেলার একটি স্ট্যাম্প নিয়ে দুই হাত প্রসারিত করে গুলির সামনে বুক পেতে দিয়েছিলেন আবু সাঈদ। অবিশ্বাস্য সাহসী এই যুবকের সুমহান আত্মত্যাগের পথ ধরেই এই দ্বিতীয় স্বাধীনতা। যে বীর মুক্তিসেনার বীরত্বে অনুপ্রাণিত হয়েই ছাত্র-জনতার এই অভ্যুত্থান। কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম এই সমন্বয়ককে জাতীয় বীরের মর্যাদা দেয়া উচিত। যার দেহ ঝাঝরা হলেও আন্দোলন স্ফুলিঙ্গের মত পুরো দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ে। দেশজুড়ে প্রাণের বিচ্ছুরণ ঘটায়ে যিনি হয়েছেন দ্বিতীয় মুক্তিসংগ্রামের মহানায়ক।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রথম শহীদ আবু সাঈদ। টগবগে তরুণ মেধাবী এই বীরযোদ্ধা রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার ফলের অপেক্ষায় থাকা সাঈদ ফলাফল প্রকাশের আগেই পেয়ে গেছে অমরত্বের সনদ। সাঈদ শুধু সময়ের অংশ হয়ে থাকবে না, দ্বিতীয় স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসের একটি প্রতিবাদী চরিত্র হয়ে আজীবন থাকবে। শহীদেরা কখনো মরে না, আবু সাঈদও মৃত্যুঞ্জয়ী, কখনো মরবে না, লাখো-কোটি মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন কর্মের মধ্য দিয়ে।
আবু সাঈদ রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার মদনখালী ইউনিয়নের বাবনপুর গ্রামের জাফরপাড়ার মকবুল হোসেনের ছোট ছেলে। বাবা মকবুল হোসেন, মা মনোয়ারা বেগম, ছোট বোন সুমি খাতুন। মা-বাবার ৯ সন্তানের মধ্যে একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া সন্তান ছিলেন তিনি। তাকে ঘিরে তার এলাকার মানুষ স্বপ্ন দেখতেন। বিক্ষোভে যখন গুলির মুখে সবাই পিছু হটেছিল নির্ভীক আবু সাঈদ তখন বুলেটের মুখে বুক পেতে দিয়ে বিপ্লবের প্রতীক হয়ে ওঠেন। বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সমগ্র বাংলাদেশকে জাগ্রত করেছেন এবং ভবিষ্যতেও করবেন তিনি।
রক্তাক্ত জুলাইয়ের ১৬ তারিখে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেটে আন্দোলন আর দ্রোহকাব্যের এই রচয়িতাকে গুলি করেন এক পুলিশ সদস্য। সে ছিল মেধাবী ও সৎ। মানুষের উপকার করতো। খুবই পরোপকারী ছিলেন। বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়াতেন। নিজে প্রাইভেট পড়ে গ্রামের ছেলেদের বই কিনে দিতেন। বড় হয়ে অনেক বড় সৎ অফিসার হবার স্বপ্ন ছিল তাঁর। সেই স্বপ্নপূরণ না হলেও গোটা জাতির ঘুম ভেঙে দিয়েছেন তিনি। ফলে একজন জীবিত আবু সাঈদের চেয়েও মৃত আবু সাঈদ লক্ষকোটি গুন বেশি শক্তিশালী।
‘অন্তত একজন শামসুজ্জোহা হয়ে মরে যাওয়াটা অনেক বেশি আনন্দের, সম্মানের আর গর্বের।’ শামসুজ্জোহা স্যারকে স্মরণ করে সামাজিকমাধ্যমে এভাবেই পোস্ট দিয়েছিলেন রংপুরের গর্বিত সন্তান শহীদ আবু সাঈদ। যার বিদায় দৃশ্যে স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল আন্দোলন। তিনি শিক্ষার্থীদের বিজয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছেন। জনতার কাছে পেয়েছেন বীরের মর্যাদা। রক্ত আর অশ্রুর স্রোতে দুঃশাসনের অবসান ঘটেছে।
দেশবাসীর দাবি আবু সাঈদ হত্যার নিরপেক্ষ তদন্ত করা হোক, উপযুক্ত বিচার করা হোক। বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সকল শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী এই হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিলেন তাঁদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হোক। আবু সাঈদের পরিবারকে মাসিক ১ লাখ টাকা করে দেয়া হোক, বুয়েট যেমন আবরারের পরিবারকে দিচ্ছে। আবু সাইদের নামে ছাত্রদের হল বা স্থাপত্য নির্মাণ করা হোক। আবু সাঈদকে হত্যাকারী বাহিনীর পুনর্গঠন করা হোক। যে ছাত্র সংগঠনের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়েছিল তাঁদের রাজনীতি ক্যাম্পাসগুলোতে নিষিদ্ধ করা হোক।
যে সাঈদ তার সহযোদ্ধা-সহপাঠি আর সমন্বয়কদের মাঝে নতুন স্পৃহা জাগিয়েছেন। তার প্রাণ উৎসর্গের দিন ১৬ জুলাইকে শহীদ দিবস ও সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হোক। সাঈদকে মেধা যোদ্ধার বীর খেতাবে ভূষিত করা হোক। সাঈদের আত্মত্যাগের মর্যাদা রাষ্ট্রকেই রক্ষা করতে হবে। তাকে এমনভাবে স্মরণীয় করে রাখা দরকার, যাতে তার স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে নতুন প্রজন্ম নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন পূরণ করতে পারে।
আবু সাঈদের প্রতি ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা এবং বিনম্র শ্রদ্ধা। তাঁর রত্মগর্ভা মা ও গর্বিত বাবার প্রতিও সালাম।
লোখকঃ কলামিস্ট ও কো-অর্ডিনেটর বিআইআইটি, উত্তরা, ঢাকা