ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২০ ডিসেম্বর ২০২৪, ৫ পৌষ ১৪৩১

রাজধানীর যানজট নিরসন ও বায়ুদূষণ রোধের উদ্যোগ

ফিটনেসবিহীন গাড়ি অপসারণসহ একাধিক সিদ্ধান্ত

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২২:৩৮, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪

ফিটনেসবিহীন গাড়ি অপসারণসহ একাধিক সিদ্ধান্ত

ফিটনেসবিহীন গাড়ি অপসারণ

রাজধানীর যানজট নিরসন ও বায়ুদূষণ রোধে যত্রতত্র অবৈধ পার্কিং বন্ধ, সুনির্দিষ্ট স্থানে যাত্রী উঠানামা না করা এবং ঢাকা পুরনো ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন অপসারণসহ একাধিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ ছাড়া গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনার জন্য আগামী ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে রাজধানীর ৮ রুটে আবারও পরিক্ষামূলক চালু করা হবে সবুজ রঙের ঢাকা নগর পরিবহন সার্ভিস।

পাশাপাশি আগামী এক মাসের মধ্যে সেবায় উন্নতি করতে না পারলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যানসহ সব স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। 
তিনি বলেন, ‘যানবাহনের ফিটনেস পরীক্ষা ও ড্রাইভিং লাইসেন্সের বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআরটিএ) এক মাসের সময় দেওয়া হয়েছে। এই এক মাসের মধ্যে নিজেদের অবস্থার উন্নতি না করতে পারলে বিআরটিএর বিরুদ্ধ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ পাশাপাশি যানজটের স্থানসমূহ সঠিকভাবে চিহ্নিত করে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশনা দেন এবং ড্রাইভার ও গাড়ির মালিকদের হয়রানি বন্ধে সচেষ্ট থাকার আহ্বান জানান তিনি।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর বিদ্যুৎ ভবনের বিজয় হলে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ কর্তৃক আয়োজিত ‘সড়ক পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা জোরদারকরণ, ঢাকা মহানগরীর যানজট নিরসন এবং বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ’ বিষয়ে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় সভপতির বক্তব্যে উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এ মন্তব্য করেন। সভায় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন নৌ-পরিবহন, শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন, পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মো. খোদা বকশ চৌধুরী ও পরিবহন শ্রমিক নেতা শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস।
সভার সভাপতিত্বে বক্তব্যে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদষ্টো বলেন, সভায় একাধিক বিষয় আলোচনা করা হয়েছে। এর মধ্যে সড়কে যত্রতত্র পার্কিং ও যাত্রী ওঠানামা বন্ধে সুনির্দিষ্ট জায়গা চিহ্নিত করা এবং পুনর্বাসন পরিকল্পনা নিয়ে ফুটপাত দখলমুক্ত করার ব্যবস্থা নিতে হবে। রাজধানীর স্কুল গুলোকে শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুল বাসের ব্যবস্থা করার বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

এছাড়া বিশ বছরের পুরনো ও ফিটনেসবিহীন বাসগুলো মে মাসের মধ্যে রাস্তা থেকে তুলে নিতে হবে এবং এ সংক্রান্ত কোনো ধরনের ব্যাংক ঋণের সহায়তার প্রয়োজন হলে সরকার সর্বাত্মক সহযোগিতা করবেন বলে বাস মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দকে আশ্বাস দেন তিনি। 
সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ পর্যালোচনা করা হবে বলে জানিয়ে সড়ক ও সেতু উপদেষ্টা বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য কাউকে কষ্ট দেওয়া নয়; ঢাকা শহরের যানজট সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা। যদি এক সপ্তাহের মধ্যে দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন না আসে তাহলে আরো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।  
২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে চলবে সবুজ রঙের বাস 
আগামী ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে আবারও চালু হচ্ছে সবুজ রঙের ঢাকা নগর পরিবহন সার্ভিস। রাজধানীর ৮টি রুটে সবুজ ক্লাস্টারের এই বাস সার্ভিস পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সভায় এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. এহছানুল হক বলেন, আগে ঢাকায় অপরিকল্পিত ভাবে ২৫৬টি রুট ছিল। সেটিকে কমিয়ে ৪২টি রুটে নিয়ে আসা হয়েছে। ২৫ ফেব্রুয়ারি পাইলট প্রজেক্টের মাধ্যমে আমরা গ্রিন ক্লাস্টার বাস সার্ভিস চালু করব ৮টি রুটে।

