শেখ হাসিনা। ফাইল ফটো
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যে হলফনামা জমা দিয়েছিলেন, সেখানে মোট বার্ষিক আয় দেখানো হয়েছিল ২৯ লাখ ৭৭ হাজার টাকা। ১৫ বছরে আয় বাড়ে সাড়ে তিনগুণ। নির্বাচনী হলফনামা অনুযায়ী, স্থাবর ও অস্তাবর সম্পত্তি না বাড়লেও তিনি পূর্বাচলে একটি প্লট নেন। শেখ পরিবারের সদস্য, যারা সংসদে গিয়েছেন তাদের সম্পদ বেড়েছে বহুগুণ।
গোপালগঞ্জের সাবেক সংসদ সদস্য শেখ ফজলুল করীম সেলিম। শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই। ২০০৮ সালের হলফনামার তথ্য অনুযায়ী দেখা যায়, তার কোন আয় ছিল না। কিন্তু ১৫ বছরের ব্যবধানে আয় বেড়েছে। এখন তার বার্ষিক আয় ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা। ১৫ বছরে বেড়েছে নগদ টাকার পরিমাণ ১৩ গুণ। ব্যাংকে জমা টাকার পরিমাণ ২০৭ গুণ। অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে ১৬ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। শেয়ার বাজারে বিনোয়োগ ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা। সম্পদ বেড়েছে তার স্ত্রীরও।
শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই, শেখ হেলাল উদ্দিন। গত সংসদ নির্বাচনের সময় জমা দেওয়া হলফনামার তথ্য অনুযায়ী, শেখ হেলাল ব্যবসা থেকে বছরে আয় দেখান ৫০ লাখ টাকা। সংসদ সদস্য হিসেবে ভাতা পেয়েছেন ২৪ লাখ টাকা। ব্যবসা থেকে বছরে তাঁর স্ত্রী শেখ রূপার আয় সাড়ে ২৯ লাখ টাকা। অস্থাবর সম্পদের মধ্যে রয়েছে নিজের নামে তিনটি গাড়ি, নগদ টাকা, ব্যাংকে জমা, ইলেকট্রনিক সামগ্রী, আসবাবসহ সব মিলিয়ে প্রায় ৮ কোটি ৮২ লাখ টাকার এবং স্ত্রীর নামে ৯ কোটি ৮৬ লাখ টাকা।
স্থাবর সম্পদের মধ্যে পূর্বাচল নতুন শহরে ১০ কাঠা জমি, নরসিংদীর পলাশে রয়েছে কৃষি-অকৃষি জমি। গুলশান বারিধারা আবাসিক এলাকায় ৫ কাঠা জমির ওপর সাততলা আবাসিক ভবনের মূল্য ১০ কোটি ১৭ লাখ টাকা। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় সাড়ে ১৪ শতক জমি। স্ত্রীর নামে নরসিংদী জেলার পলাশ উপজেলার কাজৈর মৌজায় ১ হাজার ৩২২ শতক জমির মূল্য দেখিয়েছেন ১ কোটি ৯ লাখ টাকা।
শেখ হেলালের ছেলে শেখ তন্ময়। তিনি বাগেরহাট-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য ছিলেন দুইবার। তাঁর বাবার অফিস যে ভবনে, সেই ভবনে ‘শেখ লজিস্টিকস’ নামে তাঁর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ব্যবসাসহ অন্যান্য খাত থেকে বছরে তাঁর আয় ৮৬ লাখ টাকা। তাঁর কাছে ২ কোটি টাকা মূল্যের তিনটি গাড়ি। ব্যবসায় পুঁজি আছে ৪ কোটি ২৮ লাখ টাকা। পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ১০ কাঠা জমি রয়েছে তাঁর। যার মূল্য দেখিয়েছেন ৩০ লাখ টাকা। একাদশ দশম সংসদ নির্বাচনের আগে তার জমা দেওয়া হলফনামায় বার্ষিক আয় সাড়ে ৭৭ লাখ টাকা দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ দশ বছরে তার আয় বেড়ে আড়াই গুণের বেশি হয়েছে।
