ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ৫ পৌষ ১৪৩১

বছরজুড়ে ইসলামি অঙ্গনের আলোচিত ১০ ঘটনা

প্রকাশিত: ১৯:২৭, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪

বছরজুড়ে ইসলামি অঙ্গনের আলোচিত ১০ ঘটনা

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশে ২০২৪ সাল ছিল নানা ঘটনার কারণে আলোচিত। বিশেষ করে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান ছিল ইতিহাসের অনন্য ঘটনা। অন্যান্য অঙ্গনের মতো ইসলামি অঙ্গনও এ বছর ছিল ঘটনাবহুল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১০টি ঘটনা তুলে ধরা হলো।

 

চলতি বছর শুরু ও শেষ হয় পাঠ্যপুস্তক সংক্রান্ত আলোচনা-সমালোচনায়।

 

১৯ জানুয়ারি রাজধানীর কাকরাইলে ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সে ‘বর্তমান কারিকুলামে নতুন পাঠ্যপুস্তক: বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক সেমিনারে জাতীয় শিক্ষাক্রমের পাঠ্যবইয়ের পৃষ্ঠা ছিঁড়ে আলোচনায় আসেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক আসিফ মাহতাব উৎস। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা হয়।পরবর্তীতে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় আসিফ মাহতাবকে। ওই সেমিনারে তিনি অভিযোগ করেন, ‘সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে ট্রান্সজেন্ডার নিয়ে আলোচনা করে শিক্ষার্থীদের মগজধোলাই করা হচ্ছে।’ এ সময় তিনি সপ্তম শ্রেণির ওই বইয়ের ‘মানুষে মানুষে সাদৃশ্য ও ভিন্নতা’ অধ্যায়ের শরিফার গল্প অংশের পৃষ্ঠা ছিঁড়ে ফেলেন।

২৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) প্রণীত ও মুদ্রিত পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জনের জন্য গঠিত সমন্বয় কমিটি গঠনের ১৩ দিনের মাথায় বাতিল করা হয়। এরপর এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তবে ওই কমিটি বাতিলের পর এনসিটিবি কিংবা শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বাতিলের কোনো কারণ উল্লেখ বা ব্যাখ্যা করা হয়নি।

 

এর ব্যাখ্যা না থাকলেও মূলত ইসলামি অঙ্গনে সমালোচনার কারণে ওই কমিটি বাতিল করা হয় বলে ধারণা করা হয়। কেননা পরবর্তী কমিটি ইসলামি ব্যক্তিদের যোগ করে গঠন করা হয়। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে দাবি করা হয়, কেন কোনো আলেমকে ওই কমিটিতে রাখা হয়নি। এছাড়াও কমিটিতে থাকা দুই একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে তারা এলজিবিটিকিউয়ের অধিকার নিয়ে কাজ করেন। সেসময় আলেমদের সংযুক্তিসহ ওই ব্যক্তিদের অপসারণেরও দাবি করা হয় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে।

 

বিশ্ব ইজতেমা ২০২৪

বরাবরের মতো এ বছরও টঙ্গীর তুরাগ তীরে তাবলীগ জামাতের ইজতেমা শুরু হয় দুপর্বে। যেখানে প্রথম পর্ব পাকিস্তান থেকে আসা মাওলানা আহমদ বাটলা’র আমবয়ানের মধ্যদিয়ে শুরু হয়; দ্বিতীয় পর্বও সম্পন্ন হয় সুষ্ঠুভাবে।

দ্বিতীয় পর্বে ভারতের মাওলানা সাদ কান্ধলভীকে আনার চেষ্টা করা হয়। সে সময়ের ধর্মমন্ত্রী ফরিদুল হক খান আনার চেষ্টা করা হবে বললেও পরে আর মাওলানা সাদকে আনা যায়নি। এছাড়া দ্বিতীয় পর্বের আখেরি মোনাজাতে অংশগ্রহণ করতে আসার সময় ৪ ফেব্রুয়ারি সড়ক দুর্ঘটনায় দুজন নিহত হন।

 

 

ফরিদপুরে মন্দিরে আগুন দেয়ার কারণে দুই যুবককে পিটিয়ে হত্যা

এপ্রিলে ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলায় দুই যুবককে মন্দিরে আগুন দেয়ার সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করার পর তা দেশজুড়ে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। সারা দেশে এ হত্যার বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়। ঢাকা ও খুলনা মহাসড়কে অবরোধ করাও হয়।

