সাদ অনুসারীদের মুখপাত্র মুয়াজ বিন নূর
টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা মাঠে তাবলীগ জামাতের দুইপক্ষের সংঘর্ষ ও হতাহতের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার আসামী মাওলানা সাদ অনুসারীদের মুখপাত্রকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তাকে রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে ৭দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে সোপর্দ করা হয়। রিমান্ড শুনানীর তারিখ নির্ধারণ করে তাকে জেলহাজতে প্রেরণের আদেশ দিয়েছেন আদালত। শুক্রবার জিএমপি’র টঙ্গী পশ্চিম থানার ওসি ইস্কান্দর হাবিবুবুর গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
গ্রেফতারকৃতের নাম- মুয়াজ বিন নূর (৪০)। তিনি নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া থানার ছয়াশি এলাকার নূর মোহাম্মদের ছেলে। মুয়াজ বিন নূর রাজধানীর খিলক্ষেত থানাধীন নিকুঞ্জ-২ আবাসিক এলাকায় স্বপরিবারে বসবাস করতেন। তিনি ওই মামলার ৫ নম্বর আসামী। তিনি সাদপন্থিদের মূখপাত্র হিসেবে বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেছেন।
পুলিশ জানায়, গত ১৮ ডিসেম্বর টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা মাঠে তাবলীগ জামাতের দুইপক্ষ মাওলানা জুবায়ের ও মাওলানা সাদ অনুসারিদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে তিনজন নিহত ও শতাধিক আহত হন। এ ঘটনায় বৃহষ্পতিবার রাতে মাওলানা জুবায়ের অনুসারী এস এম আলম হোসেন বাদি হয়ে জিএমপি’র টঙ্গী পশ্চিম থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় মাওলানা সাদপন্থি শীর্ষ মুরুব্বী মাওলানা ওয়াসিফুল ইসলামসহ ২৯ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরো শতক শতক জনকে আসামী করা হয়েছে। মামলার বাদি এস এম আলম কিশোরগঞ্জ জেলা সদর থানার গাইটাল গ্রামের এস এম মোক্তার হোসেনের ছেলে এবং কিশোরগঞ্জ জেলার আলমি শুরার সাথী।
জিএমপি’র ওসি ইস্কান্দর হাবিবুবুর রহমান জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে মামলার আসামী মুয়াজ বিন নূরকে বৃহষ্পতিবার দিবাগত রাত সোয়া একটার দিকে রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকায় তার বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়। শুক্রবার ৭দিনের রিমান্ড চেয়ে তাকে গাজীপুরের আদালতে পাঠানো হয়। আদালত আগামী রবিবার তার রিমান্ড শুনানীর দিন ধার্য্য করে গ্রেফতারকৃতকে জেলহাজতে প্রেরণের আদেশ দেন। তিনি আরো বলেন, এ মামলায় অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
সাদপন্থির নিন্দা ও প্রতিবাদ
এদিকে তাবলীগ জামাতের শীর্ষ মুরুব্বি মুরুব্বি হযরত সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলামসহ তাদের সাথীদের নামে মামলা দায়েরের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন তাবলীগ জামাত বাংলাদেশ (সাদপন্থীদের) শীর্ষ মুরুব্বিরা। বিজ্ঞপ্তিতে ভয়াবহ ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত ও গৃহ বিবাদের দিকে চলে যাওয়ার আশংকায় সুশিল সমাজ ও জাতিসংঘসহ সকল জাতীয় আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতা আমরা কামনা করা হয়।
শুক্রবার দুপুরে মাওলানা সাদপন্থীর মিডিয়া সমন্বয়কারী মোঃ সায়েম এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছেন।