এই রুটের অন্য কোন কোম্পানির বাস চলাচল করতে পারবে না। আগে কিভাবে চলাচল করছে সেটা এখন বাদ। নতুন করে আমরা সবুজ রঙের বাস দিয়ে এই সার্ভিস চালু করবে। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য রুটেও বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি পদ্ধতির আওতায় নিয়ে আসা হবে বলে জানান তিনি।
ডিটিসিএ’র সূত্র জানায়, বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি বা বিশেষ পদ্ধতিতে বাস পরিচালনা। অর্থাৎ বিক্ষিপ্তভাবে বাসের অনুমোদন না দিয়ে পরিকল্পিত ব্যবস্থা চালুর কথা বলা হয়। প্রতিটি কোম্পানির বাসের রঙ থাকবে পৃথক। গোলাপী, নীল, মেরুন, কমলা, সবুজ ও বেগুনী এই ছয়টি রঙ দ্বারা বাসগুলো চিহ্নিত করা হবে। একটি কোম্পানিতে এক রঙের বাস থাকবে। প্রাথমিকভাবে ৮টি ক্লাস্টারে (শ্রেণির) ২২টি কোম্পানির মাধ্যমে ৪২টি রুটে নগর পরিবহন বাস সার্ভিস পরিচালনা করা হবে।

এই পদ্ধতি চালু করা জন্য ২০২১ সালে ২১ নম্বর রুট (ঘাটারচর-মোহাম্মদপুর-জিগাতলা-প্রেস ক্লাব-মতিঝিল-যাত্রাবাড়ী-কাঁচপুর) পাইলট প্রকল্প হিসেবে ‘ঢাকা নগর পরিবহন’ নামে প্রথম বাস সেবা চালু করে ‘বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটি’। এর পর আরও দুই রুটে এই বাস সার্ভিস চালু করা হয়েছিল। যাত্রীদের মধ্যে এই বাস সার্ভিসের ব্যাপক চাহিদা থাকার পরও অন্য বাস কোম্পানীর প্রতিযোগিতার কারণে এই সার্ভিসটি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। সর্বশেষ গত ৫ আগস্টের এই সার্ভিস পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এখন নতুনে আবার ৮টি রুটে সবুজ ক্লাস্টারের বাস চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
একমুখী গাড়ি চলাচলের সুপারিশ ॥ সভায় ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে পিক আওয়ারগুলোতে একমুখী গাড়ি চলাচলের সুপারিশ করেন নৌ-পরিবহন, শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, যত্রতত্র পার্কিং, সুনির্দিষ্ট স্থানে যাত্রী উঠানামা না করা, পুরনো ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন ঢাকা শহরে যানজট সৃষ্টির অন্যতম প্রধান কারণ।

এরই প্রেক্ষিতে স্বল্পকালীন সমাধান হিসেবে নির্দিষ্ট সময়ে বা পিক আওয়ার গুলোতে একমুখী যানচলাচলের ব্যবস্থা করা, পার্কিংয়ের জন্য সুনির্দিষ্ট স্থান নির্ধারণ করা এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও সতর্কতার সঙ্গে কঠোরভাবে দায়িত্ব পালনের কথা বলেন। এ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হিসেবে উপদেষ্টা ঢাকা শহরের বাস টার্মিনালগুলো এবং রেলওয়ে স্টেশন স্থানান্তরের ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। 
বায়ু দূষণে কাজ করবে টাস্কফোর্স ॥ সভায় ফিটনেসবিহীন, রাস্তায় চলাচলের অনুপযোগী লক্কড়ঝক্কড় গাড়ি, পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বিষাক্ত কালো ধোঁয়া নির্গমনকারী বাসগুলো মালিকদের নিজ দায়িত্বে অপসারণ করার আহ্বান জানিয়ে পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, বায়ু দূষণে ঢাকা শহরের মানুষ ভুগছে এবং এ সমস্যা সমাধানে আমাদের অতি দ্রুতই ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ছাড়া ঢাকা শহরের দূষণ রোধে সকলকে একত্রিত হয়ে কাজ করতে হবে।  