উপজেলার ডুমাইন ইউনিয়নে এক মন্দিরের পাশে স্কুলের নির্মাণশ্রমিক কাজ করছিলেন। সে সময় মন্দিরে আগুন লাগলে শ্রমিকদের অবরুদ্ধ করে রাখা হয় এবং তাদেরকে পেটানো হয়। এ সময় দুজন নিহত হন। এ ঘটনার পর ফরিদপুর এক সপ্তাহেরও বেশি বিজিবি টহলে ছিল।

 

দেশের বিভিন্ন জায়গায় মাজার ভাঙার ঘটনা

আগস্টে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর কদিন ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় মাজারে হামলার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় মানুষজন হতাহতও হন। এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইভেন্ট খুলেও মাজার ভাঙার আহ্বান জানাতে দেখা যায়।

এক্ষেত্রে নারায়ণগঞ্জের দেওয়ানবাগ মাজারে হামলার ঘটনা এবং সিলেটের শাহপরান মাজারে গান-বাজনা নিষিদ্ধ করার ঘটনা বেশি আলোচিত ছিল। গুলিস্তানের গোলাপশাহ মাজার ভাঙার জন্য ফেসবুকে প্রচারিত একটি ইভেন্ট দেশব্যাপী ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।

 

বায়তুল মোকাররমে সংঘর্ষ

জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বায়তুল মোকাররমের খতিব মাওলানা মুফতি রুহুল আমীন জুমার নামাজে অনুপস্থিত থাকেন। পরবর্তীতে তিনি ফেরত এলে শুক্রবার (২০ সেপ্টেম্বর) মুসল্লিদের একাংশ তাকে প্রত্যাখ্যান করেন। এ সময় তার সঙ্গে আসা সমর্থকদের সঙ্গে জুমার নামাজের মুসল্লিদের সংঘর্ষ বাধে, যা বায়তুল মোকাররম মসজিদের জন্য নজিরবিহীন ঘটনা।

এ ঘটনায় অন্তত ৫০ জন মুসল্লি আহত হন। মসজিদে থাকা জুতার বাক্স, রড ও পাইপ দিয়ে মসজিদের গ্লাস ভাঙ্গা এবং পরে সে গ্লাস দিয়ে মুসল্লিদের ওপর হামলা চালিয়ে রক্তাক্ত করার অভিযোগ ওঠে মুফতি রুহুল আমীনের অনুসারীদের বিরুদ্ধে।

 

বায়তুল মোকাররমের নতুন খতিব নিয়োগ

১৭ অক্টোবর ইসলামি আইন বিশেষজ্ঞ ও হাদিস বিশারদ আল্লামা মুফতি আবদুল মালেককে (হাফি.) বায়তুল মোকাররমের নতুন খতিব হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে তাকে জাতীয় মসজিদের খতিব পদে নিয়োগের অনুমোদন দেয়া হয়।

সাবেক খতিব মাওলানা মুফতি রুহুল আমীন অনুপস্থিত থাকা এবং তাকে নিয়ে সংঘর্ষের পর বায়তুল মোকাররমে নতুন খতিব হিসেবে নিয়োগ পান মুফতি আবদুল মালেক। তার এ নিয়োগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আনন্দ প্রকাশ করেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা।

 

বিশ্ব ইজতেমাকে কেন্দ্র করে ইসলামি মহাসম্মেলন

২০১৯ সালের বিশ্ব ইজতেমায় মাওলানা সাদ কান্ধলভীর আসাকে কেন্দ্র করে তাবলীগ জামাত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তখন থেকে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বে ইজতেমা করছেন তাবলীগের একাংশ শুরায়ে নেজাম, যাদের সঙ্গে মাওলানা জোবায়েরসহ কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক আলেমগণ রয়েছেন।

অন্যদিকে, দ্বিতীয় পর্বে ইজতেমা করে আসছেন মাওলানা সাদ কান্ধলভীর অনুসারীরা। তারা ২০২৫ সালের প্রথম পর্বে বিশ্ব ইজতেমা করার জন্য এবং মাওলানা সাদকে আনার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানান।

বিষয়টিকে চক্রান্ত হিসেবে ঘোষণা দিয়ে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক আলেমগণ এবং শুরায়ে নেজাম ইসলামি মহাসম্মেলনের ঘোষণা দেন ৫ নভেম্বর। ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী ময়দানে আয়োজিত ওই সম্মেলনে মাওলানা সাদকে আসতে না দেয়া, সাদ অনুসারীদের পৃথক পর্ব না রাখার ঘোষণা দেয়া হয়।