বিজ্ঞপ্তিতে তিনি বলেন, তাবলীগ জামাতের শীর্ষ অসুস্থ বর্ষিয়ান মুরুব্বি হযরত সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম সাহেবসহ মূলধারার সাথীদের নামে মিথ্যা মামলা দায়েরের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আমরা মনে করছি, তাবলীগ জামাত বাংলাদেশ (সাদপন্থীদের) উপর বিগত ৭বছর জুলুম নির্যাতন ও বৈষম্যের অংশ হিসাবেই পরিকল্পিতভাবে গুজব, অপপ্রচার ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এর মাধ্যমে তাবলীগ কাজকে নিয়ন্ত্রণে নেয়ার চেষ্টা করেছেন মানুনুল হক এর মতো রাজনৈতিক নেতারা। এর দুদিন আগে সমাবেশ করে মামুনুল হক তুরাগ তীর রক্তে লাল করার ঘোষনার অংশ হিসেবে টঙ্গীর পরিকল্পিত হত্যাকান্ড পরিকল্পিতভাবে ঘটানো হয়েছে। এর আগে ৫ নভেম্বর মাদরাসার ছাত্রদের এনে সরওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশ করে তাবলীগ জামাতের সাদ অনুসারীদের সকল কাজ নিষিদ্ধ করার দাবী করে ও কাকরাইল বিশ্ব অবৈধ দখলের ঘোষনা দিয়ে কিছু উগ্রপন্থী আলেমরা পরিস্থিতি উত্তপ্ত করেছেন।
এছাড়া ১৭ ডিসেম্বর রাতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলম মধ্যস্থতা করে যখন বিষয়টি মিমাংসার দিকে নিচ্ছিলেন, তখনি যারা এই বিরোধ জিয়ে রাখতে চায় ও মিমাংসা না করে এক চেটিয়াভাবে তাবলীগের নিয়ন্ত্রণ চায় তারা এই সংঘাত তৈরি করে রাস্তায় থাকা আমাদের উপর সাথীদের উপর হামলা করেছে। গতকাল আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলায় বেলাল হোসেনের নাম উল্লেখ করলেও সে আমাদেরই সাথী। আমরা এবিষয়ে মামলা দিতে গেলে থানা মামলা নেয় নি। আমাদের সাথী নিহত হওয়ার পরেও আমরা মামলা করতে পারছি না। যা চরম অমানবিক বৈষম্য। উল্টো আমাদের মুরুব্বি মুফতী মুআজ বিন নূরের মাদরাসায় হামলা ও তাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। আমরা দ্রুত তার মুক্তি চাই। গ্রেফতারের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। পাশাপাশি ১৬ ডিসেম্বর থেকে সারাদেশে আমাদের সাথীদের উপর কওমী মাদরাসার ছেলেদের দিয়ে হামলা ও আমাদের বিভিন্ন মসজিদ মাদরাসা বাড়িঘরে বর্বর হামলা করা হচ্ছে।
আমরা দেশের শান্তি শৃঙ্খলা বজায় থাকুক তা সবোর্চ্চভাবে চাচ্ছি, সবর ও ধৈর্য্য ধরছি৷ এই পরিস্থিতি, বৈষম্য ও জুলুম অব্যহত থাকলে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে উঠতে পারে। এবিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা কামনা করছি।
আমাদের শতশত আহত সাথীদের হাসপাতালে চিকিৎসা করতে দেয়া হচ্ছে না। হাসপাতাল থেকে একাধিক সাথীকে কিডনাফ করা হয়েছে, যা গনমাধ্যমেও এসেছে। কিছু সাথীকে গুম করার মতো ঘটনা ঘটেছে। টঙ্গী ময়দানে ১৪৪ ধারা জারি করলে আমরা সরকারী সিদ্ধান্ত মেনে গতকাল ময়দান খালি করলেও, গতকাল থেকেই সরকার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে না রেখে তাদেরকেই আবার বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। এরকম সকল বিষয়ে যা সরাসরি আমাদের সাথে বৈষম্য করা হচ্ছে।
সারাদেশে আমাদের উপর আক্রমন নির্যাতন, গ্রেফতার, মসজিদে মসজিদে নামাজ ও ইবাদতে বাধা দেয়া আইন করে বন্ধ করা না হলে বাংলাদেশ ভয়াবহ ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত ও গৃহ বিবাদের দিকে চলে যাওয়ার আশংকা করছি। সবার ধর্মীয় ও সংবিধানিক মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা হোক। এবিষয় সরকার, মানবাধিকার সংগঠন, গনমাধ্যম, বিবেকবান সুশিল সমাজ ও জাতিসংঘসহ সকল জাতীয় আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতা আমরা কামনা করছি।
দায়েরকৃত মামলায় আসামীর তালিকায় যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে
গত ১৮ ডিসেম্বর টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা মাঠে তাবলীগ জামাতের দুইপক্ষের সংঘর্ষ ও হতাহতের ঘটনায় একটি হত্যা মামলা থানায় দায়ের করেন মাওলানা জুবায়ের অনুসারী এস এম আলম হোসেন। বৃহষ্পতিবার রাতে দায়ের করা এ মামলায় মাওলানা সাদপন্থি শীর্ষ মুরুব্বী মাওলানা ওয়াসিফুল ইসলামসহ ২৯ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরো শতক শতক জনকে আসামী করা হয়েছে।
