.
মাসুদুর রহমান প্রায় ১৩ বছর ধরে র্যাব সদস্য সেজে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিল। সারাক্ষণ তার হাতে থাকত পিস্তল ও ওয়াকিটকি। ধনাঢ্য ব্যক্তি ও ব্যবসায়ীদের বাসায় র্যাব পরিচয়ে করত ডাকাতি। বিভিন্ন মালবাহী গাড়ি, গোডাউনে অভিযানের নামে মালামাল, অর্থ লুটে নিত। দেখলে তাকে আসল পুলিশই মনে হতো। বাস্তবে সে একজন প্রতারক। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) চাকরিচ্যুত একজন সদস্য। ২০০০ সালে বিজিবিতে চাকরি শুরু করে সে। ২০১০ সালে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এমন আরও চারজন রয়েছে। তারাও প্রতারণা করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়েছে। গত অক্টোবর মাসে মোহাম্মদপুরে সেনাবাহিনী ও র্যাবের পোশাক পরে ডাকাতির সঙ্গে জড়িত ছিল তারা।
এই পাঁচজনের মতো ঢাকাসহ সারাদেশে কয়েক শ’ ভুয়া পুলিশ, র্যাব ও সেনা সদস্য রয়েছে। তারা সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছিল। অবশ্য মাসুদুর রহমানসহ এদের কয়েকজন শেষ পর্যন্ত পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে।
বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের পোশাক পরে ডাকাতির ঘটনায় জনমনে শঙ্কা ও উদ্বেগ বেড়েছে। বিশেষ করে বড় ব্যবসায়ীরা রয়েছেন অনেকটা আতঙ্কে। অভিযানের কথা বলে কে কখন বাসায় কড়া নাড়ে, সে ভয় কাজ করছে অনেকের মধ্যে।
সম্প্রতি রাজধানীর মোহাম্মদপুরে গভীর রাতে সেনাবাহিনী ও র্যাবের পোশাক পরে সংঘবদ্ধ ডাকাত দল একটি বাসা থেকে সাড়ে ৭৫ লাখ টাকা ও ৬০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার লুট করে। অন্তর্বর্তী সরকারের দুই মাসের মাথায় এমন সংবাদ জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। যদিও এ ঘটনায় বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
চলতি মাসের ৪ তারিখে তাঁতীবাজার জুয়েলার্স থেকে স্কুল ব্যাগে ২৬ লাখ ১২ হাজার টাকা নিয়ে বাসযোগে কাকরাইল মোড় হয়ে বাড্ডা যাচ্ছিলেন ট্রাসমি কোম্পানি লিমিটেডের ডিএমডি মো. সাইফুল ইসলাম (৩৮)। বাসটি কাকরাইল ট্রাফিক সিগনালে দাঁড়ালে হঠাৎ ১০ থেকে ১২ জন লোক ওই বাসে উঠে নিজেদের র্যাবের সদস্য পরিচয় দেয়। তাদের মধ্যে একজনের ‘র্যাব’ লেখা জ্যাকেট পরা ছিল এবং তার কাছে হ্যান্ডকাফ ও ওয়্যারলেস সেট ছিল। তারা যাত্রীদের জানায়, বাসে মামলার আসামি রয়েছে। যাত্রীদের একজন সাইফুলকে আসামি হিসেবে শনাক্ত করে এবং অন্যরা তাকে টেনে হিঁচড়ে বাস থেকে নামিয়ে একটি মাইক্রোবাসে তোলে। এরপর ডাকাতরা তাকে লাঠি দিয়ে মারধর শুরু করে এবং ধারাল ছুরি দিয়ে আঘাতের ভয় দেখিয়ে টাকার ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী মামলা দায়েরের পর ১৩ তারিখে সাজ্জাদ হোসেন, কবির হোসেন, শরীফ, মনির হোসেন ও হাবিবুর খন্দকার নামে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে রমনা মডেল থানা পুলিশ। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ।
রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্মা (ওসি) গোলাম ফারুক বলেন, ঘটনায় জড়িত আরও কয়েকজন রয়েছে। তাদের মধ্যে একজন র্যাবের জ্যাকেট, হ্যান্ডকাফ ও ওয়্যারলেস সেট ব্যবহার করেছে। সে এসব কিছু খোলা বাজার থেকে সংগ্রহ করত। তাকে গ্রেপ্তার করতে পারলে বিস্তারিত জানা যাবে। গ্রেপ্তারকৃতরা এ বিষয়ে জানাতে পারেনি।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাজধানীর পলওয়েল মার্কেট ও রজনী গন্ধা সুপার মার্কেটে অবাধে বিক্রি হয় র্যাব-পুলিশের পোশাক; পাওয়া যায় হাতকড়াসহ সব ধরনের সরঞ্জাম। পোশাক ও সরঞ্জাম বিক্রির ব্যাপারে নিয়মনীতি মানা হচ্ছে না। এই সুযোগ ভালোভাবে কাজে লাগাচ্ছে অপরাধীরা। তারা পুলিশ বা র্যাবের পোশাক পরে ছিনতাই, ডাকাতি, খুন ও অপহরণের ঘটনা ঘটাচ্ছে। ওই মার্কেটে পুলিশ-র্যাবের কটি, হাতকড়া, লাইটিং ডিটেক্টর, ব্যাজ, বাঁশি, ক্যাপ, বেল্ট, জুতা, পিস্তল কাভারসহ সব সরঞ্জামই বাইরের লোকের কাছে বিক্রি করা হয়। অথচ পুলিশ সদর দপ্তর থেকে নির্দেশনা দেওয়া আছে, পরিচয়পত্র ছাড়া কারও কাছে কোনো সরঞ্জাম বিক্রি করা যাবে না। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, বিভিন্ন বাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত সদস্যরা বাহিনীর পোশাক কোথায় কীভাবে কিনতে পাওয়া যায় তারা আগে থেকেই জানেন। এ ছাড়া অস্ত্র-ওয়াকিটকি ব্যবহার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মতো কীভাবে অভিযান চালানো হয়, সে সম্পর্কেও ধারণা রয়েছে তাদের। অপকর্মে যুক্ত থাকার প্রমাণ মেলায় এসব সদস্যকে বাহিনী তাৎক্ষণিকভাবে চাকরিচ্যুতসহ শাস্তির আওতায় আনা হয়। শাস্তি শেষে তারা স্বাভাবিক জীবনযাপন না করে পোশাকসহ অন্যান্য সরঞ্জামাদি অবৈধভাবে কিনে বিভিন্ন অপকর্মে যুক্ত হন। এতে একদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হচ্ছে, অন্যদিকে জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
চাকরিচ্যুত বা অবসরে যাওয়া র্যাব, পুলিশ, সেনাবাহিনী ও বিজিবির কতিপয় সদস্য তাদের ব্যবহৃত পোশাক জমা না দিয়ে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কাছে বিক্রি করে দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পুলিশের পোশাক ও সরঞ্জাম ব্যবহারে কড়াকড়ি না থাকায় অপরাধীরা অপরাধ ঘটানোর সুযোগ পাচ্ছে। একসময় তালিকাভুক্ত দোকান ছাড়া অন্য কোথাও পুলিশি সরঞ্জাম বেচাকেনা করা যেত না। যে কেউ ইচ্ছা করলেই দোকান থেকে পুলিশি সরঞ্জাম কিনতে পারত না। পুলিশ সদস্যদেরও যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে পোশাক ও সরঞ্জাম কিনতে হতো। এখন যে কোনো ব্যবসায়ী বিভিন্ন বাহিনীর সরঞ্জাম কেনাবেচা করতে পারেন, যে কেউ কিনতে পারেন; অনুমতির প্রয়োজন হয় না।
সূত্র আরও জানায়, খোলা বাজারে র্যাব-পুলিশের মনোগ্রামসহ ছাপানো আইডি কার্ডও বিক্রি হচ্ছে। তাতে যে কেউ নিজের নাম লিখে, ছবি বসিয়ে হয়ে যাচ্ছে পুলিশ বা র্যাবের বড় কর্তা। সেনাবাহিনী বা আনসার বাহিনীর আইডি কার্ডও কিনতে পাওয়া যায়।
পুরানা পল্টনের পলওয়েল মার্কেট ও কচুক্ষেতের রজনী গন্ধা সুপার মার্কেটে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পোশাক ও সরঞ্জাম বিক্রি হয়। পুলিশ সদস্যরা ওই সব মার্কেট থেকে পোশাক ও সরঞ্জাম কিনে থাকেন। পুলিশের প্রবিধানে (পিআরবি) পুলিশি সরঞ্জাম খোলা বাজারে বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা নেই; তবে পোশাক বিক্রি বেআইনি। ২০১২ সালে এক কার্যনির্বাহী আদেশে পুলিশের পোশাক ব্যবহার সাধারণের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। এর পরও বিভিন্ন সিকিউরিটি কোম্পানি, পাড়া-মহল্লার দারোয়ান ও নাইট গার্ডরা অহরহ র্যাব-পুলিশের মতো পোশাক ব্যবহার করছে। তারা পুলিশের মতো হাতকড়া, র্যাঙ্ক ব্যাজও ব্যবহার করছে। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হচ্ছে।
কয়েক দিন আগে পলওয়েল মার্কেটের বেশ কিছু দোকানে গিয়ে পুলিশের বিভিন্ন সরঞ্জাম কিনতে চাইলে ব্যবসায়ীরা অনায়াসে বিক্রি করতে রাজি হন। সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পর তারা সতর্ক হন এবং বলেন, পুলিশের পরিচয়পত্র না দেখে বিক্রি করা যাবে না।
ওই মার্কেটের একটি স্টোরের একজন কর্মচারী নাম প্রকাশ না করে জানান, নির্দেশনা থাকার পরও পোশাক ও সরঞ্জাম বিক্রি করেন তারা। সব দোকানেই বিক্রি হয়। তিনি জানান, রজনী গন্ধা সুপার মার্কেটেও এসবের বেচাকেনা চলে।