শেখ হেলালের ভাই শেখ সালাহ উদ্দিন জুয়েল। খুলনা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। তার বার্ষিক আয় ৭ কোটি ২৯ লাখ টাকা। বাড়ি ভাড়া, কার্গো জাহাজের ব্যবসা, শেয়ার, ব্যাংকের মুনাফাসহ বিভিন্ন খাত থেকে তিনি এই আয় দেখিয়েছেন। তাঁর ব্যাংকে জমা ১৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকা, ১ কোটি টাকার এফডিআর, তিনটি কোম্পানির শেয়ার আছে ২১ কোটি ৬৯ লাখ টাকা, ২৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র, ৮৫ লাখ টাকা মূল্যের জিপ গাড়ি। স্ত্রী শম্পা ইয়াসমিনের নামে ব্যাংকে ১৪ কোটি টাকা, ২৩ কোটি ২৬ লাখ টাকার শেয়ার, ২৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র, ১ কোটি টাকা মূল্যের জিপ গাড়ি, ১৩ লাখ টাকা মূল্যের স্বর্ণালংকার।
তাঁর স্থাবর সম্পদের মধ্যে রয়েছে রাজধানীর পূর্বাচল নিউ টাউনে ১০ কাঠা জমি। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া ও খুলনার দিঘলিয়ায় তাঁর ৪ দশমিক ৪১ একর জমি রয়েছে। রাজধানীর গুলশান নিটল মডেল টাউন, মোহাম্মদপুর ও তেজগাঁওয়ে রয়েছে তিনটি ফ্ল্যাট। স্ত্রীর নামে কক্সবাজারের ইনানীর দুটি স্থানে রয়েছে ১ দশমিক ৪৮ একর জমি। যার মূল্য দেখিয়েছেন ৩ কোটি টাকা। ঢাকায় ড. কুদরত ই খুদা রোডে রয়েছে ছয়তলা বাড়ি। গুলশানে আছে ফ্ল্যাট।
শেখ হাসিনার ফুফাতো বোনের ছেলে মাদারীপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য নূর-ই আলম চৌধুরী লিটন। ২০০৮ সালে তার সম্পদ ছিল ৬২ লাখ ৭০ হাজার ৪৭৩ টাকা। যা ২০২৪ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৬০ কোটি ৭৯ লাখ ৯৭ হাজার ৯৫ টাকায়। সেই হিসেবে সম্পদ বাড়ার হার ৯৫৯৬ শতাংশ। তার স্ত্রী বছরে ৫১ লাখ টাকার বেশি আয় করেন। বিগত ১৫ বছরে তার অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে ১৭২ গুণ। টাকার অঙ্কে তা ৪৩ কোটি টাকার বেশি। তার স্ত্রীর সম্পদ বেড়েছে ৪২ গুণ। টাকার অঙ্কে তা ১২ কোটি ৭২ লাখ টাকা। নিজ নামে উত্তরা, আদাবর ও পূর্বাচলে আছে প্লট। নিজ এলাকা শিবচরে রয়েছে কৃষি-অকৃষি জমি।
ফরিদপুর ৪ আসনের সংসদ সদস্য মজিবুর রহমান নিক্সন। তার কমেছে বাষির্ক আয়। তবে বেড়েছে অস্থাবর সম্পদ। ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর থেকে পালিয়ে আছেন তিনি। এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের পাশাপাশি নামে-বেনামে বিপুল সম্পদ অর্জন করেছেন সাবেক এমপি নিক্সন চৌধুরী। তার নিজের ও পরিবারের নামে হাজার বিঘার বেশি ভূমির মালিকানা রয়েছে। রয়েছে ঢাকার পূর্বাচল, আদাবর, গুলশান ও বনানীতে প্লট ও ফ্ল্যাট। সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, কানাডায় রয়েছে বাড়ি। ফরিদপুরে নিজের বাড়িতে বানিয়েছেন আস্ত একটা চিড়িয়াখানাও।
শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই হাসানাত আব্দুল্লাহ। বরিশাল-১ আসনে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য। আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহরও সম্পদ বেড়েছে ব্যাপক। যেখানে ২০১৮ সালের নির্বাচনে তাঁর কাছে নগদ টাকার পরিমাণ ছিল ১৩ লাখ ৭১ হাজার ৭৪ টাকা, সেখানে এবারের সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় তাঁর নগদ অর্থের পরিমাণই এক কোটি ৪৭ লাখ ১৯ হাজার ৫০৯ টাকা।
