ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

সারাদেশে সক্রিয় দালাল চক্র

গাড়ি না দেখেই ফিটনেস সনদ, চলছে রমরমা ঘুষ বাণিজ্য

আজাদ সুলায়মান

প্রকাশিত: ২২:৩১, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪

গাড়ি না দেখেই ফিটনেস সনদ, চলছে রমরমা ঘুষ বাণিজ্য

.

গাড়ির ফিটনেস সনদ দেওয়ার প্রধান শর্তই হচ্ছে- গাড়ি চোখের সামনে রেখে ভালো  করে দেখে পর্যবেক্ষণ করা। এই নিয়ম রাজধানীর চারটি সার্কেলে মানা হলেও সারাদেশে তা লঙ্ঘিত হচ্ছে প্রকাশ্যেই। গাড়ি না দেখে শুধু ঘুষের বিনিময়ে দেওয়া হচ্ছে ফিটনেস সনদ। এতে অনেক আনফিট গাড়িও পেয়ে যাচ্ছে সনদ। পরিণামে সড়কে বাড়ছে দুর্ঘটনা।
জানা গেছে, রাজধানীর চারটি সার্কেলে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডেন্টিফিকেশন ডিভাইস (আরএফআইডি) চালু হওয়ার পর থেকে শতভাগ নিয়ম মেনেই ফিটনেস দেওয়া হচ্ছে। গ্রাহকদের কাছ থেকে ঘুষ নেওয়া ঠেকানোর জন্য ঢাকা  মেট্রো এলাকার
চারটি সার্কেল অফিস পাইলট প্রকল্প হিসেবে গত ৭ জুলাই অটো এই ডিভাইস চালু করেছে বিআরটিএ।  মিরপুর, ইকুরিয়া, উত্তরা ও পূর্বাচল  কার্যালয়ে আরএফআইডি স্ক্যানিয়েংর মাধ্যমে ফিটনেস প্রদানের কার্যক্রম শুরু করায় বন্ধ হয়েছে ঘুষ বাণিজ্য। এতে ফিটনেস সনদ নিতে গাড়ির উপস্থিতি শতভাগ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু ঢাকার বাইরে আরএফআইডি না থাকায় চলছে রমরমা ঘুষ বাণিজ্য। সম্প্রতি মুন্সীগঞ্জ, সিলেট, কুমিল্লা, ফরিদপুর, খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, রাজশাহী, বগুড়া ও দিনাজপুরসহ বেশ কয়েকটি জেলা সার্কেল অফিসের গ্রাহকদের কাছ থেকে পাওয়া অভিযোগে জানা গেছে, পরিদর্শকরা প্রকাশ্য অনিয়ম করলেও কেউ দেখার নেই। এসব সার্কেলে গাড়ি না দেখেই ফিটনেস সনদ দেওয়া হচ্ছে।  আবার হাতেনাতে যাতে না ধরা যায়, সেজন্য তারা ব্যবহার করছে আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স (এআই)। এতে গাড়ি না দেখে শুধু গাড়ির ছবি আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স সফটওয়্যারের মাধ্যমে এডিট করে রাখা হয়। এ পদ্ধতিতে তিন থেকে ছয় হাজার টাকা ঘুষের বিনিময় দেওয়া হচ্ছে যানবাহনের ফিটনেস সার্টিফিকেট।
বিআরটিএ সূত্র জানায়, বর্তমানে সারাদেশের যানবাহন পরিদর্শনের জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট সিস্টেম চালু রয়েছে। শুধু ঢাকা  মেট্রো সার্কেল-১, ২, ৩ ও ৪ (মিরপুর, ইকুরিয়া, উত্তরা ও পূর্বাচল) অফিসে চালু রয়েছে আরএফআইডি সিস্টেম। এতে এসব কেন্দ্রে বন্ধ হয়েছে ঘুষ বাণিজ্য ও হয়রানি।  ভুক্তভোগীদের মতে, সারাদেশের সার্কেল অফিসে এই স্ক্যানিং পদ্ধতি চালু থাকলে কোনো সার্কেল  থেকেই ঘুষের বিনিময়ে গাড়ি না  দেখে ফিটনেস সনদ দেওয়া সম্ভব হতো না।
ঢাকাসহ কয়েকটি জেলা সার্কেলে সরেজমিন পরিদর্শনে উঠে আসে নানান অনিয়মের তথ্য। মিরপুর এলাকার আসলাম, রাজু, জহির, রনিসহ ১০/১২ জনের একটি দালাল চক্র রয়েছে। ওরা টাকার বিনিময় বিভিন্ন কোম্পানির গাড়ি না দেখিয়েই ফিটনেস করিয়ে দেন। তবে তারা এখন ঢাকায় এভাবে কাজ করতে না পেরে ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে গিয়ে আগের মতোই শুরু করেছে। এ চক্রটিই সারাদেশে সক্রিয়।
বিআরটিএ অফিসে আগত ভুক্তভোগীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, গত ১১ ডিসেম্বর বিআরটিএ মুন্সীগঞ্জ সার্কেল থেকে ১৪৮টি মোটরযানের ফিটনেস সনদ দেওয়া হয়। এর অধিকাংশই ছিল ভারি যানবাহন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেদিন মাত্র ৩৯টি গাড়ি সেখানে আনা হয়েছিল। বাকিগুলো না দেখেই ঘুষের বিনিময় ফিটনেস দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে মুন্সীগঞ্জ সার্কেলের অভিযুক্ত  মোটরযান পরিদর্শক মো. সাখাওয়াত  হোসেনের কাছে ফোন করা হলে তিনি সাড়া দেননি।