তবে পরবর্তীতে সরকার প্রথম পর্বে শুরায়ে নেজাম এবং দ্বিতীয় পর্বে সাদপন্থিদের ইজতেমা করার সিদ্ধান্ত জানায়, যা ২০২৫ সালের জানুয়ারির শেষ ও ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানে অনুষ্ঠিত হবে।

 

ঘুষ-দুর্নীতি নিয়ে মসজিদের ইমামের বয়ানের পর চাকরিচ্যুতির অভিযোগ

চাঁদপুর জেলার মতলবে জুমার নামাজের বয়ানে সুদ-ঘুষের বিরুদ্ধে কথা বলার কারণে মাওলানা রহমত উল্লাহ নামে এক ইমামকে চাকরিচ্যুত করা হলে দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় ওঠে। এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দেয়া এবং কমেন্ট বক্সে মন্তব্য করায় চার পরিবারকে সমাজচ্যুত করা হয়, যা এ ঘটনাকে নতুন মোড় দেয়।

তবে এ চাকরিচ্যুতির ঘটনা সুদ-ঘুষ নিয়ে বয়ানের কারণে নয়; বরং এর আগে থেকেই ইমাম সাহেবকে বাদ দেয়ার কথা ছিল বলে জানায় মসজিদ কমিটি। তারপরও সমালোচনা হওয়ার স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে বিষয়টির সমাধান করা হয়।

 

ইসকন নিষিদ্ধের দাবিতে দেশজুড়ে বিক্ষোভ

বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র ও হাটহাজারীর পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী গ্রেপ্তার হন ২৫ নভেম্বর। এর পরের দিন চট্টগ্রামের আদালতপাড়ায় তার অনুসারীদের হাতে খুন হন আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ।

চিন্ময় কৃষ্ণ দাস এক সময় আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘের (ইসকন) নেতা ছিলেন এবং ভারতে আশ্রয় নেয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে বিভিন্ন সময়ে নানা প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে। এমনকি, শিশু নির্যাতনসহ চারিত্রিক স্খলনজনিত অভিযোগও বেরিয়ে আসে তার বিরুদ্ধে।

এমন এক ব্যক্তিকে আইনি প্রক্রিয়ায় নিতে বাধা ও বিভিন্ন উসকানিমূলক মন্তব্য ছড়ানোর প্রতিবাদে দেশজুড়ে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ হয়। সেখান থেকে ইসকন নিষিদ্ধের দাবি উঠে আসে। একই সঙ্গে আইনজীবী হত্যার প্রতিবাদ এবং খুনিদের দ্রুত বিচারের দাবি করা হয়।

 

বছরজুড়ে আলোচনায় হজ

মে মাসে সৌদি আরবে যাওয়া শুরু হয় ২০২৪ সালের হজ ফ্লাইট। অতিরিক্ত তাপমাত্রার ফলে অধিক সংখ্যায় হজযাত্রীর মৃত্যু ঘটে এ বছর। এবার হজে ৬৫ জন বাংলাদেশি মারা যাওয়ার খবর পাওয়া যায়।

আগস্টে ক্ষমতার পালাবদলে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আসেন ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন। তিনি হজের খরচ কমানোর জন্য দুটির বদলে তিনটি প্যাকেজ ঘোষণা করেন খাবার খরচ ব্যতীতই।

 

সরকারি এ হজ প্যাকেজ ঘোষণার পর প্রতিক্রিয়া জানায় বেসরকারি হজ এজেন্সিগুলো। তাদের দাবি, হজের খরচ কমেনি, বরং বেড়েছে। তবে হজ মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, সৌদি রিয়ালের দাম বেড়ে যাওয়ায় হজ খরচ বেশি একটা কমানো যায়নি।

এছাড়া, বেসরকারি হজ এজেন্সিগুলোর সংগঠন ‘হজ এজেন্সিজ অব এসোসিয়েশন বাংলাদেশ (হাব)-এর কমিটি ভেঙে দেয়া হয় দুর্নীতির অভিযোগে। এরপর হাব দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। হাবে সরকার থেকে প্রশাসক নিয়োগ নিয়ে প্রতিবাদ জানায় সংগঠনটির একাংশ। এরপর বেসরকারি হজ প্যাকেজ নিয়ে পাল্টাপাল্টি ঘোষণা দিতেও দেখা যায়।

 

তাবিব

×