২০১৮ সালের নির্বাচনে আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর হলফনামায় দেখা যায়, কৃষি খাত থেকে তাঁর বাৎসরিক আয় দুই লাখ ৮৬ হাজার টাকা, বাড়িভাড়া বাবদ আয় সাত লাখ ৬৩ হাজার ১৯৬ টাকা, ব্যবসা থেকে বাৎসরিক আয় দুই কোটি ২৯ লাখ টাকা, নগদ অর্থ ১৩ লাখ টাকা। এছাড়া ব্যাংকে জমা দুই কোটি ৭৯ লাখ ২২ হাজার ৫৮৯ টাকা, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকৃত অর্থের পরিমাণ এক লাখ ৮০ হাজার টাকা, একটি প্রাইভেট কার ও একটি জিপ ৭৯ লাখ টাকা, ১০০ ভরি স্বর্ণ, কৃষিজমি ২০ একর, অকৃষি জমি ৪০ একর।
এক কোটি ৮১ লাখ টাকা মূল্যের একটি দালান রয়েছে নিজ নামে।এ ছাড়া স্ত্রীর নামে নগদ অর্থ রয়েছে এক কোটি ৯৯ লাখ টাকা, ব্যাংকে জমা এক কোটি দুই লাখ টাকা, শেয়ার আট লাখ টাকা, ১৮ লাখ টাকার একটি কার, স্বর্ণ ৬০ তোলা, এক লাখ টাকার আসবাবপত্র ও অকৃষি জমি ৫২ শতাংশ।
দ্বাদশ নির্বাচনের হলফনামায় হাসানাত উল্লেখ করেছেন, কৃষি খাত থেকে তাঁর বাৎসরিক আয় তিন লাখ টাকা, ব্যবসা থেকে তিন কোটি ৩৬ লাখ টাকা, শেয়ার, সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক আমানত ৬৫ লাখ টাকা, চাকরি থেকে আয় ১২ লাখ ৬০ হাজার টাকা, নগদ অর্থ রয়েছে এক কোটি ৪৭ লাখ টাকা, ব্যাংকে জমাকৃত অর্থের পরিমাণ ২৫ কোটি ৯৪ লাখ টাকা, শেয়ার রয়েছে ৫১ লাখ ৮০ হাজার টাকা, সঞ্চয়পত্র তিন কোটি ৮১ লাখ ৫০ হাজার টাকা, এক কোটি ৭৪ লাখ টাকার দুটি জিপ, ৫০ ভরি স্বর্ণ, কৃষিজমি ১৭ একর, অকৃষি জমি ৪১ একর, ঢাকার কলাবাগানে একটি দালান, যার মূল্য ৮৯ লাখ ১১ হাজার ৫৭৫ টাকা। তাঁর জামানতবিহীন ঋণ রয়েছে পাঁচ কোটি ৬০ লাখ ৯০ হাজার টাকা।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শেখ ফজলে নূর তাপসের ফুফু। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র। তার বার্ষিক আয় প্রায় ১০ কোটি টাকা। তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদও প্রায় সোয়া শ’কোটি টাকা। শেখ ফজলে নূর তাপস পেশায় আইনজীবী। তিনি ব্যারিস্টার-অ্যাট-ল ডিগ্রিধারী। তার বার্ষিক আয় ৯ কোটি ৮১ লাখ ৩৮ হাজার ৪৬ টাকা। এর মধ্যে কৃষি খাত থেকে বছরে আয় ৩৫ হাজার টাকা। তাপসের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ১২২ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ১০৮ কোটি ৯০ লাখ ৮৯ হাজার ৬৯৩ টাকা। তার হাতে নগদ টাকা রয়েছে ২৬ কোটি ৩ লাখ ৩ হাজার ৫৫৭ টাকা। অন্যান্য খাতের মধ্যে ব্যাংকে জমা ১ কোটি ৫৩ লাখ ৭৭ হাজার ২০৭ টাকা, কোম্পানির শেয়ার ৪৩ কোটি ২৭ লাখ ৫৫ হাজার ৪০৪ টাকা, কৃষি জমি ১০ দশমিক ৫০ কাঠা, অকৃষি জমি ১০ কাঠা যার মূল্য ৩৮ লাখ ১৯ হাজার ৫০ টাকা, ৮ কোটি ৩৭ লাখ ২০ হাজার ৩১৩ টাকা মূল্যের মতিঝিল, পূর্বাচল ও সাভারে তিনটি দালান রয়েছে। তার একটি বাড়ি রয়েছে যার মূল্য ৩ কোটি ২৮ লাখ ৫০ হাজার ৮৯৪ টাকা। হলফনামায় শেখ ফজলে নূর তাপস তার স্ত্রীর আয় ও সম্পদেরও বিবরণ দিয়েছেন।
সবশেষ হলফনামার তথ্য অনুযায়ী তাপসের সম্পদ আছে ১২০ কোটি টাকার বেশি।
এসআর