ঢাকায় মানুষ বায়ুদূষণে অসুস্থ হবে, মারা যাবে আর বাসগুলো দূষণ করবে-এটা চলতে দেওয়া হবে না। পুরনো বায়ুদূষণকারী বাস তুলে স্ক্র্যাপ করা হবে। কিছু মানুষের স্বার্থে ঢাকার সব বাসিন্দাকে বায়ুদূষণের শিকার হতে দেওয়া যাবে না। বাস মালিকদের দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
রিজওয়ানা হাসান জানান, বায়ুদূষণ রোধে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। টাস্কফোর্স ঢাকার রাস্তার ধুলা নিয়ন্ত্রণ, ভাঙা রাস্তা মেরামত এবং আইন প্রয়োগে কাজ করবে। ধুলা, কালো ধোঁয়া, ইটভাঁটি এবং কলকারখানার দূষণ কমাতে কাজ করা হবে। এয়ার কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান অনুযায়ী এগিয়ে যেতে হবে। ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে আশুলিয়াকে ইটভাটামুক্ত এলাকা ঘোষণা করা হতে পারে। এয়ার পিউরিফায়ারের কর কমাতে এনবিআরকে অনুরোধ করা হয়েছে। ফুটপাত দখলমুক্ত করতে হবে। তবে আইন প্রয়োগে মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
সমন্বিতভাবে কাজ করার আহবান ॥ সভায় গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, ঢাকা শহরকে যানজটমুক্ত করতে এবং ঢাকাবাসীকে একটি সুন্দর ও নিরাপদ শহর উপহার দিতে আমাদের সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। এ সময় তিনি সড়কে যানজট নিরসনের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল অংশীদারগণকে নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের চেষ্টা করতে হবে বলেও উল্লেখ করেন।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মো. খোদা বকশ চৌধুরী তার বক্তব্যে বলেন, ঢাকা শহরের যানজট মুক্ত করতে ড্রাইভারদের ট্রাফিক রুলস সম্পর্কে বিশদভাবে অবহিত করতে হবে, প্রয়োজনে বিদেশী প্রশিক্ষক এনে বিশেষায়িত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে এবং বর্তমানে পরিচালিত ট্রিপ বেইজড ব্যবস্থার সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এ সময় তিনি মহাসড়কে অটো রিক্সা নিয়ন্ত্রণে সরকার কাজ করে যাচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন।
জুলাই বিপ্লবের চেতনা সমুন্নত রাখার আহ্বান জানিয়ে পরিবহন শ্রমিক নেতা শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস বলেন, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও জীবনযাত্রায় স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। শিমুল বিশ্বাস বলেন, সরকারকে চালকদের জন্য পর্যাপ্ত কাউন্সেলিং ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং বিদ্যমান সড়ক পরিবহন আইন পুনর্বিবেচনা করতে হবে। এ সময় তিনি সরকারের গৃহীত সকল জনবান্ধব উদ্যোগকে সমর্থন জানাবেন বলে অঙ্গীকার করেন এবং সড়কে বেআইনি চাঁদাবাজি বন্ধে সর্বোচ্চ সহযোগিতার প্রতিশ্রুতিও ব্যক্ত করেন।
সড়ক পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা জোরদারকরণ, ঢাকা মহানগরীর যানজট নিরসন এবং বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় এর সাথে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিবৃন্দ, বাস মালিক সমিতির শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ, সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধিবৃন্দ, ছাত্র সমাজের প্রতিনিধিবৃন্দসহ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ উপিস্থিত ছিলেন।

×