একইভাবে বিআরটিএ কুষ্টিয়া সার্কেল  থেকে গত ১১ ডিসেম্বর ৬৯টি  মোটরযানের  ফিটনেস সনদ  দেওয়া হয়। অথচ সেদনি মাত্র ৩৪টি গাড়ি সেখানে আনা হয়েছিল। বাকিগুলো দেওয়া হয়েছে ঘুষের বিনিময়ে। এ প্রসঙ্গে এক গাড়ির মালিকের অভিযোগ, এ সার্কেলের মোটরযান পরিদর্শক  মো. কুতুব উদ্দিন কুষ্টিয়া অফিসে  যোগদানের পর  থেকেই গাড়ি অনুপস্থিত রেখেই ফিটনেস সনদ দেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে।
জানতে চাইলে কুতুব উদ্দিন বলেন, ঘুষের বিনিময়ে ফিটনেস দেওয়ার অভিযোগ ঠিক নয়। তবে কুষ্টিয়া একটা শিল্প এলাকা। এখানে এমনিতেই এখন গাড়ির চাপ বাড়ছে। হয়তো মাঝে মাঝে দু’একটা না দেখেও দেওয়া হয়ে থাকতে পারে।
কুষ্টিয়ার মতোই ঝিনাইদহ সার্কেলেও চলছে গাড়ি না দেখে সনদ প্রদানের বাণিজ্য। একইভাবে বিআরটিএ ঝিনাইদহ সার্কেল  থেকে গত ১১ ডিসেম্বর ৭৯টি  মোটরযানের ফিটনেস  দেওয়া হয়।  এর মধ্যে মাত্র ২০/২৫টি যানবাহন সেখানে আনা হয়েছিল। বাকিগুলো না দেখেই শুধু এডিট করা ছবি তুলে রেখে ফিটনেস দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে ঝিনাইদহ সার্কেলের মোটরযান পরিদর্শক তারিক হাসান বলেন, বর্তমান চেয়ারম্যান খুব কড়া। আনসিন (না দেখে) ফিটনেস দেওয়া সম্ভব নয়। ভুলে দুই একটা হয়ে থাকতে পারে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরটিএর একজন কর্মকর্তা  নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সঠিকভাবে গাড়ি হাজির করে ফিটনেস সনদ দিতে হলে দেশের প্রতিটি  জেলা সার্কেল অফিসকে আরএফআইডি স্ক্যানিংয়ের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে। তা না হলে সুফল আসবে না।
তিনি বলেন, ঢাকার সার্কেলগুলোতে আরএফআইডি স্ক্যানিং বাধ্যতামূলক হওয়ায়  শতভাগ গাড়ি হাজির নিশ্চিত করে ফিটনেস সনদ দিতে হচ্ছে। ফলে মোটরযান পরিদর্শক চাইলেও আনসিন ফিটনেস দেওয়ার কোনো সুযোগ  নেই। একইভাবে সারাদেশের সার্কেলগুলোকে আরএফআইডি স্ক্যানিং মেশিনের আওতায় আনতে হবে।
এ প্রসঙ্গে মুন্সীগঞ্জের অফিসে যাওয়া ভুক্তভোগীদের অভিযোগ হচ্ছে, এখানে গাড়ি না দেখেই প্রতিটি সনদের জন্য ৫/৬ হাজার টাকা করে নিচ্ছে। টাকা দিলেই গাড়ি আনা লাগে না। যেখানে দৈনিক গড়ে ২০টা গাড়িও আসে না, সেটার ভিডিও তো আশপাশের সিসিটিভিতেই রয়েছে। অথচ এখানে প্রতিদিন শতাধিক গাড়ির ফিটনেস দেওয়া হচ্ছে। আবার এদের এই অপকর্ম যদি হেড অফিসের কেউ দেখতে চান, তখন এখানকার পরিদর্শক আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সফটওয়্যার টেকনোলজির মাধ্যমে ছবি এডিট করে গাড়ির সঙ্গে লাগিয়ে দেওয়া হয়। কর্তৃপক্ষ বিষয়টি তদন্ত করলে অভিযোগের সত্যতা মিলবে।
জানতে চাইলে বিআরটিএর পরিচালক প্রশাসন মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, আরএফআইডি দেখার জন্য আলাদা একটা বিভাগ রয়েছে। উপপরিচালক ফারুক আহমদ এ বিষয়টি দেখভাল করছেন। তার সঙ্গে কথা বললে বিস্তারিত জানা যাবে। তবে আমরা পর্যায়ক্রমে সব জোনেই আরএফআইডি সিস্টেম চালুর উদ্যোগ নিয়েছি।
গাড়ি না দেখে না ফিটনেস দেওয়াটা কতটা গুরুতর অনিয়ম জানতে চাইলে কামরুল ইসলাম  চৌধুরী বলেন, আমার কাছে এখনো এ ধরনের অভিযোগ আসেনি। কেউ যদি সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ করে তবে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানতে চাইলে উপপরিচালক ফারুক আহমদ বলেন, ফিটনেস সনদ গ্রহণের অন্যতম শর্তই হচ্ছে গাড়ি সামনে এনে ইন্সপেকশন করতে হবে। ভালো করে চোখে দেখে সেটার ছবিও নিজের সঙ্গে সেলফির মতো করে তুলে ডকুমেন্টও রাখতে হবে। কিন্তু অভিযোগ অনুযায়ী যদি গাড়ি না দেখেই সনদ দেওয়া হয়, সেটা বড় ধরনের অপরাধ ও অন্যায়। এমন অভিযোগ পাওয়া গেলে তদন্ত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

×