সরকারের সিভিল প্রশাসনে ক্ষোভ বাড়ছে
সরকারের সিভিল প্রশাসনে ক্ষোভ বাড়ছে। ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যেও। এই ক্ষোভে ঘি ঢেলেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব। এতে প্রশাসনের দৈনন্দিন কাজেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। প্রশাসন যন্ত্র সামাল দিতে সরকারকেও ভাবিয়ে তুলেছে।
সরকারে উপসচিব ও যুগ্ম সচিব হতে পরীক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি উপসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রশাসন ও অন্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের অনুপাত ৫০:৫০ শতাংশ করা হচ্ছে। এ ছাড়া শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারকে নিয়ে পৃথক সংস্থা গঠনের প্রস্তাব করবে কমিশন। কমিশন প্রধানের এমন ঘোষণায় প্রচ- ক্ষুব্ধ প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন (বিএএসএ)।
একইভাবে কমিশনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে চিকিৎসকদের সংগঠন বিসিএস হেলথ ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন এবং শিক্ষকদের বিসিএস জেনারেল এডুকেশন ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন। এ ছাড়া সারাদেশের ৬৪ জন জেলা প্রশাসক (ডিসি) এমন প্রস্তাবের বিরোধিতা করে সভার কার্যবিবরণী পাঠিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। তারা কেউই মানছেন না অন্তর্র্বর্তী সরকার গঠিত জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব। এই ক্যাডার সংগঠনগুলো নিজ নিজ সংগঠনের নেতাদের নিয়ে বৈঠক করে সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে।
গত বুধবার এসব প্রতিবাদ বিজ্ঞপ্তি আকারে গণমাধ্যমকেও জানানো হয়। বিএএসএ বলছে, সরকারের সব পদে শতভাগ প্রশাসন ক্যাডার থেকে পদায়ন করা উচিত। অন্যদিকে প্রশাসন ছাড়া অন্য ২৫ ক্যাডার এই ইস্যুতে বলছে, মেধার ভিত্তিতে সরকারের পদে নিয়োগ হবে। সেখানে কোনো কোটা থাকবে না।
আবার শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারকে নিয়ে পৃথক সংস্থা গঠনের প্রস্তাবে দেশে স্বাস্থ্য খাতে নেতিবাচক পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে দায় নেবে
না হেলথ ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন। আর শিক্ষা খাতে অস্থিরতা তৈরি করতেই এমন প্রস্তাব করা হয়েছে বলে অভিযোগ এডুকেশন ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের।
গত মঙ্গলবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় সংস্কার কমিশন প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী বলেন, পরীক্ষা ছাড়া সিভিল সার্ভিসের উপসচিব ও যুগ্ম সচিব পর্যায়ে কেউ পদোন্নতি পাবেন না। পাবলিক সার্ভিস কমিশন পরীক্ষা নেবে। ৭০ নম্বর না পেলে পদোন্নতি পাবেন না।
পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশি নম্বর পাওয়া কর্মকর্তাই উপসচিবের তালিকায় ১ নম্বর হবেন। উপসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য ৫০ শতাংশ এবং অন্য ক্যাডার থেকে ৫০ শতাংশ সুপারিশ করা হবে। বর্তমানে প্রশাসন ক্যাডার থেকে ৭৫ শতাংশ এবং অন্য ক্যাডার থেকে ২৫ শতাংশ নেওয়া হয়। এর মাধ্যমে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর হবে।
এ ছাড়া বলা হয়, সংস্কার কমিশন মনে করে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারের বর্তমান কাঠামো বজায় রাখার প্রয়োজন নেই। বরং এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর পরিচালনার জন্য পৃথক সংস্থা গঠনের প্রস্তাব করবে কমিশন।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের এমন প্রস্তাবের পরই রাতে রাজধানীর বিয়ামে জরুরি বৈঠকে বসে প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠন বিএএসএ। দীর্ঘ বৈঠকের পর তারা গণমাধ্যমে লিখিত বিবৃতি পাঠায়। তাদের সঙ্গে একমত হন দেশের ৬৪ জেলার ডিসিরাও।
বিএএসএ সভাপতি ড. মো. আনোয়ার উল্লাহ এবং মহাসচিব মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমানের সই করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দেশের সর্বোচ্চ আদালতে মীমাংসিত একটি বিষয় নিয়ে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের আনুষ্ঠানিক লিখিত প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দেওয়ার আগেই আকস্মিকভাবে এ ধরনের ঘোষণা অনভিপ্রেত, আপত্তিকর ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে দুর্বল করার শামিল। উপমহাদেশে সিভিল সার্ভিসের ইতিহাসে সব সময়ই প্রশাসন ক্যাডার/সার্ভিসের লোকেরাই উপসচিব/যুগ্ম সচিব/অতিরিক্ত সচিব/সচিব পদে কাজ করে আসছেন।
রাষ্ট্রে প্রশাসন ক্যাডারের কার্যপরিধির সঙ্গে পলিসিমেকিংয়ের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। সরকারের নির্বাহী বিভাগের অন্যতম প্রতিনিধি হিসেবে মাঠে সহকারী কমিশনার/ সহকারী কমিশনার (ভূমি)/ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা/অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক/জেলা প্রশাসক/বিভাগীয় কমিশনার হিসেবে সরকারের কোনো সুনির্দিষ্ট পলিসি নয়, বরং সব পলিসি বাস্তবায়ন ও সমন্বয়ের মূল কাজটি প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারাই করে থাকেন।
পলিসি তৈরির ক্ষেত্রে সচিবালয়ে উপসচিব ও তদূর্ধ্ব কর্মকর্তারা পলিসি সম্পর্কে মাঠের বাস্তবতা, অর্জিত জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টি দেশের জনগণের প্রতিনিধি রাজনীতিবিদদের কাছে তুলে ধরেন, যারা দেশের নেতৃত্ব দেন। সচিবালয়ে আমলাতন্ত্র রাজনীতিবিদ ও মাঠ প্রশাসনের মধ্যে একটি যোগসূত্রের মতো কাজ করে। এ কারণেই মাঠ প্রশাসনে কর্মরতরাই এই কাজের জন্য সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত। ফলে সরকারের উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পদের সবই প্রশাসন ক্যাডার থেকে পদায়ন হওয়া উচিত। এ ছাড়া পুলিশ প্রশাসনেও রয়েছে অসন্তোষ।