পলওয়েল মার্কেটের ভেন্ডার (অনুমতিপ্রাপ্ত পুলিশি সরঞ্জাম বিক্রেতা) রুহুল আমিন, আবু হেনা ও রাসেল জানান, বুটজুতা এক হাজার ৩০০ থেকে দুই হাজার টাকা, নেমপ্লেট ১০০ থেকে ১২০ টাকা, র্যাক ব্যাজ ৪০ থেকে ৭০ টাকা, ক্যাপ ৯০ থেকে ৩৫০ টাকা, পিস্তল কাভার ৩০০ থেকে দেড় হাজার টাকা, বেল্ট ৪৫০ থেকে এক হাজার টাকা, চীনা হাতকড়া ৭৫০ টাকা, থাই হাতকড়া এক হাজার ২০০ টাকা, কোরিয়ান হাতকড়া এক হাজার ৫০০ টাকা ও তাইওয়ানি হাতকড়া দুই হাজার টাকা, দেশি বাঁশি ৫০ টাকা এবং বিদেশী বাঁশি ১৫০ টাকায় বিক্রি হয়। তারা বলেন, পুলিশ সদর দপ্তর ও পলওয়েল মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির নির্দেশনা অনুযায়ী পোশাক ও সরঞ্জাম পরিচয়পত্র দেখে বিক্রি করা হয়। তবে জুতার কালি, ব্রাশ প্রভৃতি ছোটখাটো জিনিস বিক্রির বিষয়ে তেমন নির্দেশনা নেই।
পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, পলওয়েল মার্কেটে কিছু দোকান নির্দিষ্ট করা আছে। ওই সব দোকান থেকে পুলিশ সদস্যরা পোশাক ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কিনতে পারেন। তবে খোলা বাজারে সহজলভ্য হওয়ায় এসবের অপব্যবহার হচ্ছে। তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর মতো সাপ্লাই কোরের মাধ্যমে পুলিশের সরঞ্জাম বেচাকেনার ব্যবস্থা করলে প্রতারকরা সুযোগ পেত না। যারা প্রতারকদের কাছে সরঞ্জাম বিক্রি করছে তাদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক (লজিস্টিক) নাসিমা আক্তার বলেন, পুলিশের পোশাক বিক্রয়যোগ্য নয়। পুলিশের পোশাক যারা বিক্রি করছে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
বিজিবিও বলছে, বিজিবিতে কোনো সদস্য অপকর্মে জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ইতোমধ্যে অনেককে চাকরিচ্যুতও করা হয়েছে। নির্দিষ্ট মাধ্যমে বিজিবির ইউনিফর্ম সাপ্লাই দেওয়া হয়। বাইরের কোনো দোকানে কিনতে পাওয়া যায় না।
বিভিন্ন সময়ে বাহিনীর পোশাক পরে ডাকাতির ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃতরা জানিয়েছে, তাদের অধিকাংশই বাহিনীতে কর্মরত ছিল। শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে বিভিন্ন সময়ে তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিভিন্ন বাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত সদস্যরা বাহিনীর পোশাক কোথায় কীভাবে কিনতে পাওয়া যায় তারা আগে থেকেই জানে। এ ছাড়া অস্ত্র-ওয়াকিটকি ব্যবহার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মতো কীভাবে অভিযান চালানো হয়, সে সম্পর্কেও ধারণা রয়েছে তাদের।
জানতে চাইলে র্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মুনীম ফেরদৌস বলেন, র্যাবের পোশাক পড়ে অপকর্ম করার তথ্য প্রায়ই পাওয়া যায়। এ বিষয়ে র্যাব কঠোর অবস্থানে রয়েছে। র্যাবের পোশাক বিক্রির ক্ষেত্রে নিয়ম রয়েছে। এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে যেসকল ব্যবসায়ীরা যার তার কাছে পোশাক বিক্রি করছে এবং যারা কিনছে, তাদের গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
সেনাবাহিনীর পরিচয় ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তল্লাশি চালাচ্ছে স্বার্থান্বেষী মহল বা গোষ্ঠী। তারা ফোনকলের মাধ্যমে চাঁদাবাজিরও চেষ্টা করছে। জনসাধারণকে প্রতারিত না হয়ে সতর্ক থাকার অনুরোধ জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। গত ২১ আগস্ট গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আইএসপিআর জানায়, ইদানীং পরিলক্ষিত হচ্ছে যে, কতিপয় স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পরিচয় ব্যবহার করে বেসামরিক পোশাকে সরকারি অফিস, করপোরেট অফিস, পারিবারিক বাসস্থান, শপিংমল ও দোকানে তল্লাশি চালাচ্ছে এবং ফোনকলের মাধ্যমে চাঁদাবাজির চেষ্টা করছে।
আপনাদের সবার অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বেসামরিক পোশাকে এবং অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর (পুলিশ ও র্যাব) উপস্থিতি ছাড়া কোনো ধরনের অভিযান পরিচালনা করে না। তাই জনসাধারণকে প্রতারিত না হয়ে সতর্ক থাকতে অনুরোধ জানাচ্ছে আইএসপিআর।