মামলায় আসামীর তালিকায় যাদের নাম উল্লেখ করা হয়- ঢাকার ধানমন্ডি থানার আবাসিক এলাকার মৃত রিফকুল ইসলামের ছেলে সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম, খুলনার বাটিয়াঘাটা উপজেলার বড় কড়িয়া গ্রামের মনসুর রহমানের ছেলে আব্দুল্লাহ মনসুর, ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলামের ছেলে ওসামা ইসলাম আনু, একই এলাকার ড. কাজী এরতেজা হাসান, উত্তরা এলাকার মৃত নূর মোহাম্মদের ছেলে মোয়াজ বিন নূর, সাভার থানা এলাকার জিয়া বিন কাশেম, তুরাগ থানা (বেলাল মসজিদ) এলাকার আজিমুদ্দিন, সাভার থানার সৈয়দ আনোয়ার আব্দুল্লাহ, মুগদা থানা (বড় মসজিদ) এলাকার শফিউল্লাহ, কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজরা এলাকার মৃত মাওলানা মোজাম্মেলুল হকের ছেলে আনাস, মোহাম্মদপুর থানা এলাকার আব্দুল্লাহ শাকিল, রমনা থানার কাকরাইল এলাকার রেজা আরিফ, উত্তরা পশ্চিম থানার (সেক্টর-৯) আব্দুল হান্নান, একই থানার (সেক্টর-১১) রেজাউল করিম তরফদার, তুরাগ থানার (বেলাল মসজিদ) এলাকার মুনির বিন ইউসুফ, ঢাকার সায়েম, হাজী বশির সিকদার, কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার চন্দনপুর গ্রামের হাবিবুর রহমানের ছেলে মনির হোসেন, মীরপুর থানা এলাকার প্রকৌশলী মুহিবুল্লাহ, ঢাকার পল্লবী থানা এলাকার আজিজুল হকের ছেলে আতাউর রহমান, এলিফ্যান্ট এলাকার তানভীর, তুরাগ থানার ভাটুলিয়া এলাকার মৃত ওয়াজ উদ্দিনের ছেলে বাবুল হোসেন, একই থানা এলাকার প্রকৌশলী আবুল বশর, প্রকৌশলী রেজনুর রহমান, উত্তরা থানার (সেক্টর-১০) মৃত ফজলুল হক সিকদারের ছেলে নাসির উদ্দিন সিকদার, ড. আব্দুস সালাম, গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার ওয়াসি উদ্দিন, রাজধানীর মীরপুর থানা এলাকার মিজান, তুরাগ থানার (বেলাল মসজিদ) এলাকার শাহাদাত। সহ কয়েকশত জনকে আসামী করা হয়।
মামলার এজাহারে যা উল্লেখ করা হয়
মামলার এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, মামলায় উল্লেখিত আসামিরা মাওলানা সা’দ কান্ধলাভীর অনুসারী। গত ৪ ও ৭ নভেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রথম পর্বের বিশ্ব ইজতেমায় বাধা দিয়ে ইসলামের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য চেষ্টা করে। তারা সরকারকে বিব্রত করার উদ্দেশ্যে সরকারি সিদ্ধান্ত বহির্ভূত আগামী ২০ থেকে ২৪ ডিসেম্বর টঙ্গী ময়দানে সা’দপন্থিদের জোড় করার মর্মে ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে প্রোপাগান্ডা করতে থাকে। মামলার প্রধান আসামি সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম তার সই করা চিঠির মাধ্যমে সারা দেশের সা’দপন্থিদের জানান যে আগামী ২০ থেকে ২৪ ডিসেম্বর টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমা ময়দানেই পুরনোদের জোড় হবে। ওই চিঠিতে পুরনো সাথিদের সঙ্গে মোনাসেব সাথিদেরও নিয়ে আসে এবং তাদের সঙ্গে যেন টর্চলাইট ও হ্যান্ডমাইক থাকে এমন নির্দেশনা দেয়া হয়।
মামলার ২ নম্বর আসামি আব্দুল্লাহ মনসুর ফেসবুক লাইভে ঘোষণা দেন, পুরনোদের জোড়ে এবং বিশ্ব ইজতেমায় যদি মাওলানা সা’দ সাহেবকে আনতে দেওয়া না হয় এবং তাদের যদি টঙ্গী ময়দানে ২০ থেকে ২৪ ডিসেম্বর জোড় করতে দেওয়া না হয়, তাহলে তারা সরকারের সিদ্ধান্তমতে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব হতে দেবে না।
তাদের এসব উসকানিমূলক বক্তব্যে ও নির্দেশে বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) রাত ৩টার দিকে ঘুমন্ত ও পাহারারত শুরায়ী নেজামের সাথিদের ওপর হামলা করে। তাদের হামলায় কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার এগারসিন্দু গ্রামের মৃত ওসমান গণির ছেলে আমিনুল ইসলাম বাচ্চু (৬৫), ফরিদপুর সদর উপজেলার কমলাপুর গ্রামের মৃত শেখ সামাদের ছেলে বেলাল হোসেন (৬০) এবং বগুড়া সদর উপজেলার ধাওয়াপাড়া গ্রামের ওমর উদ্দিনের ছেলে তাজুল ইসলামকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করে।
ইসরাত